১
ছেলেটাকে বেশিদূর পড়াতে পারে নি বলে কেষ্টর মায়ের দুঃখের আর শেষ নেই । কেষ্টর
মাথাটাও বেশ ভালোই ছিল । কিন্তু বাপ মরা ছেলেটাকে প্রায় পথে বেরতেই হত । প্রথম
দিকে কষ্ট হলেও , এখন বেশ রপ্ত করে নিয়েছে প্যাডেলে পা চালানোর । মায়ের বুক ফাটলেও উপায়
নেই । নিজের ভাগ্যকেও দোষ দিতেও ছাড়ে না । টি বি গরীবদের লাট সাহেবী ব্যামো !
কেষ্ট তার বাপের শেষ সম্বল রিক্সা টেনে কিছু না আনতে পারলে পোড়ার এই পেটও শুনবে না
।
ছেলেটি অনেক আলাদা
সকলের চেয়ে । গায়ে গতরে সারা দিন রাত পরিশ্রম করে ফেরার পথে বাজার করে আনতেও ভোলে
না । ঘরে ঢুকেই হাত পা ধুয়েই লেগে পরে রান্না করতে । রুগ্না মায়ের প্রতি অবহেলা তো
দূর বরং সারিয়ে তোলার এক অদম্য জেদে চলতে থাকে । বস্তি জীবনে কেষ্ট এক বেমানান গাছ
। মাঝে মধ্যে নানা কুহক যে হাতছানি দেয় না ,তা ভুল ! এক কিশোরের মনে যা যা থাকা
দরকার তাই সবই আছে । কিন্তু মায়ের দীর্ঘকালের টি বি রোগ আর বাপের অকাল প্রয়াণ
অনেকটাই বড় করে দিয়েছে তাকে ।
ছেলের কষ্ট আর মায়ের দাঁতে দাঁত চিপে তা দেখে যাওয়া , জীবন
নাট্যে এক অপূর্ব আলেখ্য চলতে থাকে প্রতিনিয়ত । চলে দিন আর রাতের ঐশ্বরিক খেলা । হয়ত এ খেলা কেষ্টর জীবনের একমাত্র নয় , চোখ মেললে হাজারটা
কেষ্টও প্রতিদিন সৃষ্টি হয় আবার ইতিহাসের অন্ধকার আবর্তে হারিয়েও যায় । নতুন কিছুই
নয় ।
সেদিন প্রায় জোর করেই নিয়ে গেল পাশের বস্তির থেকে কিছুটা দূরে ডাক্তারের
কাছে । ডাক্তার কাকু দেবতা তুল্য না হলেও একটু আধটু দয়া করেন আর কি , প্রয়োজনে
কেষ্টর রিক্সা শোধ দিয়ে দেয় তার দাক্ষিণ্য । ছায়া , মানে কেষ্টর মাকে ভালো করে
পরীক্ষা করে যে ওষুধ আর খাওয়ার লিস্ট শোনালেন তাতে মা- ছেলের আঁতকে ওঠাই স্বাভাবিক
। সাধেই না একে ‘ রাজরোগ ’ বলা হয়েছে ।
ডাক্তার কাকু পাশের ঘরে গিয়ে আলতো গলায় বললেন , “দ্যাখ
বাবা, আমার সাধ্য মত করলাম, এবার বাকীটা তিনিই জানেন ।”
-
“ তা তো ঠিকই স্যার ,” মাথা ও গলা ততধিক নিচু করে জবাব দেয় কেষ্ট ।
-
“ কি জানিস কেষ্ট , ওষুধের থেকেও দরকার ভাল পথ্য; ওটি না পেলে যা দেখলাম,
তাতে বুঝতেই পারছিস ”, ভারিক্কী চালের কথাটা শুনেই বুকটায় একটা অজানা কাঁপুনি খেলে
যায় কচি হৃদয়ে । এই পৃথিবীতে মা ছাড়া আর কেউ তো নেই তিন কুলে । যে করেই হোক ব্যবস্থা করতে হবে
।
বাড়ী ফিরেই ছোটে ওষুধের জন্য । তবে ব্যপারটা এত যে সরল
ভাবে হল তা কিন্তু নয় । শুরু হল মা ছেলের চাপা ঝগড়া , দুজনেরই যুক্তি ঠিক ।
মাঝে ছায়া খেই হারিয়ে চিৎকার করে ওঠে , “ ওটা আমি পারব
না দিতে , আমি বাঁচি বা মরি ” একমাত্র সম্বল পলকা একটা সোনার বালা হাতের মধ্যে
রেখে চাপা ক্ষোভে বলে ওঠে ।
কেষ্ট রেগে ওঠে মায়ের জেদের জন্য , সেও থামবে না । গলাটা
আকস্মিক চড়িয়ে বলে , “ তুমি কি চাও আমি জুয়া খেলি চুরি করি ? আর ওটা রেখেই বা কি
লাভ শুনি !”
