Monday 16 January 2017

পূজিতা ও লাঞ্ছিতা এক মেয়ে নদী এবং দেবী সরস্বতী


Maa Saraswati Devi Paintingহিন্দুদের বারোমাসের তেরো পার্বণের মত প্রায় তেত্রিশ কোটি দেব-দেবীকে নিয়মিত নানা আকারে তথা নানা ভাবে পুজো করে থাকি । তা সে যাই করুক তা নিয়ে বর্তমানের আলোচ্য প্রবন্ধটি নয় । এখানে উঠে এসেছে এক মেয়ের জীবন গাঁথা । সময়ান্তরে সে কখনো লাস্যময়ী আবার কোন না কোন ভাবে হয়েছেন দেবতার দ্বারা লালসার শীকার । বর্তমানে , আমরা নানা ভাবে দেখি নারী নির্যাতন , প্রতিবাদ করি । কিন্তু ভাব্লে আবাক হই , হিন্দু শাস্ত্রেও নারী জত না পূজিতা হয়েছেন , তার থেকেও বেশী দগ্ধ হয়েছেন আদিম রিপু কামনার বহ্নিশিখায় ।
নানা পুরাণ , উপপুরাণ , লোক মান্যতা ঘেঁটে সেই দেবীর জীবন কথাকে লিপিবদ্ধ করা হল । আমাদের প্রায় সকলেরই পরিচিত শ্বেত শুভ্রা বীণাপাণির আলেখ্য । বহমানতা থেকে পূজিতা ।
নানা পূরান মতে বর্ণনা
স্কন্দপুরাণে
ব্রহ্মা তাঁর কন্যা সরস্বতীর প্রতি দুর্ব্যবহার করলে শিব তাঁকে শরবিদ্ধ করে হত্যা করেন। তখন ব্রহ্মার পত্নী গায়ত্রী কন্যা সরস্বতীকে নিয়ে স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে আনার জন্য গন্ধমাদন পর্বতে তপস্যা শুরু করেন। তাঁদের দীর্ঘ তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে শিব ব্রহ্মার প্রাণ ফিরিয়ে দেন। সেই থেকে শিবের নির্দেশে গায়ত্রী ও সরস্বতীর তপস্যাস্থলে দুটি প্রসিদ্ধ তীর্থ সৃষ্টি হয়।
জগতে সকল দেবতা তীর্থ আছে, শুধু ব্রহ্মার তীর্থ নেই একথা ভেবে ব্রহ্মা পৃথিবীতে নিজের তীর্থ স্থাপনে উদ্যোগী হলেন। তিনি একটি সর্বরত্নময়ী শিলা পৃথিবীতে নিক্ষেপ করলেন। সেটি চমৎকারপুরে এসে পড়ল। ব্রহ্মা সেখানেই নিজের তীর্থ স্থাপন করবেন বলে ভাবলেন। ব্রহ্মার নির্দেশে সরস্বতী পাতাল থেকে উঠে এলেন। ব্রহ্মা তাঁকে বললেন, “তুমি এখানে আমার কাছে সব সময় থাকো। আমি তোমার জলে ত্রিসন্ধ্যা তর্পণ করব।সরস্বতী ভয় পেয়ে বললেন, “আমি লোকের স্পর্শ ভয় পাই বলে সব সময় পাতালে থাকি। কিন্তু আপনার আদেশ আমি অমান্যও করতে পারি না। আপনি সব দিক বিচার করে একটি ব্যবস্থা করুন।তখন ব্রহ্মা সরস্বতীর অবস্থানের জন্য একটি হ্রদ খনন করলেন। সরস্বতী সেই হ্রদে অবস্থান করতে লাগলেন। ব্রহ্মা ভয়ংকর সাপেদের সেই হ্রদ ও সরস্বতীর রক্ষক নিযুক্ত করলেন।
(
দেবীভাগবত পুরাণ )
দেবীভাগবত পুরাণ অনুসারে, দেবী আদ্যাপ্রকৃতির তৃতীয় অংশে দেবী সরস্বতীর জন্ম। তিনি কৃষ্ণের জিহ্বাগ্র থেকে উৎপন্ন হয়েছেন। সরস্বতী বাক্য, বুদ্ধি, বিদ্যা ও জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী; সকল সংশয় ছেদকারিণী ও সর্বসিদ্ধিপ্রদায়িনী এবং বিশ্বের উপজীবিকা স্বরূপিনী। ব্রহ্মা প্রথম তাঁকে পূজা করেন। পরে জগতে তাঁর পূজা প্রতিষ্ঠিত হয়। সরস্বতী শুক্লবর্ণা, পীতবস্ত্রধারিণী এবং বীণা ও পুস্তকহস্তা। তিনি নারায়ণের অন্যতম পত্নী হয়েছিলেন। তারপর কৃষ্ণ জগতে তাঁর পূজা প্রবর্তন করেন মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে তাঁর পূজা হয়।
গঙ্গা, লক্ষ্মী ও সরস্বতী ছিলেন নারায়ণের তিন পত্নী। একবার গঙ্গা ও নারায়ণ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসলে, তিন দেবীর মধ্যে তুমুল বিবাদ উপস্থিত হয়। এই বিবাদের পরিণামে একে অপরকে অভিশাপ দেন। গঙ্গার অভিশাপে সরস্বতী নদীতে পরিণত হন। পরে নারায়ণ বিধান দেন যে, সরস্বতী এক অংশে নদী, এক অংশে ব্রহ্মার পত্নী ও এক অংশে তাঁর সঙ্গিনী হবেন এবং কলিযুগের পাঁচ হাজার বছর অতিক্রান্ত হলে সরস্বতী সহ তিন দেবীরই শাপমোচন হবে।
গঙ্গার অভিশাপে সরস্বতী মর্ত্যে নদী হলেনে এবং ব্রহ্মার প্রিয়তমা পত্নী ব্রাহ্মী হলেন।
শুম্ভ ও নিশুম্ভ অসুরদ্বয়কে বধ করার সময় দেবী দুর্গার শরীর থেকে যে কৌশিকী দেবীর উৎপত্তি হয়েছিল, তাঁর অপর নাম সরস্বতী।
শুক্ল যজুর্বেদ
"শুক্ল যজুর্বেদ" অনুসারে, একসময় ইন্দ্রের শরীরের শক্তি চলে যাওয়ার ফলে তিনি মেষ আকৃতি গ্রহণ করেন। সেসময় ইন্দ্রের চিকিৎসার দায়িত্ব ছিল স্বর্গের অশ্বিনীদ্বয়ের উপর এবং সেবা-শুশ্রুষার ভার ছিল সরস্বতীর হাতে। সংগীত ও নৃত্যপ্রেমী ইন্দ্র সরস্বতীর গানবাজনা ও সেবায় সুস্থ হওয়ার পর তাকে মেষটি দান করেন।
রামায়ণ রচয়িতা বাল্মীকি যখন ক্রৌঞ্চ হননের শোকে বিহবল হয়ে পড়েছিলেন, সে সময় জ্যোতির্ময়ী সরস্বতী তার ললাটে বিদ্যুৎ রেখার মত প্রকাশিত হয়েছিলেন।
সরস+বতী=সরস্বতী অর্থ জ্যোতিময়ী। ঋগ্বেদে এবং যর্জুবেদে অনেকবার ইড়া,ভারতী, সরস্বতীকে একসঙ্গে দেখা যায়। বেদের মন্ত্রগুলো পর্যালোচনায় প্রতীতী জন্মে যে, সরস্বতী মূলত সূর্যাগ্নি। 
ঋগ্বেদে বাগ্দেবী ত্রয়ীমূর্তি - ভূ: ভুব: স্ব:, জ্ঞানময়ীরূপে সর্বত্রব্যাপিনী। বিশ্বভূবন প্রকাশ তারই জ্যোতিতে। হৃদয়ে সে আলোকবর্তিকা যখন প্রজ্বলিত হয়, তখন জমাট বাধা অজ্ঞানতারূপ অন্ধকার যায় দূর হয়ে। অন্তরে, বাইরে সর্বত্র তখন জ্বলতে থাকে জ্ঞানের পুণ্য জ্যোতি। এই জ্যোতিজ্ঞানই ব্রহ্মজ্ঞান, এই জ্যোতিই সরস্বতী। আলোকময়ী, তাই তিনি সর্বশুক্লা। তিন গুণের মধ্যে তিনি সত্ত্বগুণময়ী, অনন্ত জ্ঞানময় ঈশ্বরের বাক্শক্তির প্রতীক বাগ্দেবী। গতিময় জ্ঞানের জন্যই ঋগ্বেদে তাঁকে নদীরূপা কল্পনা করা হয়েছে, যিনি প্রবাহরূপে কর্মের দ্বারা মহার্ণব বা অনন্ত সমুদ্রে মিলিত হয়েছেন। কল্যাণময়ী নদীতটে সাম গায়কেরা বেদমন্ত্র উচ্চারণে ও সাধনে নিমগ্ন হতো। তাদের কণ্ঠে উদ্গীত সাম সঙ্গীতের প্রতীকী বীণা দেবীর করকমলে। সরস্বতী বিধৌত ব্রহ্মাবর্ত ভূমি বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত আশ্রয় করে সাধনা করতে আশ্রমবাসী ঋষিগণ। সেই ভাবটি নিয়েই দেবী পুস্তক হস্তে', গ্রন্থ রচনার সহায়ক লেখনীটিও তাঁর সঙ্গে।
মার্কণ্ডেয় পুরাণে
শ্রীশ্রীচণ্ডী উত্তরলীলায় শুম্ভ নিশুম্ভ নামক অসুরদ্বয়কে বধ করার সময় দেবীর যে মূর্তির কল্পনা করা হয়েছিল তা ছিল মহাসরস্বতী। এ মূর্তি অষ্টভূজা - বাণ, কার্মূক, শঙ্খ, চক্র, হল, মুষল, শূল ও ঘন্টা ছিল তাঁর অস্ত্র। তাঁর এই সংহারলীলাতেও কিন্তু জ্ঞানের ভাবটি হানি ঘটেনি, কেননা তিনি একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়াকা মমাপরা' বলে মোহদুষ্ট শুম্ভকে অদ্বৈত জ্ঞান দান করেছিলেন।
স্কন্দ পুরাণে প্রভাসখণ্ডে দেবী সরস্বতীর নদীরূপে অবতরণের কাহিনী বর্ণিত আছে। বায়ু পুরাণ অনুযায়ী কল্পান্তে সমুদয় জগৎ রুদ্র কর্তৃক সংহৃত পুনর্বার প্রজাসৃষ্টির জন্য প্রজাপতি ব্রহ্মা নিজ অন্তর থেকেই দেবী সরস্বতীকে সৃষ্টি করেন। সরস্বতীকে আশ্রয় করেই ব্রহ্মার প্রজাসৃষ্টি সূচনা।
গরুড় পুরাণে সরস্বতী শক্তি অষ্টবিধা। শ্রদ্ধা, ঋদ্ধি, কলা, মেধা, তুষ্টি, পুষ্টি, প্রভা ও স্মৃতি। তন্ত্রে এই অষ্টশক্তি যথাক্রমে যোগ, সত্য, বিমল, জ্ঞান, বুদ্ধি, স্মৃতি, মেধা ও প্রজ্ঞা। তন্ত্র শাস্ত্রমতে সরস্বতী বাগীশ্বরী - অং থেকে ক্ষং পঞ্চাশটি বর্ণে তাঁর দেহ।
আবার পদ্মপুরাণ-এ উল্লিখিত সরস্বতীস্তোত্রম্-এ বর্ণিত হয়েছে -
শ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেতপুষ্পোপশোভিতা
শ্বেতাম্বরধরা নিত্যা শ্বেতগন্ধানুলেপনা
শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চিতা
শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কারভূষিতা
ইত্যাদি। এর অর্থ দেবী সরস্বতী শ্বেতপদ্মে আসীনা, শ্বেতপুষ্পে শোভিতা, শ্বেতবস্ত্র-পরিহিতা এবং শ্বেতগন্ধে অনুলিপ্তা। অধিকন্তু তাঁহার হস্তে শ্বেত রুদ্রাক্ষের মালা; তিনি শ্বেতচন্দনে চর্চিতা, শ্বেতবীণাধারিণী, শুভ্রবর্ণা এবং শ্বেত অলঙ্কারে ভূষিতা।
ভারতবর্ষে দেবী সরস্বতী বিদ্যা ও ললিতকলার দেবী হিসেবে পূজিত হচ্ছেন সেই আদিকাল থেকে। কিন্তু ভারতবর্ষের বাইরেও দেবী সরস্বতীর পূজা হয়ে থাকে। চীনে শস্যদেবী কুয়ানজিনের সঙ্গে দেবী সরস্বতীর তুলনা করা যেতে পারে। কেউ কেউ আবার মধ্যপ্রাচ্যের মাতৃকাদেবী ইসতার বা ইনান্নার সঙ্গে দেবী সরস্বতীর তুলনা করেছেন। গ্রিক দেবী এথেনির সঙ্গে দেবী সরস্বতীর সাদৃশ্য অনেকে কল্পনা করে থাকেন। আবার রোমের দেবী মিনার্ভার সঙ্গেও সাদৃশ্য আছে বলে মনে করা হয়। রোমের দেবী মিনার্ভা ও কেলটিক দেবী বিঘ্রিদের সঙ্গে প্রকৃতিগত দিক থেকে সরস্বতীর সাদৃশ্য রয়েছে ঠিকই, তবে এ দুই দেবীর সঙ্গে ভারতবর্ষীয় সরস্বতী দেবীর সম্পর্ক নির্ণয় করা সম্ভব নয়। কেবল জাপানের বিদ্যাদেবী বেনতেন যে ভারতবর্ষীয় সরস্বতী দেবীর বিদেশে আতিথ্য গ্রহণের সাক্ষ্য, এটুকুই নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
সরস্বতী কি দেবী ? তিনি কি নদী? নাকি গণিকামাত্র ?
ভৌগোলিক দিক থেকে নিশ্চিতভাবেই বলা যাবে কি সরস্বতী নদী শতদ্রু ও যমুনা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত ছিল ?অনুমান করা যায় যে বৈদিক সরস্বতী (আঞ্চলিক নাম সরসুতী) হরিয়ানার থানেশ্বর অঞ্চলে প্রবাহিত। ঋগ্বেদে (VIII, 36.6 সূক্ত) বলা হয়েছে সপ্তথি সরস্বতী নদীগুলির মাতা (সিন্ধুমাতা) একসাথে দুগ্ধ ও স্রোতস্বিনীদের নিয়ে বিপুল গর্জনে তীব্র স্রোতে প্রভূত জলধারায় স্ফীত হয়ে প্রবাহিত।
ঋগ্বেদে দুই ধরনের সরস্বতীর উল্লেখ আছে। একটি ত্রিলোক্য ব্যাপিনী সূর্যাগ্নি,অন্যটি নদী। সরস্‌ ধাতু তদুত্তরে অস্থর্থে বতু এবং স্ত্রী লিঙ্গে ঈপ্‌প্রত্যয় যোগে নিষ্পন্ন হয়েছে সরস্বতী-এ মত স্বামী নির্মলানন্দের।আলোকময়ী বলে সর্বশুক্লা।শংকরনাথ ভট্টাচার্যের মতে, সরস+বতী=সরস্বতী অর্থ জ্যোতিময়ী।ঋগ্বেদেএবং যর্জুবেদে অনেকবার ইড়া,ভারতী, সরস্বতীকে একসঙ্গে দেখা যায়।বেদেরমন্ত্রগুলো পর্যালোচনায় প্রতীতী জন্মে যে, সরস্বতী মূলত সূর্যাগ্নি।দেবীভাগবতে সরস্বতী জ্যোতিরূপা।ভৃগুপনিষদে জ্যোতির্ময়ী সরস্বতী ও জলময়ী সরস্বতীর সমীকরণ করা হয়েছে। এই উপনিষদে জলে জ্যোতি প্রতিষ্ঠিত,জ্যোতিতে জল প্রতিষ্ঠিত।কবি বিহারীলাল চক্রবতী সারদামঙ্গল কাব্যে জ্যোতির্ময়ী সরস্বতীর আবির্ভাব বর্ণনা করেছেন।রামায়ণরচয়িতা বাল্মীকি যখন ক্রৌঞ্চ হননের শোকে বিহবল হয়ে পড়েছিলেন,সে সময়জ্যোতির্ময়ী সরস্বতী তার ললাটে বিদ্যুৎ রেখার মত প্রকাশিত হয়েছিলেন।ঋগ্বেদেইন্দ্রের সঙ্গে সরস্বতীর সম্পর্ক যেমন ঘনিষ্ঠ তেমনি ঘনিষ্ঠ মরুদ ওঅশ্বিনীদ্বয়ের সঙ্গে। সরস্বতী কখনো ইন্দ্রের পত্নী আবার কখনো শত্রু, কখনো-বাইন্দ্রের চিকিৎসক।শুক্লযজুর্বেদে তিনি চিকিৎসক রুপে রুদ্র অশ্বিদ্বয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ততা।সরস্বতীর রোগ নিরাময় শক্তির কথা প্রবর্তী সময়েও জনশ্রুতিতে ছিল।কথা সরিৎসাগর’-এ সোমদেব (একাদশ শতক) জানিয়েছেন,পাটলিপুত্রের নারীরা রুগ্ন ব্যক্তির চিকিৎসার জন্য সরস্বতীর ঔষধ ব্যবহার করতেন।নিরুক্তকারযাস্কের মতে, সরস্বতী শব্দের অর্থ যাতে জল আছে। সৃ ধাতু নিস্পন্ন করে সরশব্দের অর্থ জলঅর্থাৎ যাতে জল আছে তাই সরস্বতী। নদী সরস্বতী আর্যভূমিরঅন্যতম নদীরূপে ঋগ্বেদে বহুবার কীতির্ত ও স্তোত হয়েছে। ঋগ্বেদে সরস্বতীসিন্দু ও তার পাঁচটি উপনদী নিয়ে সপ্তসিন্ধুর বারংবার উল্লেখ আর্যভূমিতেএদের অপরিসীম গুরুত্ব প্রমাণ করে।অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী’ – অর্থাৎ নদী হিসাবে সরস্বতীকে। সম্ভবত সরস্বতী নদীর তীরেই বৈদিক এবং ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির উদ্ভব। তাই হয়তো শিক্ষার সঙ্গে সরস্বতীর অচ্ছেদ্য বন্ধন এবং এর জন্যই পৌরাণিক যুগে সরস্বতী বিদ্যার দেবী হয়ে উঠেছেন। সরস্বতীর আর-এক নাম ভারতী। তিনি ব্রাহ্মণ’-এ বাক্ নামে পরিচিতা।দেবী সরস্বতীর সঙ্গে নদী সরস্বতীর এই একাত্মতা সম্পর্কে নানা মুনির নানা মত থাকলেও সরস্বতীকে ব্রহ্মার মানসকন্যা হিসাবে কল্পনা করা হয়।
হিন্দু পুরাণে বলা হয়েছে, ব্রহ্মা তাঁর কন্যার সঙ্গে যৌন সংসর্গে লিপ্ত হন। এহেন বিষয়ে কলকাতার জাদুঘরের একটি প্রস্তর মূর্তি থেকে তার যথেষ্ট প্রমাণ মেলে। এই মূর্তিটি ব্রহ্মার বামজানুর উপর সরস্বতী বসে আছেন, তাঁ এক হাতে ব্রহ্মার স্কন্ধবেষ্টিত।সরস্বতীর সঙ্গে ব্রহ্মার এই সম্বন্ধের সন্ধান ঋগ্বেদেও পাওয়া যায়। এখানে ব্রহ্মার সঙ্গে বাক্ দেবীর একটি ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ সূচিত হয়েছে। বাক্ই যে সরস্বতী তা নিয়ে তো কোনো দ্বিমত নেই। ব্রাহ্মণ যুগে এই সম্বন্ধ আরও ঘনিষ্ঠতর। এখানে দেখা যাচ্ছে প্রজাপতি ব্রহ্মা পুনরায় নিজেকে আপ্যায়িত করিলেন, বাক্ তাহার দিকে ফিরিয়া আসিলেন।তিনি বাক্-কে আত্মবশ করিলেন।এখানে তিনি বাক্য দ্বারা আপ্যায়িত হইলেন, বলবান হইলেনএইভাবেই বোধহয় আমরা সরস্বতীকে ব্রহ্মার স্ত্রী হিসাবে পাই।বেদের উষাই পরবর্তীতে সরস্বতী রূপে পাই।তাই উষার মতো সরস্বতীও শুভ্র এবং জ্ঞানের প্রতীক।সেই কারণে সরস্বতী একদিকে সূর্যের কন্যা ও অন্যদিকে স্ত্রী।
সরস্বতীর বাহন হাঁস ছাড়াও মেষ আর বরাহকে পাওয়া যায়।প্রত্নতাত্ত্বিক এন এস ভট্টসারি একটি লেখায় বলেছেন, “একসময় ইন্দ্রের শরীরের শক্তি চলে যাওয়ার ফলে তিনি মেষ আকৃতি গ্রহণ করেন।সেসময় ইন্দ্রের চিকিৎসার দায়িত্ব ছিল স্বর্গের অশ্বিনীদ্বয়ের উপর এবং সেবা-শুশ্রুষার ভার ছিল সরস্বতীর হাতে।সংগীত ও নৃত্যপ্রেমী ইন্দ্র সরস্বতীর গানবাজনা ও সেবায় সুস্থ হওয়ার পর তাকে মেষটি দান করেন।সেই থেকেই সরস্বতীর সঙ্গী এই মেষ।তাহলে কি সরস্বতী স্বর্গের সেবাদাসীও ! সরস্বতীর বাহন বরাহ (শুয়োর), কারণ তিনি নাকি বিষ্ণুরও স্ত্রী ছিলেন। অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ রচিত সরস্বতীগ্রন্থটিতে এ তথ্য পাওয়া যায়।শ্রীকৃষ্ণকেও স্বামী হিসাবে কামনা করেছিলেন তিনি – “ইয়েষ কৃষ্ণং কামেন কামুকী কামরূপিনীব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ’-এ শ্রীকৃষ্ণ-সরস্বতীর কেচ্ছাকাহিনি যথাযথভাবেই বর্ণিত আছে।ডঃ শ্যামল চক্রবর্তী নারীপ্রবন্ধে বলেছেন, সরস্বতী গণেশেরও স্ত্রী।মহারাষ্ট্রের কোনো কোনো পূজারী মনে করেন, গণেশের পত্নী সরস্বতী কিংবা সারদা।হয়তো সরস্বতী এবং গণেশ দুজনই বিদ্যা ও সংগীতের অধিষ্ঠাতা দেবতা বলেই এই পতি-পত্নীর কল্পভিত্তি।আর-এক তথ্য অনুসারে জানা যাচ্ছে, দুর্গার কন্যা এই সরস্বতী দুর্গার কুমারী সত্তা।আবার বাঙালিরা মনে করেন গণেশ ও সরস্বতী ভাইবোন, দুর্গার সন্তান।অথচ চিরকুমারী (!) সরস্বতীকে স্বর্গের দেবতারা কখনও স্ত্রী, কখনও সেবাদাসী, কখনও গণিকা, আবার কখনও অসুরদের রূপে ভুলিয়ে কাত করাবার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।
হিন্দুদের দেবী হওয়া সত্ত্বেও বৌদ্ধ ও জৈনদের কাছেও পুজো পেয়েছেন।গান্ধারের পাওয়া বীণাবাদিনী সরস্বতীর মূর্তি থেকে বা সারনাথে সংরক্ষিত মূর্তিতে এর প্রমাণ মেলে।পাথরের একটি ছোটো মূর্তি আছে তাতে সরস্বতী বীণা বাজাচ্ছেন, এর সঙ্গে হিন্দুদের সরস্বতীর কোনো পার্থক্য নেই।মথুরায় জৈনদের প্রাচীন কীর্তির আবিষ্কৃত নিদর্শনে সরস্বতীর যে মূর্তি পাওয়া গেছে সেখানে দেবী জানু উঁচু করে একটি চৌকো পীঠের উপর বসে আছেন, এক হাতে বই। শ্বেতাম্বরদের মধ্যে সরস্বতী পুজোর অনুমোদিত ছিল। জৈনদের ২৪ জন শাসনদেবীর মধ্যে সরস্বতী একজন এবং ১৬ জন বিদ্যাদেবীর মধ্যে অন্যতম হলেন সরস্বতী।শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর জৈন সম্প্রদায় উভয়েই সরস্বতীকে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম থেকে গৃহীত একজন প্রধান দেবীরূপে স্থান হয়ে গেল।
তবে উপপত্নী বা গণিকাদের লক্ষ্মীপুজো থেকে বঞ্চিত করা হলেও সরস্বতী পুজো করতে পারেন। সরস্বতী কেন ? সরস্বতী জায়গা কী তবে গণিকালয়ে ? তা না-হলে লক্ষ্মী নয় কেন ? দক্ষিণ ভারতে যে ময়ূরবাহন সরস্বতীর মূর্তি পাওয়া গেছে সেটা কৌমারীর সঙ্গে অনেকটা মিলজুল হয়।কৌমারী কার্তিকের পত্নী।তাই বোধহয় গণিকাদের দেবতা কার্তিকের পাশাপাশি সরস্বতীর পুজোও গণিকালয়ে হয়ে থাকে।যুগে যুগে ইতিহাসবিদরা জানিয়েছেন উপাসনালয় থেকে গণিকালয়-- সর্বত্র পুজো পায় সরস্বতী।সরস্বতী তাঁর কৌমার্য হারিয়েছে বহু পুরুষের বাহুডোরে।নেপালে চতুর্দশ শতকের পাওয়া শিলালিপিতে লেখা আছে – “সারদা তুমি মাতৃরূপী, তুমি কামমূর্তিতাই কি স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের উচ্চারণ করতে হয় – “ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারেতিব্বতে এমন অনেক সরস্বতী পাওয়া গেছে যাঁর উর্ধ্বাঙ্গে কোনো বসনই ছিল না। তাই হয়তো মকবুল ফিদা হোসেনের সরস্বতীর পরনে আব্রু নেই ! সরস্বতী, লক্ষ্মী, কার্তিক,গণেশ এরা কেউ কারোর ভাই-বোন নয়,এটা বাঙালিদের মন গড়া রূপকল্প। ভিত্তিনেই,সমর্থনও নেই।
আদি পুরাণ বলছে, সরস্বতী ব্রহ্মার মুখজাত। মুখজাত এরর্থ জ্ঞান। মুখ নিঃসৃত কথাই তো বেদ। ফলে ব্রহ্মার মুখজাত সৃষ্টি সরস্বতী জ্ঞানেরই। আবার শিবপুরাণ তো অন্য কথা বলছে কী বলছে ? বলছে ব্রহ্মা কামপরবশ হয়ে সরস্বতীর পিছনে পিছনে গিয়েছিলেন ছেলেদের বাধায় ব্রহ্মা দেহত্যাগ করেছিলেন।এখানেই আছে ব্রহ্মার এই কুপ্রস্তাবে সরস্বতী ব্রহ্মাকে অভিশাপ দেন,ফলে তার একটি মাথা খসে পড়ে। সেই থেকে ব্রহ্মা চতুরানন।ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণেও সরস্বতী বিষ্ণুর মুখজাত,কিন্তু ব্রহ্মার স্ত্রী। বিষ্ণু ব্রহ্মাকে গোলকে পাঠাচ্ছেন। প্রকৃতির অংশরূপী ভারতীকে সেখানে মানে গোলকে দেখতে পাবেন এবং তাকে দেখার পর তার সঙ্গে যৌন মিলনে ব্যস্ত হবেন। এও আছে ব্রহ্মা ভারতীর সঙ্গে রতিক্রিয়া করেছেন স্থানে স্থানে নির্জনে নির্জনে যিনি ভারতী, তিনিই সরস্বতী।
শুধুবৈদিক যুগে নয় পরবর্তীকালে মহাভারত, পুরাণ, কাব্যে পূতসলিলা সরস্বতীর মহিমা বর্ণিত হয়েছে। সরস্বতী নদীর উৎপত্তিস্থল ছিল হিমালয়ের সিমুরপর্বতে, এখান থেকে পাঞ্জাবের আম্বালা জেলার আদবদ্রী নামক স্থানে সমভূমিতেঅবতরণ করেছিল। যে প্রসবণ থেকে এই নদীর উৎপত্তি তা ছিল প্লক্ষ্ণা বৃক্ষের নিকটে, তাই একে বলা হতো প্লক্ষ্ণাবতরণ। এতি হিন্দুদের তীর্থস্থান।ঋগ্বেদের যুগে গঙ্গা যমুনা ছিল অপ্রধান নদী, পক্ষান্তরে সরস্বতী নদী ছিল সর্বপ্রধান ও সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয়। এর তীরে ছিল প্রসিদ্ধ তীর্থভূমি।সরস্বতীও দৃষদ্বতীর মধ্যস্থান দেবনির্মিত স্থান হিসেবে বিবেচ্য হত। ব্রাহ্মণ ও মহাভারতে উল্লেখিত সারস্বত যজ্ঞ এই নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হত।মহাভারত রচনা হওয়ার আগেই রাজপুতনার মরূভূমিতে সরস্বতী নদী অদৃশ্য হয়ে গেলেওকয়েকটি স্রোতধারা অবশিষ্ট ছিল। এই স্রোতধারা হল চমসোদ্ভেদ, শিবোদ্ভেদ ওনাগোদ্ভেদ। রাজস্থানের মরূভূমির বালির মধ্যে চলুর গ্রামের নিকটে সরস্বতীঅদৃশ্য হয়ে ভবানীপুরে দৃশ্য হয়। আবার বলিচ্ছপুর নামকস্থানে অদৃশ্য হয়ে বরখের নামক স্থানে দৃশ্য হয়।তান্ডমহাব্রাহ্মণে সরস্বতী নদীর উৎপত্তিস্থল হিসাবে প্লক্ষ্ণপ্রস্রবণ ও বিনাশস্থল হিসেবে বিনশনের নামোল্লেখ আছে। ভারতের বর্তমান উদয়পুর,মেওয়াড় ও রাজপুতনার পশ্চিমপ্রান্তে মরূ অঞ্চলে সিরসা অতিক্রম করে ভূটানের মরূভূমিতে সরস্বতীর বিলোপস্থানই বিনশন। লাট্যায়ণেরশ্রৌত সূত্র মতে, “সরস্বতী নামক নদী পশ্চিম মুখে প্রবাহিত,তার প্রথম ও শেষভাগ সকলের প্রত্যক্ষ গোচর, মধ্যভাগ ভূমিতে নিমগ্ন হয়ে প্রবাহিত, সে অংশকেউ দেখতে পায় না,তাকেই বিনশন বলা হয়অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের মতে, বৈদিক সরস্বতীর লুপ্তাবশেষ আজও কচ্ছ ও দ্বারকার কাছে সমুদ্রের খাড়িতে গিয়ে মিলিত হয়েছে। সরস্বতী নদীর বিনাশ ঘটেছিল অবশ্যই বৈদিক যুগের শেষভাগে। আচার্য যোগেশচন্দ্র রায়ের মতে, খ্রিস্টের দেড় হাজার বছরেরও আগে।মহাভারতে আছে যে নিষাদদের চোখের আড়ালে থাকার জন্য বিনাশণ নামক স্থানে মরুভূমিতে অদৃশ্য হয়েছে।নদীর স্থানীয় নামই এই ঐতিহ্য বহন করছে।অনেকেই বলেন, সিন্ধুনদই সরস্বতী।সরস্বতী ও সিন্ধু দুটি শব্দের অর্থই নদী।
সরস্বতী পূজা হিন্দু বিদ্যা ও সঙ্গীতের দেবী সরস্বতীর আরাধনাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠেয় একটি অন্যতম প্রধান হিন্দু উৎসব। পুরোহিত দর্পণ(শাস্ত্রীয় বিধান ?)অনুসারে মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজা আয়োজিত হয়। তিথিটি শ্রীপঞ্চমী বা বসন্ত পঞ্চমী নামেও পরিচিত। উত্তর ভারত, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, নেপাল ও বাংলাদেশে সরস্বতী পূজা উপলক্ষ্যে বিশেষ উৎসাহ উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়। শ্রীপঞ্চমীর দিন অতি প্রত্যুষে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ছাত্রছাত্রীদের গৃহ ও সর্বজনীন পূজামণ্ডপে দেবী সরস্বতীর পূজা করা হয়। ধর্মপ্রাণ হিন্দু পরিবারে এই দিন শিশুদের হাতেখড়ি, ব্রাহ্মণভোজন ও পিতৃতর্পণের প্রথাও প্রচলিত। পূজার দিন সন্ধ্যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সর্বজনীন পূজামণ্ডপগুলিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও আয়োজিত হয়। পূজার পরের দিনটি শীতলষষ্ঠী নামে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে কোনো কোনো হিন্দু পরিবারে সরস্বতী পূজার পরদিন অরন্ধন পালনের প্রথা রয়েছে।
নদী সরস্বতী বৈদিক সাহিত্য থেকে পুরোপুরি বাগ্ দেবী হয়ে দাঁড়ান ব্রাহ্মণ গ্রন্থে।সরস্বতী বৈদিক দেবী হলেও সরস্বতী পূজা বর্তমান রূপটি আধুনিক কালে প্রচলিত হয়েছে। তবে প্রাচীন কালে তান্ত্রিক সাধকেরা সরস্বতী-সদৃশ দেবী বাগেশ্বরীর পূজা করতেন বলে জানা যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাঠশালায় প্রতি মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে ধোয়া চৌকির উপর তালপাতার তাড়ি ও দোয়াতকলম রেখে পূজা করার প্রথা ছিল। শ্রীপঞ্চমী তিথিতে ছাত্রেরা বাড়িতে বাংলা বা সংস্কৃত গ্রন্থ, শ্লেট, দোয়াত ও কলমে সরস্বতী পূজা করত। ইংরেজি ম্লেচ্ছ ভাষা হওয়ায় সরস্বতী পূজার দিন ইংরেজি বইয়ের পূজা নিষিদ্ধ ছিল। গ্রামাঞ্চলে এই প্রথা বিংশ শতাব্দীতেও প্রচলিত ছিল। শহরে ধনাঢ্য ব্যক্তিরাই সরস্বতীর প্রতিমা নির্মাণ করে পূজা করতেন। বর্ধমান মহারাজার পূজায় বিশেষ সমারোহের আয়োজন করা হয়। দূর দুরান্ত থেকে মানুষ এই পূজার বিসর্জন দেখতে আসত। পূজা উপলক্ষে দুই ঘণ্টা আতসবাজিও পোড়ানো হত। আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পূজার প্রচলন হয় বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে সরস্বতী দেবী হলেও মেয়েরা অঞ্জলি দিতে পারত না।কিছু পণ্ডিতের মতে সমাজপতিরা ভয় পেতেন হয়তো এই সুযোগে ধর্মের নামে মেয়েরা দাবি করে বসেন লেখাপড়ার স্বাধীনতা !
শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে, শ্রীপঞ্চমীর দিন সকালেই সরস্বতী পূজা সম্পন্ন করা যায়। সরস্বতীর পূজা সাধারণ পূজার নিয়মানুসারেই হয়। তবে এই পূজায় কয়েকটি বিশেষ উপাচার বা সামগ্রীর প্রয়োজন হয়। যেমন অভ্র-আবীর, আমের মুকুল, দোয়াত-কলম ও যবের শিষ। পূজার জন্য বাসন্তী রঙের গাঁদা ফুলও প্রয়োজন হয়। লোকাচার অনুসারে, ছাত্রছাত্রীরা পূজার পূর্বে কুল ভক্ষণ করেন না। পূজার দিন কিছু লেখাও নিষিদ্ধ। যথাবিহিত পূজার পর লক্ষ্মী, নারায়ণ,লেখনী-মস্যাধার (দোয়াত-কলম), পুস্তক ও বাদ্যযন্ত্রেরও পূজা করার প্রথা প্রচলিত আছে। পূজান্তে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার প্রথাটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের দল বেঁধে অঞ্জলি দিতে দেখা যায়।
কেউ কেউ বলেন, মর্ত্য ধামে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে প্রথম বারের মতো শ্রীশ্রী সরস্বতী দেবী পূজার প্রচলন করেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর শৈশব কাল থেকেই সরস্বতী পূজা প্রচলন করে সমগ্র পৃথিবীর শিক্ষার্থীদের সরস্বতী পূজার গুরুত্ববহ বিদ্যার্জন ও বিদ্যালয় সমূহে সরস্বতী পূজার প্রচলন করে গেছেন, যা এখনও পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলিত রয়েছে। সরস্বতী পূজা স্বর্গমর্ত্যে, উভয়লোকে দেবতা, গন্ধর্ব, কিন্নর, ঋষি, মহর্ষি, রাজা-প্রজা সবাই শ্রদ্ধার সাথে করে আসছে। সরস্বতী পূজার অঞ্জলী দেয়ার সময় পলাশ ফুলের ব্যবহার ভগবান শ্রীকৃষ্ণই প্রচলন করেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বয়স তখন ৭ বছর।
পুষ্পাঞ্জলী মন্ত্রঃওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।বীনারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে।।নমঃভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ। বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত-বিদ্যা-স্থানেভ্য এব চ।।এস স-চন্দন পুষ্পবিল্ব পত্রাঞ্জলি সরস্বতৈ নমঃ।।প্রণাম মন্ত্রঃনমো সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে।বিশ্বরূপে বিশালাক্ষ্মী বিদ্যাংদেহি নমোহস্তুতে।।জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।বীণারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে।।সরস্বতীর স্তবঃশ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেত পুষ্পোপশোভিতা।শ্বেতাম্ভরধরা নিত্যা শ্বেতাগন্ধানুলেপনা।।শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চ্চিতা।শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কারব‌ভূষিতাবন্দিতা সিদ্ধগন্ধর্ব্বৈর্চ্চিতা দেবদানবৈঃ।পূঝিতা মুনিভি: সর্ব্বৈঋষিভিঃ স্তূয়তে সদা।।স্তোত্রেণানেন তাং দেবীং জগদ্ধাত্রীং সরস্বতীম্।যে স্মরতি ত্রিসন্ধ্যায়ং সর্ব্বাং বিদ্যাং লভন্তি তে।।
নদী সরস্বতীর মহিমা ভারতবাসীর মনে এত রেখাপাত করেছিল যে পরবর্তীকালে গঙ্গাসরস্বতীর স্থান দখল করলেও তারা তাকে ভুলতে পারেনি। প্রয়োগে অন্তঃসলিলারূপেগুপ্তভাবে গঙ্গা-যমুনার সঙ্গে সরস্বতীর সঙ্গম, পশ্চিমবঙ্গে হুগলি জেলারত্রিবেণীতে গঙ্গার স্রোত ধারা থেকে সরস্বতীর মুক্তি হিন্দুদের প্রিয় ওপবিত্র বিশ্বাস। সরস্বতী নিয়ে নানা ব্যাখ্যা নানা বিশ্লেষণ প্রচলিত আছে।তাই সঠিক সিদ্ধান্তে যাওয়ার চেষ্টা করা বৃথা, তবে অসম্ভব নয়।
উপসংহারে একটা বলতে চাই, সরস্বতী মূলত হিন্দুদের দেবী।হিন্দুদের উপাস্য।খ্রিস্টান, মুসলমান, শিখ এবং অন্য কোনো ধর্মাবলম্বীদের দেবী নয়।স্কুল-কলেজে সরস্বতী পুজোর আয়োজন করা শুধু অশোভনীয়ই নয়, অন্যায়।ভারতবর্ষ কোনো হিন্দু রাষ্ট্র নয়, এটি একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র।ভারতবর্ষের কোনায় কোনায় স্কুল-কলেজগুলিতে শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছাত্রছাত্রীরাই পাঠ নেন না, পাঠ নেয় সব ধর্মের ছাত্রছাত্রীরা।অন্য ধর্মের ছাত্রছাত্রীদের ভিন্ন ধর্মের সরস্বতী বন্দনা চাপিয়ে দেওয়া অসাংবিধানিক।যদি জোর করে সরস্বতী-বন্দনা চাপিয়ে হয়, তবে তা হবে সাংবিধানিক অধিকার হরণের সামিল।সরকারি কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় পুজোর কোনো নিয়ম নেই, তবু বিদ্যার দেবী হিসাবে সরস্বতী স্কুল, পাঠশালা কিংবা কলেজে পুজো পেয়ে থাকে।হিন্দু ধ্বজাধারী কোনো স্কুল-কলেজে পুজো-পার্বণ হতেই পারে, তাই বলে সর্বসাধারণের স্কুল-কলেজগুলিতে এই পুজো কতটা প্রাসঙ্গিক, প্রশ্ন উঠতে পারে ।ভেবে দেখতে বলব সবাইকে ।
বৃহস্পতি হচ্ছেন জ্ঞানের দেবতা, বৃহস্পতি পত্নী সরস্বতীও জ্ঞানের দেবী। সরস্বতী নদীর তীরে যজ্ঞের আগুন জ্বেলে সেখানেই ঋষি লাভ করেছিলেন বেদ বা ঋগমন্ত্র। সুতরাং সরস্বতী জ্ঞানের দেবী হিসেবেই পরিচিত হয়েছিলেন এ ধরাতে। কালের বিবর্তনে সরস্বতী তাঁর অন্য বৈশিষ্ট্যগুলো হারিয়ে কেবল বিদ্যাদেবী অর্থাৎ জ্ঞান ও ললিতকলার দেবীতে পরিণত হলেন। সরস্বতী জ্ঞান, সংগীত ও শিল্পকলার দেবী। ঋগবেদে তিনি বৈদিক সরস্বতী নদীর অভিন্ন এক রূপ। পণ্ডিতরা অনেকেই মনে করেন যে সরস্বতী প্রথমে ছিলেন নদী পরে হলেন দেবী। এ বিষয়ে রমেশচন্দ্র দত্ত লিখেছেন, ‘আর্য্যাবর্তে সরস্বতী নামে যে নদী আছে তাই প্রথমে দেবী বলে পূজিত হয়েছিলেন। বর্তমানে গঙ্গা যেমন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপাস্য দেবী হিসেবে পূজা পেয়ে থাকেন তেমনি সরস্বতী হলেন জ্ঞানের দেবী। সরস্বতীর প্রকৃত তাৎপর্য নিহিত রয়েছে সূর্যাগ্নির জ্যোতিতে। সূর্যাগ্নির তেজ, তাপ ও চৈতন্যরূপে জীবদেহে বিরাজ করায় চেতনা ও জ্ঞানের দেবী সরস্বতী। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে গোলোকে বিষ্ণুর তিন পত্নী লক্ষ্মী, সরস্বতী ও গঙ্গার মধ্যে বিবাদের ফলে গঙ্গার অভিশাপে সরস্বতীর নদী রূপ পাওয়াই হচ্ছে সরস্বতীর পৃথিবীতে দেবীরূপে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার তত্ত্ব।
বর্তমানে সরস্বতীর বাহন হাঁস। পণ্ডিত কলহনের মতে, সরস্বতী দেবী হংসের রূপ ধারণ করে ভেড়গিরি শৃঙ্গে দেখা দিয়েছিলেন। এ ধরনের ধারণা সঙ্গত কারণ হংসবাহনা সরস্বতীর মূর্তি তো প্রচুর পাওয়া যায়। তিনি এ বাহন ব্রহ্মার কাছ থেকে পেয়েছিলেন কিন্তু ব্রহ্মা বা সরস্বতী দেবীর বাহন কিন্তু পাখি নয়। বেদে এবং উপনিষদে হংস শব্দের অর্থ সূর্য। সূর্যে সৃজনী শক্তির বিগ্রহাম্বিতরূপ ব্রহ্মা এবং সূর্যাগ্নির গতিশীল কিরণরূপা ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব শক্তি সরস্বতী দেবীর বাহন হয়েছেন হংস বা সূর্য একেবারেই যুক্তিসঙ্গত কারণে। তবে বৈদিক সাক্ষ্য থেকেই জানা যায় সিংহ ও মেষ সরস্বতী দেবীর আদি বাহন ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেবী দুর্গা সরস্বতী দেবীর কাছ থেকে সিংহ কেড়ে নিলেন আর কার্ত্তিক কেড়ে নিলেন ময়ূর। পরবর্তী সময়ে সরস্বতী দেবী হংসকেই তাঁর চিরস্থায়ী বাহনের মর্যাদা দিলেন। আর সরস্বতীর এ বাহন সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয় জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে সর্বত্রই তাঁর সমান গতি ঠিক যেমনভাবে জ্ঞানময় পরমাত্মা সব জায়গায় বিদ্যমান। মজার ব্যাপার হলো হংস জল ও দুধের পার্থক্য করতে সক্ষম। জল ও দুধ মিশ্রিত থাকলে হাঁস শুধু সারবস্তু দুধ বা ক্ষীরটুকু গ্রহণ করে আর জল পড়ে থাকে। জ্ঞান সাধনায় হাঁসের এ স্বভাব যথেষ্ঠ তাৎপর্য বহন করে। তাই বিদ্যাদেবীর বাহন হিসেবে হাঁসকে খুব ভালোই মানায়।
হাতে বীণা ধারণ করেছেন বলেই তাঁর অপর নাম বীণাপাণি। বীণার সুর মধুর। পূজার্থী বা বিদ্যার্থীর মুখ নিঃসৃত বাক্যও যেন মধুর হয় এবং জীবনও মধুর সংগীতময় হয় এ কারণেই মায়ের হাতে বীণা।
হিন্দুদের দেবী হয়েও বৌদ্ধ বা জৈনদের কাছ থেকেও পূজা পেয়েছেন সরস্বতী। অনেক বৌদ্ধবিহারেও সরস্বতীর মূর্তি পাওয়া যায়। জৈনদের ২৪ জন শাসনদেবীর মধ্যে সরস্বতী একজন এবং ষোলজন বিদ্যাদেবীর মধ্যে অনন্যা মা সরস্বতী। সরস্বতী নদীর তীরেই বৈদিক এবং ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির উদ্ভব। শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে শ্রীপঞ্চমীর দিন সকালেই সরস্বতী পূজা সম্পন্ন হয় ।
সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা ধ্যানে বসেছিলেন। ব্রহ্মার কপাল থেকে নির্গত হয়েছেন দেবী সরস্বতী। অপরূপ সুন্দর বললেও কম বলা হয় এমনই তাঁর সৌন্দর্য। চোখ মেলে তাকালেন ব্রহ্মা। প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়লেন তিনি দেবী সরস্বতীর। কামনা করে বসলেন দেবীকে। হায় পুরুষ, হলেনই বা তিনি দেবতাযুগে যুগে নারী যে তার কামনার ধন। নারীর সত্তাকে কোনও দিন বোঝার চেষ্টা করেছে সে? দেবী সরস্বতী ব্রহ্মার শরীরসঞ্জাতসেই অর্থে দেবী তাঁর মানসপুত্রী আর সেই দেবীকেই কিনা অঙ্কশায়িনী করতে চান তিনি। তীব্র বিরোধিতায় দেবীর মুখমণ্ডল আরক্ত হয়ে উঠল। দেবী পালাতে চাইলেন ব্রহ্মার কামপূর্ণ দৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য। কিন্তু যে দিকেই দেবী গমন করেছেন, সে দিকেই ব্রহ্মার একটি করে মস্তক সৃষ্টি হয়েছে। সরস্বতীর দিক থেকে এক বারের জন্যও দৃষ্টি সরাননি তিনি। এমনকী দেবী ওপরে গমন করলেও ঊর্ধ্বেও আর একটি মস্তক তৈরি হয়েছে দেবীকে চোখের আড়াল না করার নিমিত্ত। অবশেষে সফল হয়েছেন ব্রহ্মা। সরস্বতীকে বিবাহ করেছেন তিনি দেবীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও। দেবীর প্রভাকে ছাপিয়ে গিয়েছে ব্রহ্মার কামনা।
ঋগ্বেদের অধিকাংশ স্থলেই সরস্বতী শব্দ সিন্ধু নদ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে | আবার কোনও কোনও স্থলে মধ্যদেশস্থ দেবনদী অর্থেও এর প্রয়োগ আমরা দেখতে পাই | পৃথা, ইন্দ্র, অশ্বিন ও মরুদর্পণের সঙ্গে দেবী রূপে ইনি উল্লিখিত হয়েছেন | ব্রাহ্মণে সরস্বতী বাকরূপে এবং পরবর্তীকালে বাক্যের অধিষ্ঠাত্রী রূপে বর্ণিত হয়েছেন | ষোড়শঋকে সরস্বতী মাতৃগণের, নদীগণের ও দেব গণের শ্রেষ্ঠা বলে বর্ণিত হয়েছেন | ইনি ব্রহ্মাবর্তের একতর সীমা এবং কুরুক্ষেত্রে অন্তড়িত হয়ে প্রয়াগে গঙ্গা যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়েছেন | তাই পরবর্তী বৈদিক যুগে নদীদেবতা হিসাবে মাহাত্ম্য হারিয়ে ইনি সাহিত্য, শিল্প ও সঙ্গীতকলার দেবী হিসাবে পরিচিতা হন | সরস্বতী শব্দের ব্যুৎপত্তি হল সরস + বতুপ + স্ত্রীপ (স্ত্রীলিঙ্গে) | সরস শব্দের অর্থ হল তড়াপ, জলাশয় ইত্য়াদি | এ থেকে বোঝা যায় আর্যরা এদেশে এসে সিন্ধু নদের তীরে বসবাসকালে কৃষির প্রধান ভরসা বা আশ্রয়স্থল হিসাবে সরস্বতীকে দেবী জ্ঞানে পূজা করত | তাই প্রথম দিকে তাঁকে কৃষির দেবতা হিসাবে যে গণ্য করা হত সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে না | যাই হোক, শাস্ত্রে আমরা অনেকরকম সরস্বতীর পরিচয় পাই |
মহা সরস্বতী দেবী মাহাত্ম্য অনুসারে ইনি মহা কালী, মহা লক্ষ্মী ও মহা সরস্বতীর মিলিত রূপ | অষ্টভুজা এই দেবী শ্বেতপদ্মাসনা ও বীণাবাদনরতা | ঘণ্টা, ত্রিশূল, লাঙ্গলের ফলা, শাঁখ, মুষল, চাকতি, ধনুক ও তীর (শর) তাঁর হাতে ধরা | শারদ পূর্ণিমার চন্দ্রর মতো তাঁর দীপ্তি | গৌরীর শরীর থেকে তাঁর জন্ম এবং তিনি শুম্ভ ইত্যাদি অসুরদের বধকারিণী |
মহা বিদ্যা নীল সরস্বতী ইনি মহাবিদ্যা তারার আর এক রূপ | তন্ত্রসারে তাঁর ধ্যানমন্ত্র পাওয়া যায় | কথিত আছে বিদ্যাবতীর কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে বনের মধ্যে এক জলাশয়ে কালিদাস যখন প্রাণ বিসর্জন দিতে যান তখন নীল সরস্বতী আবির্ভূত হয়ে তাঁকে আত্মহত্যায় নিরস্ত্র করেন | এরপর কালিদাসের প্রার্থনায় তুষ্ট হয়ে তিনি কালিদাসের জিহ্বার অগ্রভাগে সদা বিরাজ করতে থাকেন | এরই ফলে মূর্খ কালিদাস হয়ে ওঠেন মহাপণ্ডিত |
আর আমরা সাধারণত যে দেবী সরস্বতীকে জানি তিনি চতুর্ভুজা, শ্বেত বস্ত্রাবৃত, শ্বেত পদ্মাসনা, যা পরম সত্যের প্রকাশক | ইনি ব্রহ্মার মুখ থেকে জন্মান | কিন্তু অনন্যসাধারণ সৌন্দর্যের অধিকারিণী এই দেবীকে দর্শনমাত্রই ব্রহ্মা তাঁর রূপে মোহিত হন ও তাঁকে বিবাহ করেন | স্বল্পালংকারা এই দেবী ত্রিভুবনের জ্ঞানদাত্রী | তাঁর চার হাত মন, বুদ্ধি, সচেতনতা ও অহমের দ্যোতক | অন্যভাবে বলা যায় তাঁর চার হাত চার বেদের প্রকাশক | এখানে বেদ বলতে তিন প্রকার সাহিত্য গদ্য, গদ্য ও সঙ্গীতকে বোঝানো হয়েছে | তাই তাঁর হাতের পুস্তক (পবিত্র বেদ) বিশ্বজনীন, স্বর্গীয় ও পরমসত্যের আধার | অক্ষসূত্রের মালা ধ্যান ও আধ্যাত্মিক শক্তির প্রকাশক | কাঁখে পবিত্র জলের ঘট সৃষ্টি ও পবিত্র শক্তির প্রতীক | আর বীণা কলা ও বিজ্ঞান জ্ঞানের প্রতীক |
পূর্ব ভারতে মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমীতে এই দেবীর পূজা হয় | দক্ষিণ ভারতে শরৎকালে নবরাত্রিতে তিনি পূজিত হন |
সাহিত্য ও কলাবিদ্যার দেবী বলে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ক্লাবে ধুমধাম করে তাঁর পূজা করা হয় | প্রায় প্রতিটি বাড়িতে এমন কি আজকাল পাড়ায় পাড়ায় অলিগলিতেও সরস্বতী পূজা করা হয় | সকালবেলা স্নান করে নতুন বা শুদ্ধ বস্ত্র পরে ছাত্রছাত্রীরা পূজা মন্ডপে হাজির হয় | এরপর পুরোহিত পূজা শুরু করেন | ক্রিয়া সমাপন কালে পুরোহিত দেবীর ধ্যান করেন
তরুণ শকল মিন্দোর্বিভ্রতী শুভ্রকান্তিঃ
কুচভর নমিতাঙ্গী সন্নিষণা মিতাব্জে |
নিজকর কমলোদ্যল্লেখনী পুস্তকশ্রীঃ
সকল বিভ বসিদ্ধ্যৈ পাতু বাগদেবতা নঃ
অর্থাৎ যিনি নতুন চন্দ্রকলা ধারণ করেছেন, যিনি শ্বেতবর্ণা,স্তনভারে যাঁর অঙ্গ নত হয়ে পড়েছে, যিনি শ্বেতপদ্মে উপবিষ্টা, যাঁর নিজ করকমলে লেখনী ও পুস্তক শোভা পাচ্ছে, সেই বাগদেবী সরস্বতী সমস্ত বিদ্যাধনলাভে অধিকারী করার জন্য আমাদের রক্ষা করুন |
এবারে পূজা সমাপ্ত হলে সকলে হাতে চন্দনমিশ্রিত পুষ্প ও বিল্বপত্র নিয়ে একসঙ্গে উচ্চারণ করে পুষ্পাঞ্জলি দেয়
যা কুন্দেন্দু তুষারহার ধবলা যা শ্বেত পদ্মাসনা
যা বীণা বরদস্ত মন্ডিত ভুজা যা শুভ্রবস্ত্রাবৃতা |
যা ব্রহ্মাচ্যুত শঙ্কর প্রভৃতিভি দেবৈঃ সদা বন্দিতা
সা মাং পাতু সরস্বতী ভগবতী নিঃশেষ্-জাভ্যাপন্থা
সা মে বসতু জিহ্বায়াং বীণাপুস্তকধারিণী |
সুরারিবল্লাভ দেবী সর্বশুক্লা সরস্বতী
সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে |
বিশ্বরূপে বিশালাক্ষি বিদ্যাং দেহি নমোহস্তুতে
অর্থাৎ যিনি কুন্দ পুষ্প, চন্দ্র ও তুষারমালা অর্থাৎ বরফরাশির ন্যায় শ্বেতবর্ণা, যিনি শ্বেতপদ্মে উপবিষ্টা, যাঁর হস্ত উত্তমবীণদন্ডে শোভিত, যিনি স্বেতবসনা, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ প্রভৃতি দেবগণ সর্বদা যাঁকে বন্দনা করেন এবং যিনি অশেষ মূর্খতা হরণ করেন সেই ভগবতী সরস্বতী আমাকে রক্ষা করুন | যিনি বীণা ও পুস্তকধারিণী, যাঁর সর্বাঙ্গ শ্বেতবর্ণ, সেই বিষ্ণুপত্নী সরস্বতী দেবী আমার জিহ্বায় অধিষ্ঠান করুন | হে অতুল ঐশ্বর্যশালিনী, বিদ্যাস্বরূপে, কমললোচনে, বিশ্বরূপে, বিশালনয়নে সরস্বতী আমাকে বিদ্যা দাও | তোমাকে প্রণাম করি |
এরপর হাতজোড় করে সকলে সমবেতভাবে প্রার্থনা মন্ত্র উচ্চারণ করে (সাধারণতঃ দেখা যায় অধিকাংশ পুরোহিত এই মন্ত্রটি পাঠ করান না)
যথা ন দেবো ভগবান ব্রহ্মা লোক-পিতামহঃ |
ত্বাং পরিত্যজ্য সন্ডিষ্ঠেৎ তথা ভব বরপ্রদা
বেদাঃ শাস্ত্রাণি সর্বাণি নৃত্যগীতাদিকঞ্চ যৎ |
ন বিহীনং ত্বয়া দেবে তথা মে সন্তু সিদ্ধয়ঃ
লক্ষ্মীমেধা ধরা পুষ্টি গৌরী তুষ্টিঃ প্রভা ধৃতিঃ |
এতাভিঃ পাহি তনুভিরন্টাভিমাং সরস্বতী
অর্থাৎ সর্বলোকের পিতামহ (মনুষ্যগণ যাঁর পুত্রসেই মনুর পিতা অথবা পিতৃলোকের পিতা বলিয়া) দেব ভগবান ব্রহ্মা তোমাকে পরিত্যাগ করে যেমন থাকতে পারেন না (অর্থাৎ তুমি যেমন কখনও তাঁকে ছেড়ে থাক না) আমার প্রতি সেরূপ বরদাত্রী হও | চার বেদ, সকল শাস্ত্র এবং নৃত্যগীতাদি যা কিছু আছে, তা তোমা ছাড়া নয় | হে দেবী, সেই সকল বিষয়ে আমার সিদ্ধি হোক | হে সরস্বতী, লক্ষ্মী, মেধা, ধরা, পুষ্টি, গৌরী, তুষ্টি,প্রভা ও ধৃতি এই আট মূর্তিতে আমাকে রক্ষা কর |
সবকলে নতমস্তকে প্রণাম মন্ত্র উচ্চারণ করে
ওঁ ভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈঃ নমো নমঃ |
বেদ-বেদান্ত-বেদাঙ্গ-বিদ্যাস্থানেভ্য এব চ
অর্থাৎ সরস্বতীকে বার বার প্রণাম করি | যিনি ভদ্রকালী অর্থাৎ মঙ্গলাবিধায়িনী, তাঁহাকে সর্বদা প্রণাম করি | বেদ, বেদান্ত, বেদাঙ্গাদি চতুর্দশ বিদ্যাস্থানকেও প্রণাম করি |
সরস্বতী ঠাকুরের গল্প
আর একদিন পরেই সরস্বতীপুজো। বাঙালির ঘরে ঘরে সারা বছর যে নানারকমের পালাপার্বণ লেগেই থাকে, তার মধ্যে অন্যতম এক অনুষ্ঠান। সরস্বতী পুজো আবার যত না বড়দের পুজো, তার থেকে অনেক বেশি ছোটদেরই পুজো। মা সরস্বতীকে আমরা বিদ্যার দেবী বলে জানি। সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের আশাভরসা তিনি, কারণ তিনি তুষ্ট থাকলেই ছাত্ররা ভালোভাবে পড়াশোনা করে পরীক্ষায় ভালো ফল করবে, এটাই বিশ্বাস। তাই বেশিরভাগ স্কুলে, অনেকের নিজেদের বাড়িতেই সবাই ধূমধাম করে সরস্বতী পূজা করে। আজকাল অবশ্য বারোয়ারীভাবেও পাড়ায় পাড়ায় সরস্বতী পুজো হয়ে থাকে।
মা সরস্বতীকে দেখতে কিরকম , জিজ্ঞাসা করলে সবাই প্রায় চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারবে- শ্বেতবরণ অঙ্গ, হাতে বীণা, বাহন রাজহাঁস,সাদা পদ্মফুলের আসন। ডানহাতে বরাভয় মুদ্রা -যেন বলছেন- ভয় নেই বাছা, ভয় নেই- মন দিয়ে অঞ্জলি দে, অঞ্জলি দেওয়ার আগে কিন্তু কুল খাসনা, আর পুজোর দিনে কিছুতেই পড়ার বই নিয়ে বসবি না- বছরভর পরীক্ষায় তোর ভাল রেজাল্ট নিশ্চিত ! শান্তশিষ্ট সরস্বতী ঠাকুরকে দেখে খুব একটা ভয়ও করে না, কিন্তুতিনি রেগে গেলে পড়াশোনা গোল্লায় যেতে পারে - কারণ আমরা সবাই জানি, তিনি বিদ্যা, জ্ঞান, সংস্কৃতি, কলার প্রতীক। কিন্তু জান কি - সরস্বতী এক সময়ে শুধুমাত্র বিদ্যার দেবী রূপেই পরিচিত ছিলেন না, তিনি ছিলেন জীবনদায়িনী নদীরূপে পরিচিত; সাথে ছিলেন অন্নদায়িনী, এমনকি শত্রুবিনাশিনী রূপেও পরিচিত ! এবছর পুজোর সকালে অঞ্জলি দেওয়ার আগে, এস জেনে নিই, সরস্বতী কিভাবে হয়ে উঠলেন হিন্দু ধর্মের জ্ঞানদায়িনী দেবী।
হয়তো শুনলে অবাক হই যে, মানুষ যখন দ্বিপদ প্রাণী হিসেবে প্রথম যাত্রা শুরু করল, তখন ধর্ম বা দেবদেবী কিছুই ছিল না। তোমার ইতিহাস বই-এর ভাষায় এ হল প্রস্তর যুগের কথা। তখন ছিল নিজেকে টিঁকিয়ে রাখার যুগ। তারপর মানুষ যত স্থিত হয়েছে, নিজেরাই খাদ্য, বস্ত্র তৈরী করে জীবন কিছুটা সহজ করতে পেরেছে, তাদের চারপাশ দেখার অবকাশ হল, তারা দেখল, প্রাত্যহিক জীবনে অনেক প্রাকৃতিক সহায়তা তারা পেয়ে থাকে। কখনও শ্রদ্ধায়, কখনও বা ভয়ে তারা নানা প্রাকৃতিক শক্তিকে মর্যাদা দিল। প্রকৃতির বিভিন্ন অংশ- জল , বায়ু, মাটি, আলো থেকে শুরু করে গাছ, ফুল, পশু, পাখিদের বিভিন্ন শক্তির প্রতীক রূপে আরাধনা করতে শুরু করল। ধীরে ধীরে সময়ের পথচলার সাথে সাথে এই সমস্ত আরাধ্য শক্তিগুলি চেহারা, চরিত্র এবং বৈশিষ্ট বদল হতে থাকে। এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে পরিচিত এবং উপাসিত হতে হতে বদলে যেতে থাকে তাঁদের চেহারা, বাহন, আসন এবং ক্ষমতা। বিশ্বের সমস্ত সভ্যতাতেই এই ধরণের বহু বহু উদাহরণ আছে। ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতা এবং হিন্দু ধর্মও এই বদল প্রক্রিয়ার বাইরে নয়। যদি অকারণ গোঁড়ামি আর বাজে ধর্মান্ধতাকে বাদ দিয়ে সেই সব বদলের কথা নিয়ে একটু পড়াশোনা কর, তাহলে দেখবে সভ্যতার বিবর্তনের সাথে সাথে ধর্মের এবং দেবদেবীদের ধারণার বিবর্তনও কিন্তু কম আকর্ষণীয় নয়!
হরপ্পা সভ্যতার পরবর্তী যুগে দীর্ঘ মরুভূমির পথ পেরিয়ে মানুষের যে দলটি পাঞ্জাবের বিস্তীর্ণ নদীবহুল অঞ্চলে এসে উপস্থিত হয়েছিল, তারা নিজেদের আর্য নামে অভিহিত করেছিল। নদী তাদের জীবনে সর্বরকম সহায়তা করে এতটাই স্বস্তি দিয়েছিল যে তারা আন্তরিকভাবেই এই নদীরূপা শক্তিকে বন্দনা করেছিল। এভাবেই বৈদিক সভ্যতার পত্তন হল, শুরু হল ঋষিদের মননসমৃদ্ধ বৈদিক ধর্মচিন্তার, যার ফসল হল ঋক্‌, সাম যজুঃ ও অথর্ব নামক বেদসমূহ।
যে কোন কাজেই শক্তি বা তেজের প্রয়োজন বা প্রয়োগ অবধার্য। খোলা চোখেই দেখা যায় সূর্য হল এই পৃথিবীর পক্ষে এক অফুরন্ত তেজের আধার। তাই স্বাভাবিকভাবেই সূর্য আমাদের প্রথম দেবতা। কিন্তু আমরা তো জানি, শুধু বাবাতে আমাদের মন ভরে না, মাকেও চাই। আসলে মায়ের আদরই তো আমরা প্রাণ ভরে উপভোগ করি। তাই একজন মাতৃরূপা দেবীরও আবশ্যক হল। যে বিশাল জলধারা মাতৃস্নেহে আর্যজাতিকে জীবনের সব ক্ষেত্রে লালন করেছিল, তিনিই তো হতে পারেন আমাদের প্রথম দেবী। এই দেবীর নাম হল সরস্বতী, কারণ সরস্‌ শব্দের অর্থ জল।
শুধু জলযুক্ত বলেই দেবীর নাম সরস্বতী তা নয়, বৈদিক যুগের প্রথমে পুণ্যসলিলা সরস্বতী প্রধানা এবং সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় নদী হিসেবেও গণ্যা ছিলেন। নদী হিসেবে গঙ্গা বা যমুনার প্রাধান্য তখনও স্বীকৃত হয়নি। সরস্বতীর উৎপত্তিস্থল হিমালয় অন্তর্গত সিমুর পর্বতে। চলার পথে তীরে তীরে প্রসিদ্ধ তীর্থক্ষেত্রের সমাহার। এর তীরে অনুষ্ঠিত যজ্ঞের নাম সারস্বত যজ্ঞ, নদীর জলে পিতৃতর্পণ বিহিত ছিল।
তবে নদীরূপা ছাড়াও ঋক্‌ বেদে সরস্বতীর আরেকটা পরিচয় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। সরস্‌ শব্দের আদি অর্থ জ্যোতি। সূর্যরশ্মির তিনটি রূপ ইরা, ভারতী ও সরস্বতীর একত্রিত রূপ হল সরস্বতী। ইনি ত্রিলোকের সর্বত্রব্যাপী সূর্যতেজের স্ত্রীশক্তি। ইনি স্বর্গ-মর্ত্যকে দীপ্তি দ্বারা ব্যাপ্ত করে বিরাজমান। বেদে জ্যোতিরূপা সরস্বতীর উদ্দেশ্যে অনেক শ্লোক উৎসর্গ করা হয়েছে। একটা অদ্ভুত কথা বলা হয়েছে যে জ্যোতির্ময়ী সরস্বতী কুব্জা ছিলেন। পণ্ডিতেরা মনে করেন, এই বর্ণনা একই সঙ্গে সূর্যতেজোময়ী সরস্বতী এবং নদীরূপা সরস্বতীর ইঙ্গিত দেয়। আলো যেমন এঁকেবেঁকে যেতে পারে, তেমনই নদীর স্রোতও আঁকাবাঁকাভাবেই চলে। আচার্য যোগেশচন্দ্র রায়ের মতে, আকাশের ছায়াপথ নামক অংশটিই হল দিব্য বা জ্যোতিরূপা সরস্বতী। কিন্তু এই মতকে সব পন্ডিতের মেনে নেন না।
দেবী সরস্বতীকে আমরা জানি শুধুমাত্র বিদ্যাদায়িনী হিসেবে। কিন্তু বৈদিক যুগে আরো অনেক গুণের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। 'প্রণো দেবী সরস্বতী বাজেভির্বাজিনীবতী' -- তিনি বাজিনীবতী অর্থাৎ অন্নদায়িনী। সূর্যকরের সাহায্যে জল মেঘরূপে বৃষ্টি হয়ে পৃথিবীতে ঝরে পড়ে। পৃথিবী শস্যশালিনী হয়। এভাবেই দেবী সরস্বতী কৃষি ও পশুবৃদ্ধির সহায়ক হয়ে অন্নদাত্রী হয়ে ওঠেন। ঋষিদের বারবার প্রার্থনা, সরস্বতী যেন তাঁদের ধন দান করেন। নদী সরস্বতীর জলে সিক্ত উর্বর মাটিতে আর্যদের কৃষিভিত্তিক সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল; নদীর জল তাঁদের বাণিজ্যিক সম্পদেও বৈভবশালী করেছিল। তাই দেবী হলেন ধনদাত্রী। পরবর্তী কালেও সরস্বতীর এই গুণের কথা মুছে যায়নি। তন্ত্রশাস্ত্রে দেবীর ধ্যানমন্ত্রে তাঁর কাছে ঐশ্বর্য প্রার্থনা করা হয়েছে।
তিনি দানবদলনী। যে ভৌগলিক সীমানার মধ্যে আর্যসভ্যতার বিকাশ, সেখানে নদী সরস্বতী প্রাকৃতিকভাবেই প্রহরীরূপে বিরাজিত ছিলেন। তাই আত্মরক্ষার জন্য আর্যরা সরস্বতীর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। পৌরাণিক যুগেও দেবীর এই শত্রুদলনী রূপটি বর্তমান ছিল। মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত শ্রীশ্রীচণ্ডীতে বলা হয়েছে 'সরস্বতীমনুভজে শুম্ভাদিদৈত্যার্দিনীম্‌।'
সূর্যের তেজোরূপা হবার দরুণ সূর্যের সমস্ত বৈশিষ্ট্যকে তাঁকেই দান করা হয়েছিল। শুধু তাই নয় যখন যে দেবতা প্রাধান্য পেয়েছেন, তখন তাঁর গুণগুলিও সরস্বতীতে আরোপ করার প্রবণতা দেখা যায়। তাই তিনি কখনও শত্রুদলনী, কখনও চিকিৎসকও বটে। এই কারণে তাঁকে সূর্য, ইন্দ্র, মরুৎ ও দেবচিকিৎসক অশ্বিনীকুমা্রদের স্ত্রী হিসেবেও উপস্থাপিত করা হয়েছে। পরবর্তী কালে তিনি ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর স্ত্রী বলে পরিচিতা হয়েছেন। ব্রহ্মা, পুরাণানুসারে বেদকে ধারণ করেছিলেনজ্ঞানের উৎস এই বেদ, তাই ব্রহ্মার সঙ্গে যুক্ত হলেন সরস্বতী বা সাবিত্রী। ত্রিদেব ধারণাতে বিষ্ণু ছিলেন প্রধান দেবতা, তাই প্রধানা দেবীকে তাঁর সঙ্গে জুড়ে দেওয়াটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলেই ধরা হয়েছে।
