Wednesday 15 June 2016

মণি-মুক্তা



বিজয়গড়ে তখন সবেমাত্র পূব আকাশের কোল লাল হয়ে উঠেছে । রাজার নামেই এ রাজ্যের নাম । মহারাজ বিজয় অতিশয় প্রজা বৎসল রাজা হিসাবেই খ্যাত । তার রাজ্যে হেন কোন প্রজা-পশু-পাখী নেই যারা রাজার গুণগান করে না । এ হেন রাজ্যের রাজা সেদিন সূর্যদেবকে প্রথম অর্ঘ্য নিবেদন করার জন্য প্রাসাদের পূর্ব দিকের উদ্যানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন । কিন্তু তিনি আজ বিস্মিত ! রানী চন্দ্রিকা , রাজকন্যা মুক্তা , রাজপুত্র মণি সকলেই স্তম্ভিত ! সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও সূর্যদেব কেন দেখা দিচ্ছেন না ! এমন তো আগে কোন দিনও হয় নি ! রাজার আদেশে প্রহরীরদল ছুটলো রাজ-জ্যোতিষীর কাছে । ক্ষাণিক পরেই রাজ-জ্যোতিষী পুঁথিপত্র আনতেই মহারাজা চিন্তিত ভাবে বললেন –
“ বিজয়গড়ের পূব আকাশ লাল-
দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় আছি , কেন হেন কাল !!”
রাজ-জ্যোতিষী মহারাজের কথা শুনেই খড়ি কেটে নানা আঁক যোগ করে , কর গুণে ভয়ে ভয়ে বললে –
“ মহারাজ এ যে বড়ই অলুক্ষণে ব্যাপার –
সূজ্যিদেবের কোপে রাজ্য যে হবে সাবাড় !”
রাজা , রানী , রাজকণ্যা , রাজপুত্তুর প্রবল বিস্মিত হয়ে একসাথে কয়ে উঠলেন –
“ বল কী ! রাজ্য হবে সাবাড় –
সূর্য কোপ ! কী আছে প্রতিকার !”
রাজ-জ্যোতিষী নিজেও জানে না এর প্রতিকার কী করে হবে ! এমন সময়ে রাজমহলের প্রধান ফটকের ঘড়ি ঢং ঢং ঢং বার কয়েক বেজে উঠল । যা সময় জানান দিল তাতে শুধু রাজাই নন সমগ্র বিজয়গড়বাসী চমকে ওঠে । আজ একি মহাকাল হল !
রাজার জরুরী তলব পেয়ে মন্ত্রী আমাত্যরা নানা পরামর্শ করল বটে কিন্তু উপায় কিছুই খুঁজে পেল না । বিষণ্ণ মনে রাজা সেদিনকার মত রাজকার্জ বন্ধ করে এগিয়ে চলতে থাকলেন নিজের কক্ষে । লক্ষ্য করলেন , আকাশে নেই কোন ছন্দ , উদ্যানের ফুলে নেই সৌরভ , নেই মধু সমীরণ ।
নানা কথা ভাবতে ভাবতে পা ফেলছেন রাজা । রাজার পোষা ময়না নিজের মনেই ঘুড়ে বেড়ায় প্রাসাদে । রাজা খাঁচায় তাকে কোনদিনও রাখে না । ময়নাও তাকে ছেড়ে যায় না । সেই হলুদ ঠোঁটের ময়না উড়তে উড়তে রাজার কাঁধে  চেপে বসতেই রাজা তাকে খুবটি করে আদর করলেন । আর জানালেন এই দুঃখের ঘটনা ।
মাথা বাঁকিয়ে ডানা নেড়ে সব কথা শুনে বিজ্ঞের মত ময়না বলে –
“ সূজ্যিমামার মনে ভীষণ দুখ –
আকাশদাদার বিশাল অসুখ ।
রাজকুমার মণি করতে পারে ঠিক –
যায় যদি, বেতাল পাহাড় ভুল না করে দিক্‌ ।”
একথা শুনে রাজা দু’হাত দিয়ে ময়নাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে আনলেন । আর বিস্ময়ে দু’চখ গোল করে বললেন –
“ ময়না আমার ময়না –
এমন কথা কয় না !
মণি যে কচি ছেলে –
ওই    পাহাড়ের কেমনে হদিস মেলে !”
ময়না আর কোন কথা না বলে উড়ে চলে গেল । রাজা বুঝলেন বেতাল পাহাড় ছাড়া আর গতি নেই । রানীকে সব কথা বলতেই রানী দু’পা ছড়িয়ে কাঁদতে শুরু করে দিলেনকিন্তু আশ্চর্য সাহস ছোট্ট মণির ! সে বাবা মাকে স্বান্তনা দিয়ে বলে –
“ দেশের তরে যাব বেতাল পাহাড়
দাও আশীস , কর না মন ভার ।”
ওদিকে রাজকুমারী মুক্তা ভাইয়ের কথা শুনে অমনি বলে ওঠে –
“ আমিও যাব , থাকবে তলোয়ার
পথের বাধা আসলে, করব মোরা পার ।”
রাজা-রাণী ছেলে মেয়ের কথা শুনে সাহস দেখে কান্না ভুলে গেলেন । গর্ব বোধ করলেন । কিন্তু রাজা মনে করিয়ে দিলেন কেবল মাত্র মণিই পাহাড়ে যেতে পারবেরাজকুমারী পাহাড়ের নীচে থাকতে পারে ।
মণি মুক্তা আশ্বাস দিয়ে নতুন সাজে সাজতে আপন আপন কক্ষে চলে গেল ।
বেতাল পাহাড়ের নাম শুনেছে অনেকেই কিন্তু কোন দিকে বা কোন পথে তা কেও জানে না । কেও বলে উত্তরে আবার কেও বলে পূবে । তাছাড়া ওই ভয়ঙ্কর পাহাড়কে সকলেই এড়িয়ে চলে খানে রয়েছে  মুলোর মত দাঁত আর কুলোর মত কানের বেতাল রাজা তার দলবল নিয়ে । বেতাল রাজা ভয়ানক নিষ্ঠুর ।
মণি মুক্তা এ কথা শুনে একে অপরের মুখের পানে চায় তারা রাত থাকতেই প্রাসাদ থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে বেড়িয়ে পরেছে পথে টগ বগিয়ে আবার যেতে যেতে সামনেই দেখল সুবিশাল জঙ্গল । অনেকক্ষণ পথ চলে তারা আর ঘোড়াগুলি অতিশয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ।
কোন ফাঁকে যে আবার রাত হয়ে গেছে খেয়ালই করে নি ।  ভাবলে সামনের প্রাচীন ঝাঁকড়া জামগাছের তলায় রাতটা কাটিয়ে আবার রওনা দেবে । গাছের ফাঁক দিয়ে মিটমিট করছে ম্লান চাঁদের আলো । ক্লান্তিতে চোখের পাতা ভেঙে পরছে । হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল একটানা একটা শব্দে । দূরে ভেসে আসছে ঘন ঘন বাঘের গর্জন ।
মণি মুক্তা চোখ খুলেতেই আরও অবাক হয়ে গেল , যখন দেখল তাদের ঘোড়াগুলোকে দেখতে পেল না ! ভাবলে জঙ্গলের কোন হিংস্র পশু খেয়ে নিয়েছে , তাদের ঘুমানোর সময় । এদিকে বাঘের গর্জন ক্রমশ এগিয়ে আসছে । হাতের তলোয়ার বাগিয়ে তারা জামগাছের একটা ডাল ধরে যেই না উঠতে গেছে অমনি জামগাছ প্রবল ভাবে নড়ে উঠে তাদের নীচে ফেলে দেয় । এ দেখে রাজকুমার মুক্তা রেগে তলোয়ার উঁচিয়ে বলে ওঠে –
“ এমন করে জামগাছ –
ডালপালা কেটে
শাস্তি দেবই আজ
ভাইকে শান্ত করায় মুক্তা আর তারপর জাম গাছের দিকে জোর হাতে অনুরোধ করে বলে –
“ জামগাছ জামগাছ , সামনে বড়ই বিপদ –
ওই ডাকে বাঘ, ক্ষমা কর এই অনুরোধ ।”
জামগাছ মুখ বেঁকিয়ে পাতা ঝড়িয়ে জবাব দেয় –
“ দেখো কাকে বলে কষ্ট –
তোমরা করেছ অনেক অনিষ্ট !”
ওমা সে কী ! তারা তো কোনদিনও কাওকেই কষ্ট দেয় নি ! বাঘ প্রায় কাছেই চলে এসেছে । চোখে তার জ্বল জ্বল করছে তারার মত আলো । মুক্তা পুনরায় অনুরোধ করতে জামগাছের কী মনে হল , সে তার একটা ডাল মুক্তার দিকে বাড়িয়ে দিল । মুক্তা ডালটা ধরে উঠেই ভাইয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় । কিন্তু হায় ! ডালটা শুধু মুক্তাকে নিয়ে শন শন করে উপরের দিকে উঠতে থাকে । মুক্তা কী করে দেখবে তার এক মাত্র ভাইয়ের মৃত্যু ! সে যে ভাইকে প্রতি মুহূর্তে রক্ষা করবে বলে মা বাবাকে বলে এসেছে ।
মুক্তা লাফ দিয়ে নেমে পড়ল গাছের ডাল থেকে । আর ওদিকে বাঘ মণির সামনে দাঁড়িয়ে । মণি একটুও ভয় না পেয়ে হাতের রাঙা তলোয়ার উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । যেন তার চোখেও আগুনের ফুল্কিহায় হায় সব গেল ! মুক্তা এগিয়ে গিয়ে গেল ।
কিন্তু আশ্চর্য হয়ে গেল ! মণির কানের কাছে মুখ নিয়ে বাঘ ফিসফিস করে কী যেন বলে উঠল । আর মণি পরম স্নেহে বাঘের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে খুব সন্তর্পণে একটা বড় দেখে সজারুর কাঁটা বার করে দিল । বাঘের থাবা থেকে ছুটল ফিনকি দিয়ে লাল রক্ত । আহা ! কী কষ্ট পাচ্ছে ! এই ভেবে মুক্তা দৌড়ে এসে নিজের বহুমূল্যের কাপড় খানিকটা ছিঁড়ে বাঘটার পায়ে ভাল করে বেঁধে দিল ।
মণির সাহস আর মুক্তার বুদ্ধি ও মায়া দেখে বৃদ্ধ বাঘ খুবই সন্তুষ্ট হল । জামগাছও দেখছিল এই দুই বাচ্চার কান্ড । এমন সাহস আর মায়া তারা আগে কেউই দেখে নি । ভীষণ খুশী হয়ে তারা আশীর্বাদ করলে ।
জামগাছ তার একটা ডাল দিয়ে বললে –
“ মণি মুক্তা রাখ এই ডাল –
যে করবে ক্ষতি
খারাপ হবে তার হাল ।”
বৃদ্ধ বাঘও তার একটা তীক্ষ্ণ দাঁত দিয়ে বললে –
“ মুক্তা মণি এ দাঁত করবে বিদ্ধ হৃদয় –
                     বেতালরাজ না হয় যদি সদয় ।”         
ঠিক তখনই আরেক অচেনা অতিথি পাশের একটা বট গাছ থেকে বেড়িয়ে আসে । এক ঝালর পাখী । তার চারিধার থেকে ঝুলে আছে হরেক রঙের পালক । চাঁদের হাল্কা আলো সেই পালকে পরতেই ঝলমল করে উঠছে পালকগুলিঅপরূপ সুন্দর তার বাহার । মাথায় আবার এক বাঁকা ঝুটি । ঝালর পাখী মণি মুক্তার কাছে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল –
“ দেখেছি তোমাদের সাহস মোরা
ধরে নেছে বাছা আমার -
বেতালরাজের সৈনিক কয়েক জোড়া ।”
মণি মুক্তা সকলের দিকে তাকিয়ে বিনম্র ভাবে জানায় যে , তারা জানে না কোন দিকে পথ বেতাল পাহাড়ের । জানে না কী ভাবেই বা যাবে !
এ শুনে ঝালর পাখী বলে ওঠে –
“ আমি নিয়ে যাব সেথায় –
মারবে বাড়ি বেতালের মাথায় ।”
কথাটার অর্থ ঠিক মত বুঝতে পারল না কচি ওই ভাই বোন । কিন্তু বিশাল ডানা মেলতেই চেপে বসল তারা ঝালর পাখীর পিঠে । হাতে থাকল বাঘের দাঁত , গাছের ডাল আর কোমরে রইল তলোয়ার । সকলকে বিদায় জানিয়ে ঝালর পাখী নিয়ে চলল আকাশপথে সা সা শব্দ তুলে বেতাল পাহাড়ে ।
বেতাল পাহাড়ের চারিদিক বরফে মোড়া । মোতির নদী ঝরে যাচ্ছে অবিরাম । সোনার গাছে চুনীর মত লাল ফল । পাহাড়ের নীচে ঝালর পাখী মণি মুক্তাকে নিয়ে নামল । মুক্তা জানে এই পাহাড়ের উপরে সে যেতে পারবে না ! কী আর করা ! মণি দিদিকে তার মাথার পাগড়ির একটা পান্না দিয়ে জানাল –
“ সবুজ পান্না যদি হয় লাল
বুঝবে বিপদ আমার –
এস তবেই , নাশ করতে বেতাল ।”
মন সয় না ! তাও ভাইকে আদর করে বিদায় জানাল মুক্তা । ঝালর পাখী তার একটা পালক দিয়ে বলে দিল –
“ হিমের রাজ্য বেতাল পাহাড় -
পালক স্পর্শে গরম লাগবে তোমার ।”
হি হি করা ঠাণ্ডার মধ্যে পালকটা পোশাকের মধ্যে রাখতেই শরীরে উষ্ণ অনুভব করে ছোট্ট কুমার । এগিয়ে চলে বেতাল রাজ্যে ।
বেশ খানিকটা উপরে উঠতেই দেখে বিশাল বিশাল মানুষের মত দেখতে লোক এদিক ওদিক যাতায়াত করছে পাগলের মত । তাদের হাতে মোটা মোটা গাছের ডাল । দু’জন বেতালের কাঁধে বিশাল একটা খাঁচার মত জিনিষ ! কে যেন সেই খাঁচা থেকে কেঁদে কেঁদে উঠছে ।
কিছুই বুঝতে পারছে না রাজপুত্তুর ! কী করে যাবে সে বেতাল রাজের কাছে ! পাথরের আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে এগোতে থাকে । কিন্তু শেষ রক্ষা আর হল না ! এক চোখা বিশাল এক বেতালের কাছে ছোট্ট কুমার ধরা পরে গেল । এক চোখা এই দানব হল , বেতাল রাজার সেনাপতি । একটা বিশাল চোখ তার কপালে । সেই চোখের দৃষ্টি থেকে মানব থেকে শুরু করে একটা কীটও পালাতে পারে না ।
এদিকে তাড়াহুড়াতে মুক্তা প্রচণ্ড বড় ভুল করে ফেলেছে । ভাইকে সেই ডাল , দাঁত দিতেই গেছে ভুলে । পাহাড়ের গোড়ায় বসে ঝালর পাখীর গলা জড়িয়ে কেঁদে কেটে একসা ! নিজেও যেতে পারবে না ।
এমন সময়ে ঝালর পাখী ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে ওঠে !
“ মুক্তা রাজকন্যে –
তৈরী হও যাওয়ার জন্যে ।
লাল যে হল পান্না –
সাহস আনো, মোছ কান্না ।”
সজল নয়নে মুক্তা দেখে হাতের পান্না কখন লাল রঙের হয়ে গেছে । সব কিছু এবার মনে করে সাথে নিল সে । চেপে বসল ঝালর পাখীর পিঠে । পাখা মেলে ঝালর পাখী উড়ে যেতে থাকল পাহাড়ের চূড়ায় ।
তীব্র তার গতি । কেও রুখতে পারবে না তার পথ । ঝালর পাখীর সন্তানও সেখানে বন্ধী । মায়ের মন বাছার জন্য আরও বেশী ছটফট করছে ।
দেখতে দেখতে সকলের দৃষ্টির আড়ালে উপস্থিত হল তারা । রাজকন্যা মুক্তা দেখল তার ভাই মণিকে আটকে রেখেছে বেতাল রাজার সৈনিকশুধু তার ভাই নয় ! আরও কত মানুষ শিকল দিয়ে বাঁধা । নানা খাঁচায় আছে কত রকমের পশু –পাখী ! অবাক হয়ে যায় রাজকন্যা !