-
“ আমার জন্য শেষে ভিখারি হয়ে যাস ,এটা কোন মা চায় !” চোখের
এক অজানা ধারা শাড়ির আঁচলে মুছতে মুছতে বলে
আবার বলে , “ অন্তত বালাটা দেখলে বুকে জোর পাই ।” এত কথা একসাথে বলে হাঁপাতে শুরু
করে ছায়া ।
মাথা গরম করে বেড়িয়ে পরে কেষ্ট । আসলে এই
বালাটা কেষ্টর বাপ কষ্টের রোজগারে গড়িয়ে দিয়েছিল । তারপর সংসারের নানা অসময়ে সাধের
এই বালাটি বেশ কয়েকবার বাঁধাও পরেছে কিন্তু আর না । কেষ্টর মা জানে ক্ষয় আর থামার
না । স্বামী আর নেই । কুব হলেও তার অবর্তমানে বালাটা বেচে কয়েকদিন তো বাঁচবে
ছেলেটা । নানা কথা ভাবতে ভাবতে দুর্বল শরীর অবসন্ন হয়ে যায় । ক্রমশ রাজ্যের ঘুম তার ঘোলাটে চোখে জমতে আরম্ভ করে ।
২
এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে । অনেক আগেই জলটা শুকিয়ে গেছে
। এ দৃশ্য আবার যে এত তাড়াতাড়ি আসবে এই কম বয়সে তা ভাবে নি । এই সত্যের
সাথে এটাও ঠিক । বাস্তবের জগতে সে যখন হেঁটেছে তখন থেকেই
আস্তে আস্তে শিখতে আরম্ভ করেছে নির্মমতা কঠোরতা মানুষের মুখের খোলসটাকেও পরিবর্তন
করে দেয় । যত না বয়স তার থেকেও ক্রমান্বয়ে বেড়ে যায় মস্তিষ্কের বয়স । মায়ের কঠিন
রোগটা যে একদিন কেড়ে নিয়ে যাবে সব পার্থিব অস্তিত্বকে এটা ছিল চরম সত্য ।
রাগের মাথায় বাড়ী থেকে
বেড়িয়ে যাওয়ার ঘন্টা তিন-চারেক পরেই কিছু ওষুধ জোগাড় করে আনে কেষ্ট । মায়ের কাছে
বসে নিজেই ঠাণ্ডা গলায় কথা বলতে শুরুও করেছিল । চুপ করে থাকতে দেখে হাসাতেও কসুর
করে নি ঘুমন্ত মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ।
-
“ বাবা মহারাণীর ঘুম দেখ , অসময়ে না ঘুমিয়ে রান্না করে দাও তো ,” ইয়ার্কি
মেরে বলে কেষ্ট ।
কোন উত্তর না পেয়ে অবাক
হয়ে যায় একটু । এত রাগ অভিমান আগে তো দেখেনি ! হয়ত রাগের মাথায় মাকে
একটু বেশী আঘাত দিয়ে ফেলেছে , মনে মনে ভাবে সে । শেষে থাকতে না পেরে আদুরে গলায় আবদার করে বলে , “ আজ খিচুড়ি
খাব । আর ওষুধটা পেটে পরলেই তুমি কেমন চাঙ্গা হয়ে পড়বে !” কথাগুলো বলতে বলতে মায়ের
হাতটা ধরে নাড়া দিতেই অনুভব করে একটা ঠাণ্ডা শক্ত কিছু যেন মায়ের হাতটাকে আটকে
রেখেছে । চমকে উঠে হাতটা ছেড়ে মুখটা ধরে কাছে টেনে নিতেই দেখে ঘাড়টা কেমন যেন শক্ত
শক্ত ভাব । বিছানার ছেঁড়া চাদরটায় লাল জমাট রক্তের দাগ । ভয় পেয়ে ছুট্টে ডাক্তার
কাকুকে কোনমতে নিয়ে আসতেই বোঝে তার অনুমানটাই বাস্তব হয়েছে । রিগার মর্টিস দেখা দিয়েছে শরীরের প্রতিটি
পেশীতে ।
কাজে আসে সেই বালাটাই
। চেনা দোকানে আবার বন্ধক হয় সেটি পুরনো অভ্যাস মত । মিউনিসিপালিটির চুল্লীর জন্য টাকা জোগাড় থেকে শুরু
করে তিন চারজন বন্ধু । একটা গাড়ী আর টুকটাক আত্মার শান্তির জন্য কিছু তো জোগাড় করা
এক নব্য কিশোরের পক্ষে কতটা যে আদপে সহজ তা হয়ত কেষ্টর মত মানুষরাই বোঝে !
সব
মিটিয়ে শূণ্য ঘড়টায় ফিরে আসে যখন তখন সূর্য পশ্চিমে কিছুটা হেলে গেছে । প্রতিদিনের
মত আকাশটা একই থাকে । পরিবর্তন হয়ে যায় এক নিