Thursday 9 November 2017

মহাভারতে অর্জুন থেকে বৈদিক যুগে নৃত্যকলা


Image result for sculpture in indian dance

আধুনিক জীবনে নৃত্য আমাদের সকলের কাছে মনরঞ্জনের জন্য এক বৃহৎ মাধ্যম । কিন্তু এই শিল্পের শিকড় খুব যে আধুনিক নয় তা আমরা জানি । বেদ থেকে মহাকাব্যের নানা ভাগে তাদের উল্লেখ প্রছন্ন ভাবেই আছে । যার কথা আমি “ দেবদাসী সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ” প্রবন্ধে বিস্তারে লিপিবদ্ধ করেছি । বর্তমানের প্রবন্ধটি আমি মহাকালের প্রেক্ষাপটে ভারতীয় নৃত্যের প্রমান ও বিকাশ স্বরূপ তুলে ধরার প্রচেষ্টা করলাম । সমগ্র বিষয়টিকে দুটি ভাগে বিভাজন করা হয়েছে । প্রথমটি হল মহাভারতে অর্জুনের ও অন্যান্যদের নৃত্য প্রসঙ্গ এবং দ্বিতীয়টি হল বৈদিক যুগের নৃত্য । প্রথমেই এক্তা কথা লেখা আবশ্যিক , যেহেতু উক্ত বিষয়দ্বয় হাজার হাজার বছর প্রাচীন তাই লেখ্য প্রামান্যের থেকেও লোকগাঁথা অধিক ।  