দেবী সরস্বতীকে আমরা সবচেয়ে বেশি জানি বিদ্যার দেবী বলে। পরবর্তী বৈদিক যুগে সরস্বতী অন্য পরিচয় মুছে কেবলমাত্র বাগদেবী হিসেবে স্বীকৃতা হলেন। অথর্ব বেদে ও ব্রাহ্মণে তিনি বাগ্‌রূপা। 'বাক্‌ হি সরস্বতী / বাক্‌ বৈ সরস্বতী।' তিনি যজ্ঞরূপাও। এই হিসেবে এখন থেকে তিনি ব্রহ্মা বা বৃহস্পতির স্ত্রী বলে মান্যা হলেন।
অন্য সমস্ত গুণ সত্ত্বেও পরবর্তী কালে শুধুমাত্র বাক্‌ বা বাণীদেবী হওয়াকে পণ্ডিতেরা খুব অস্বাভাবিক মনে করেন না। বাক্য সমস্ত জ্ঞানের উৎস, জ্ঞানলাভে অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর হয়। তমসাবিদূরক বলতে, প্রাকৃতিক ও মানসিক দুই অন্ধকারই দূরকারী বলে সূর্যকে বন্দনা করা হত। তাই সূর্য ও পরবর্তীকালে বৃহস্পতির স্ত্রী বলে সরস্বতীকে জ্ঞানদাত্রী বলে চিহ্নিত করা অসঙ্গত নয়। এছাড়াও, যেমন প্রথমে বলেছিলাম, এই নদীর তীরে আর্যদের সভ্যতার ক্রমবিকাশ। এখানেই ঋষিরা লাভ করেছিলেন বেদ, নদীর তীর মুখরিত থাকত সাম মন্ত্রের উচ্চারণে। শ্রীরমেশচন্দ্র দত্ত মনে করেন, প্রথমে নদী দেবী বলে পূজিতা হলেন। পরে নদীর তীরে বিবিধ জ্ঞানযজ্ঞ ক্রমান্বয়ে অনুষ্ঠিত হতে হতে এই নদীই বিদ্যাদেবী হলেন।
অবশ্য সূর্যের কিরণস্বরূপা জ্যোতির্ময়ী সরস্বতী যে নদী সরস্বতী হয়ে গেলেন, তার জন্য একটা সুন্দর গল্প ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে পাওয়া যায়। বিষ্ণুর তিন স্ত্রী - লক্ষ্মী, সরস্বতী ও গঙ্গা। কে স্বামীর বেশি প্রিয়, সেই নিয়ে তিনজনের মধ্যে লেগে গেল ঝগড়া। শেষ পর্যন্ত গঙ্গা সরস্বতীকে শাপ দিলেন, "যাও, পৃথিবীতে গিয়ে নদী হয়ে জন্ম নাও"। দেবী সরস্বতী নদী হয়ে নেমে এলেন আমাদের এই ধরায়।
যাই হোক্‌,এবার আসি সরস্বতীর রূপ-কথায়। যেখানেই সরস্বতীর কথা বলা হয়েছে, তাঁকে সর্বশুক্লা বলে অভিহিত করা হয়েছে। মনে হয়, সূর্যের শুভ্রজ্যোতির প্রতীক ও নদীর জলের স্বচ্ছতাই এই ধারণা তৈরী করতে সাহায্য করেছে। যদিও বৈদিক যুগে তাঁর চেহারা কেমন, সে সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি। তাঁর প্রাচীনতম মূর্তি দেখা যায় খ্রীঃ পূঃ দ্বিতীয় শতাব্দীতে তৈরী ভারহুত রেলিঙের গায়ে ।এই রেলিংটি কলকাতা জাদুঘরে রক্ষিত আছে। তুমি ইচ্ছে করলে দেখে এসো।
বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থে তাঁকে 'সকলকলাত্মিকা' বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তাই যখন তাঁর মূর্তি তৈরীর প্রশ্ন আসল, তখন কলাবিদ্যার প্রতীক হিসেবে তাঁকে একটা বীণা দেওয়া হল। বিখ্যাত তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ সমস্ত শাস্ত্র ঘেঁটে সরস্বতীর যে ছয়টি ধ্যানমন্ত্রের উল্লেখ করেছেন, তাতে দেবীর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। ১) তাঁকে তুলনা করা হয়েছে কুন্দ, চন্দ্র ও তুষার অর্থাৎ বরফের সঙ্গে। মানে তাঁর বর্ণ এদের মত শুভ্র; সঙ্গে তাঁর পোষাক সাদা, তিনি বসে আছেন সাদা পদ্মফুলের উপর। এমনকি তাঁর বাহনও শ্বেতহংস। ২) বেশির ভাগ জায়গায় তিনি চতুর্ভুজা, পদ্ম, বীণা, বই, অক্ষমালা, কমণ্ডলু ও বরাভয় মুদ্রায় তাঁকে সাজানো হয়েছে। ৩) তিনি ত্রিনয়নী। এই তন্ত্রশাস্ত্রেই কোথাও তাঁকে দ্বিভুজা বলেও দেখানো হয়েছে। সরস্বতীর এক নাম সারদা। সাধারণতঃ তাঁর একটাই মুখ হলেও এই নামের পূজাতে তাঁর পাঁচটা মুখ এবং দশটা হাত।
মজার কথা হল, বৌদ্ধধর্মেও পরে যখন বুদ্ধ ছাড়াও অন্যান্য দেব-দেবীর আমদানি হল, দেখা গেল আমাদের সরস্বতী সেখানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গিয়েছেন। অবশ্য তখন তাঁর নাম হল বজ্রতারা ও জাঙ্গুলীতারা। এছাড়াও ছিলেন সরস্বতীর আদলে কল্পিত বিদ্যার অধিষ্ঠাতা মঞ্জুশ্রী।
জৈনধর্মেও সরস্বতী বেশ জনপ্রিয়। তিনি হলেন শ্রুত দেবতা - কেবল বা জ্ঞানের দেবী। কার্তিকী শুক্লাপঞ্চমীতে জৈনরা ধূমধাম করে এঁর পূজা করে থাকেন। এঁদের সরস্বতীর দুই হাত থেকে ষোলটি হাত পর্যন্ত দেখা যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে হাঁসের বদলে ময়ূরকে বাহন করা হয়েছে। লক্ষ্ণৌ মিউজিয়ামে পুস্তকধারিনী জৈনসরস্বতীর খুব প্রাচীন একটি মূর্তি আছে।
সাধারণভাবে রাজহাঁসকে আমরা সরস্বতীর বাহন হিসেবে জানলেও, মেষ, ময়ূর ও সিংহকেও বাহন হিসেবে দেখা যায়। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে মেষবাহনা মূর্তি আছে। মুম্বই অঞ্চলে ময়ূরবাহনা সরস্বতীর পূজা বেশি। পুরাতাত্ত্বিক কানিংহামের মতে প্রাচীনকালে সরস্বতীর তীরে ময়ূরের প্রাচুর্যই একে দেবীর বাহন করেছে। রাজা রবি বর্মা সরস্বতীর যে ছবি এঁকেছিলেন, সেখানেও সরস্বতীর বাহন রূপে রয়েছে একটি ময়ূর।

ওয়াশিংটনে দেবী সরস্বতীর মূর্তি
বহির্ভারতেও সরস্বতীর পূজা প্রচলিত আছে, বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া, তিব্বত ও জাপানে। এছাড়াও গ্রীক দেবী আথেনা, মধ্যপ্রাচ্যের ইস্‌তার, রোমের মিনার্ভা ও আইরিশ ব্রিঘিদ্‌ প্রভৃতিদের রূপকল্পনায় সরস্বতীর প্রভাব দেখা যায়। একটা খবর হয়ত তুমি জান, তাও জানাই - আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডি সি শহরে ম্যাসাচুসেট্‌স্‌ অ্যাভিনিউ বলে একটি রাস্তা আছে। এই রাস্তা এমব্যাসি রো নামেও পরিচিত, কারণ এই রাস্তায় এবং এর আশেপাশেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দূতাবাসগুলি রয়েছে। প্রায় প্রতিটি দূতাবাস ভবনের সামনেই রয়েছে সে দেশের কোন না কোন বিখ্যাত মানুষের মূর্তি। ২০১৩ সালের জুন মাসে, ইন্দোনেশিয়ার দূতাবাসের সামনে, কোন মানুষের বদলে স্থাপন করা হয় জ্ঞানের দেবী সরস্বতীর এক পনেরো ফুট উঁচু মূর্তি। সাদায় আর সোনালিতে সাজানো এই দেবীর পায়ের কাছে বসে বই পড়ছে তিনটি ছেলেমেয়ে।
বিভিন্ন পুরাণে সরস্বতীর রূপ বর্ণনায় শিবের মত মাথায় জটা ও কপালে চাঁদ দেখা যায়। আজকাল আমরা যেসব সরস্বতী মূর্তি দেখি তা শিল্পীরা এইসব বর্ণনাকে আশ্রয় করে মিলিয়ে মিশিয়ে তৈরী করে থাকেন।
তাও আমরা বলি -
'
সা মাং পাতু সরস্বতী ভগবতী নিঃশেষ জাড্যাপহা ।।


আত্মারা যখন অন্য গ্রহে

১ রা তটা এখন বেশ গভীর । টুক করে শব্দ হতেই কান সজাগ হয়ে উঠলো অ্যাটলাসের । মাথার মধ্যে টিঁ টিঁ কী বেশ ক্যাল্কুলেশন করেই এগিয়ে গেল দরজার ...