ঝালর পাখী আস্তে আস্তে জানায় এই দানব দুষ্টু বেতাল রাজা জঙ্গলের পশু পাখী ধরে ধরে তাদের ছাল বাকল দিয়ে পোশাক বানায় । আর মানুসগুলোকে দিয়ে জোর করে , চাবুক মেরে কাজ করায় আর যারা তার কথার অমান্য করে তাদের মেরে ফেলে হাড়ের পাহাড় তৈরী করে ফেলে ।
এ কথা শুনে মুক্তা একটু উঁকি মেরে দেখে ডান দিকেই ঝকঝক করছে একটা সাদা হাড়ের পাহাড় । আর স্থির থাকতে না পেরে সাহসে ভর দিয়ে সোজা উপস্থিত হয় বেতাল রাজের দরবারে ।
বেতাল রাজ মুক্তাকে দেখেই কর্কশ গলায় বলে ওঠে –
“ কে রে তুই , এত স্পর্ধা –
আজ তোর ধড়ে থাকবে না মাথা ।”
সভায় ছিল সেই এক চোখা দানব সেনাপতি । সে যেই না ধরতে এসেছে অমনি মুক্তা জাম ডালটা এগিয়ে ধরে বলে –
“ ডাল ডাল -
একে কর বেহাল ।”
আদেশের অপেক্ষা যেন করছিল ডাল । শোনা মাত্র ডাল সাঁ করে এক চোখার চোখের মধ্যে ধাঁ করে ঢুকে গেল । সেই দানব কোন সুযোগই পেল না আটকাতে বরং “ বাবা গো ” বলেই সজোরে মাটিতে আছাড় খেয়ে পরল । বিশাল তার শরীর । মাটিতে পরতেই সারা পাহাড় যেন থর থর করে কেঁপে উঠল । বেতাল রাজ সিঙ্ঘাসন থেকে মুখ থুবড়ে পরল ।
 এতে বেতাল রাজ রেগে গিয়ে আরও তাল হারিয়ে ফেলে । রাগ যে প্রধান শত্রু তা এই বেতালরা বোঝেই না । যত রাজা তাল হারায় ততই করতে থাকে ভুল ।  
রাজকন্যা মুক্তা আগে এসব কখন দেখে নি । সামান্য একটা ডাল এই বিশাল দানবের এ হাল করতে পারবে ভাবতেই পারে নি সে ! কিন্তু সে ভুলে গেছিলো ডালের প্রয়োগ একবারই করতে পারবে ।
ওদিকে রাগে অন্ধ হয়ে বেতাল রাজা ছুটে এসে ধরে ফেলে ছোট্ট রাজকন্যাকে । সে নিজেও অবাক এই একরত্তি মেয়ের কান্ড দেখে ! দাঁত কিড়মিড় করে বলে ওঠে –
“ এক রত্তি এত সাহস তোমার –
মেরে পুঁতবো , ওই দেখ হাড়ের পাহাড় !”
রাজকন্যা হাতের তলোয়ার নিয়ে এবার গর্জে ওঠে –
“ তালহীন রাজা বেতাল –
তোদের জন্য প্রকৃতি-রাজ্য বেহাল ।
করব তরে ধ্বংস –
আকাশ-বাতাস-বাঁচাবে আমাদের বংশ ।”
কথা শুনে পাহাড় কাঁপিয়ে বিশাল ভুঁড়ি নাচিয়ে বেতাল আবার বলে –
“এ রাজ্য আমার, বেতাল আছে সব দেশে –
আকাশ-বাতাস সবকটাকে রাখব আমার বশে
আমি সব বেতালের রাজা –
দেব তোকে কঠিনতম সাজা ।”
রাজকন্যা তখন উপায় না দেখে তলোয়ারের আঘাত হানে রাজার মাথায় । কিন্তু একী ! মাথা তো কাটলোই না বরং শেষ অস্ত্রটিও ভেঙে খান খান হয়ে গেল ।
মুক্তার এই দুঃসাহস দেখে আর সহ্য করতে পারল না রাজা বেতাল হুঙ্কার ছেড়ে দু’হাতে মধ্যে পিষে ফেলতে লাগল রাজকুমারীকে । নরম পদ্মের মত শরীরটা ব্যথায় যেন গলে যেতে লাগল ।
খাঁচায় বন্ধী পশু-পাখী-মানুষরা হায় হায় করে উঠল । তখন ঝালর পাখী তার বিশাল ডানা মেলে দুরন্ত বেগে অতিকায় বেতাল রাজার ঘাড়ে গিয়ে ধাক্কা মারতেই রাজকুমারী ছিটকে পরে হাত থেকে মাটিতে
বেতাল তাল সামলিয়ে ঝালর পাখীকেও তার লম্বা দু’হাত দিয়ে ধরে ফেলে রাজকন্যার কথা ভুলে । রাজকুমার মণি সেই মুহূর্তে খাঁচা থেকে বলে ওঠে –
“ দিদি আছে বাঘের দাঁত –
রাজা হবে কুপকাত ।”
রাজকন্যার তখন মনে পরে গেল তার কোমরের গোঁজা আছে সেই দাঁতখানি । প্রায় ছিঁড়তে চলেছে পাখীর মাথা এমন সময়ে আদেশ পেয়েই সজোরে এসে দাঁত বিঁধে যায় বেতাল রাজার বুকে ।
অসহ্য যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে বেতাল রাজার প্রানপাখী বেড়িয়ে যায় । একটু পরেই সেই বুকের ফুটো থেকে একটা হলুদ ধোঁয়া বেরোতে থাকে । আর সেই ধোঁয়া আকাশে মিলিয়ে যেতেই একে একে সব খাঁচার তালা খুলে যায় ।
বেতাল রাজা মারা যেতেই বাকী বেতালরাও দুম দাম করে কাটা গাছের মত পরতে থাকে আর পটাপট মরতে থাকে । কারণ সব বেতালদের প্রানপাখী ওই বেতাল রাজার হলুদ ধোঁয়ার মধ্যেই ছিল । ছিল সব খাঁচার চাবিকাঠিও ওই বেতাল রাজার হৃদয়ের হলুদ ধোঁয়ায় ।
এমনকি ওই এক চোখা দানবটা যে এতক্ষণ কাতরাচ্ছিল তার  সমাপ্তিও ঘটল ।
খাঁচা থেকে মুক্তি পেয়ে সকলেই ধন্য ধন্য করে উঠল । ঝালর পাখীর ছা মাকে পেয়ে ছুটে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে । মণি মুক্তা ঝালর পাখীর পিঠে চেপে বিজয়গড়ের দিকে উড়ে চলল । পথে সেই মোতির নদী বলে উঠল –
“ রাজকন্যে রাজপুত্তুর
নিয়ে যাও জল মুক্তোর ।”
তারা জল নিল । আবার কিছুটা যেতেই সোনার গাছ বলে ওঠে –
“ মণি-মুক্তো, যাও নিয়ে স্বর্ণ পাতা –
এর পরশে যাবে সকল মনব্যাথা ।”
তাও নিল ভাই বোন ।
অবশেষে ভোরের দিকে প্রাসাদের ছাদে ঝালর পাখী তাদের নামিয়ে আবার ফিরে যায় নিজের দেশে ।
প্রহরীরা খবর দিতেই রাজা , রানীমা সকলেই প্রাসাদের ছাদে দৌড়ে আসেন । রানী ছেলে-মেয়েকে কত আদর করতে থাকেন । মুক্তো বাবার হাতে জল আর স্বর্ণ পাতা দিয়ে বলে –
“ মানুষ হয় যদি বে-তাল –
জীবনের সব হিসাব হয় বে-চাল ।
বেতাল রাজা ধ্বংস আজই –
প্রকৃতি উঠবে নব সাজে সাজি ।”

রাজামশাই মোতির জলে স্বর্ণ পাতা দিয়ে সূর্যদেবকে অর্ঘ্য দিতেই পূবের কোল থেকে কালো মেঘ সরে গেল । দেখা দিলেন সূর্যদেব । সাথে নীল কাঁচের মত আকাশ ঝিকমিক করে উঠল । বাতাসে ছুটল ফুলের মধুর সৌরভ । বিজয়গড়ের সাথে সমগ্র দেশ সুন্দর ও আনন্দময় হয়ে উঠল নতুন এই দিনে ।।

আত্মারা যখন অন্য গ্রহে

১ রা তটা এখন বেশ গভীর । টুক করে শব্দ হতেই কান সজাগ হয়ে উঠলো অ্যাটলাসের । মাথার মধ্যে টিঁ টিঁ কী বেশ ক্যাল্কুলেশন করেই এগিয়ে গেল দরজার ...