অর্জুন ও অন্যান্যদের নৃত্য শিক্ষা

হিন্দু তথা সমগ্র ভারতের অন্যতম প্রাচীন মহাকাব্য মহাভারত । এই মহাকাব্যের কাহিনী আমরা কম বেশী অনেকেই অবগত । বর্তমান প্রবন্ধে এমন একটি দিকে আলোকপাত করার প্রচেষ্টা করছি যা হয়ত ভারতীয় নৃত্য তথা সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ।
মহাভারত এবং তৎকালীন যুগে সঙ্গীত ও নৃত্যের নানা পরিচয় পাওয়া যায় । সমগ্র মহাভারত অনুসন্ধান এবং পর্যালোচনা করলে তাঁর পরিচয় নানা ভাবে আমাদের সামনে আসে । বৈদিক যুগে “সাম বেদ” ছিল নানা কলার ধারক , বিশেষত সঙ্গীত ও বাদ্যের । যার উল্লেখ আমরা পাই মহাভারতে । এই সময়ে গান্ধর্ব গানের প্রচলন ছিল । মঙ্গলাচরণ বা মঙ্গল গীতি বহুল ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে এই মহাকাব্যের নানা পর্বে । এই যুগেই একক ও দলবদ্ধ নৃত্যের পরিচয় পাওয়া যায় । ইন্দ্রের সভায় অপ্সরাদের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েছে মহাভারতের যুগেই । যেমন , কুরু বা বিশ্বামিত্রের জন্য স্বর্গ থেকে উর্বশী এবং মেনকা মর্তে আগমন করেছিলেন । সুন্দ্র ও উপসুন্দ্রকে নৃত্যের মায়াজাল বিস্তার করে ধ্বংস করার জন্য তিলোত্তমার উদ্ভবের কাহিনীও এখানে পেয়ে থাকি । অর্থাৎ আমার মুল কথা এখানে বলতে চাইছি যে সারা মহাভারতে স্বর্গীয় শিল্পী তথা অপ্সরাদের আবির্ভাব মহাকাব্যের আনাচকানাচের সাথে প্রকাশ্যেও এসেছে নানা সময়ে । বান পর্বে দেখা যায় , অর্জুন ইন্দ্রের সভায় এসেছেন এবং সেখানেই তিনি সংগীত শিক্ষা লাভ করেছেন । বিরাট পর্বে সেই অর্জুন ছদ্মবেশ ধারণ করে বৃহন্নলার রূপে রাজ অন্তপুরে নৃত্য পরিবেশন করতে কোনরূপ কুন্থা বোধ করেন নি । ইন্দ্রের রাজসভায় অপ্সরাগণ যখন অর্জুনকে নাচ শেখাচ্ছেন তার বর্ণনা মহাভারত পড়লেই বোঝা যায় । কিন্তু কোন শৈলীতে নৃত্যকলা প্রদান করা হয়েছিল তা জানা যায় নি । অন্যদিকে গন্ধর্বগণ এবং রূপসী অপ্সরাগণ তাঁকে গীত ও বাদ্যের মাধ্যমে মনোরঞ্জন করতে ভোলেন নি ।
অঙ্গুর নামক গন্ধর্ব গীতে ও নৃত্যে অর্জুন বিশেষ পারদর্শী ছিলেন । যেসকল অপ্সরাগণ নৃত্য প্রদর্শন করতেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন – মেনকা , রম্ভা ,স্বয়ংপ্রভা , উর্বশী প্রমুখ । পরবর্তী সময়ে অর্জুন নৃত্য শেখেন চিত্রসেনের কাছেও । চিত্রসেনের নাম প্রস্তাব করেছিলেন দেবরাজ ইন্দ্র । অর্জুনের নৃত্যকলা শেখার সাথে বাদ্যযন্ত্র প্রশিক্ষণের কথা লিপিবদ্ধ আছে । এই চিত্রসেনকে বলা যায় অর্জুনের প্রধান কলা বিদ্যার শিক্ষাগুরু । তিনিই ইন্দ্রের নির্দেশানুসারে গীত-বাদ্য-নৃত্যে পারঙ্গম করে তুলেছিলেন ।
বিরাট পর্বে রাজকুমারীদেরও নৃত্য শিক্ষার কথা জানা যায় । অর্থাৎ এর থেকে সে যুগের কুমারী মেয়েদের নৃত্য শিক্ষার গুরুত্ব কতটা ছিল তা জানা যায় ।নৃত্যের জন্য প্রস্তুত বিশেষ “নর্তনমালায়” নৃত্য শিক্ষা দেওয়া হত এদের সকলে । একথা জানা যায় , ওই নৃত্যশালা নৃত্য অনুষ্ঠানের মঞ্চ হিসাবে ব্যবহৃত হত না , তা শুধুমাত্র নৃত্য শিক্ষার স্থান বা বিদ্যালয় হিসাবেই পরিগণিত হত । রামায়ণ ও মহাভারতের যুগ নিয়ে বিরোধ থাকলেও এটা বোঝা যায় রামায়ণের পর মহাভারতের যুগে এসে নৃত্যের বিকাশ ও রূপের যতটুকু স্পষ্ট পরিচয় আমারা রামায়ণে পাই তা মহাভারতে পাই না । এ যুগে কেবলমাত্র নৃত্য শিক্ষার কথা জানা যায় ।
মহাভারতের বিভিন্ন কাহিনী প্রসঙ্গে নৃত্যের কথা পাওয়া যায় । যেমন , বৃহস্পতির পুত্র কচ ; যিনি নৃত্যগীত এবং বাদ্যের দ্বারা তার ছাত্রী দেবযানীর মন হরণ করেছিলেন । আবার , পাঞ্চাল রাজের সভায় ন্রিত্য-গীতের বিশেষ সমাদর ছিল । খাণ্ডবদাহ পর্বে দেখা যায় । শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন তাদের পরিজন এবং কুলনারীদের নিয়ে যমুনাতে জল বিহারের সময় নদী তীরে খাণ্ডব বনে পান-ভোজন-নৃত্য-গীত প্রভৃতি করেছিলেন । বন পর্বে , তম্বুর প্রভৃতি গন্ধর্বরথীরা বীণা বাদ্য সহযোগে গান করেছিলেন । এছাড়া এখানে ঘৃতাচী , মেনকা , রম্ভা প্রমুখ উচ্চ রূপসী অপ্সরাও নৃত্য উপস্থাপন করেন ।
অর্জুন পাঁচ বছর অজ্ঞাতবাসের সময় নৃত্য শিখেই ক্ষান্ত থাকেন নি বরং , বৃহন্নলা সেজে রাজকন্যা উত্তরা ও রাজপুত্রদের নৃত্য শিক্ষাও প্রদান করেছিলেন । প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য , এ সময়ে নৃত্য ও গীতের সময় নানা প্রকার বাদ্যযন্ত্র ব্যভার করা হত । সেগুলির মধ্যে প্রধান ছিল , তৎ , ভুসীর , বেণু , ভেরি , পুষ্কর , ঘন্টা , গজঘন্টা , জারিজ , নুপুর , দুন্দুভি প্রভৃতি ।

বেদে নৃত্য

এবার আসি প্রবন্ধের দ্বিতীয় আলোচনায় – বৈদিক যুগে নৃত্যকলা ।আর্যরা ঠিক কোন সময়ে ভারতে এসে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় তার সঠিক তথ্য জানা প্রায় অসম্ভব । তবুও আর্য যুগের গীত-বাদ্য-নৃত্যের উপাদানগুলি – বেদ , উপনিষদ , সূত্র , কাব্য ,মহাকাব্য , পুরাণ প্রভৃতির মধ্যে পরিলক্ষিত হয় । প্রসিদ্ধ প্রত্নতত্ত্ববিদ মার্টিনার পিলার , সিন্ধু সভ্যতার পতন এবং আর্যদের আগমন – এই দুই ঐতিহাসিক ঘটনার সংযোগ স্থাপন করেন । বিভিন্ন সময়ে আর্যরা সপ্ত-সিন্ধু অঞ্চলে এসে বসবাস করে । বেদে এইসব নগরকে বা নগরের প্রাসাদগুলিকে “পুর” বা “দুর্গ” বলা হয়েছে । বেদের প্রধান দেবতা ইন্দ্র তার অনুগত আর্যদের এইসব দুর্গ ধ্বংস করতে সাহায্য করেছিল বলে ইন্দ্রকে পরাজর বলা হত । এই আর্য সময়ে ( আনুমানিক ৪০০০ বছর আগে ) ভারতীয় সঙ্গীতের উৎস হয় ঋকবেদের সময় । আবার সামবেদও তার মিষ্ট মন্ত্রের জন্য তৎকালীন সময়ে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে । মূলত ঋকবেদের উদ্দেশ্যে প্রশংসাসূচক সামগানের রীতি প্রচলিত ছিল তখন । যজ্ঞের সময় অগ্নিকুণ্ডকে ঘিরে গান করে হাতে তালি দিয়ে নৃত্য করা হত সামগান সহ ।
বৈদিক মহাব্রত অনুষ্ঠানে দাসীরা জলপূর্ণ কলসী মাথায় ভীষ্ম ও মার্তালীয় যজ্ঞবেদিকে বাম থেকে দক্ষিণ দিকে নাচের দ্বারা প্রদক্ষিণ করতেন । এই উৎসবে শস্য উৎপাদন ও পরিপূর্ণ বৃষ্টিপাতের জন্য একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে নৃত্যের সাথে নানা প্রকার বাদ্যযন্ত্র বাজানো হত । সাথে উপাদান হিসাবে থাকতো তেল , হলুদ । যা মেখে এই উৎসবটি পালিত হত 
পরিশেষে এটাই লিখতে হয় শিল্প-সাহিত্য যেকোনো বিষয় হোক না কেন তাদের পৌরাণিক দিক থাকে , তা প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যই হোক না কেন । বিভিন্ন সময়ে আমরা নানা দিক নিয়ে আলোচনা করি , লিখেও থাকি কিন্তু আমাদের জীবনে এমনও  অনেক বিষয় রয়েছে যা আমাদের গোচরে আপাত ভাবে পড়ে না । এ কথা মনে রাখা ভীষণ ভাবে দরকার মানব সভ্যতার ইতিহাসে একমাত্র নৃত্য হচ্ছে সব থেকে প্রাচীন মাধ্যম , যার মাধ্যমে মানুষ মানুষের মনের ভাবকে আনন্দ হেতু তুলে ধরতে পেরেছিল । একথা বলতে দ্বিধা নেই যে মানুষ যখন নির্বাক যুগে কালের আধারে নিমজ্জিত ছিল তখনও নৃত্য ছিল ।।

*****

আত্মারা যখন অন্য গ্রহে

১ রা তটা এখন বেশ গভীর । টুক করে শব্দ হতেই কান সজাগ হয়ে উঠলো অ্যাটলাসের । মাথার মধ্যে টিঁ টিঁ কী বেশ ক্যাল্কুলেশন করেই এগিয়ে গেল দরজার ...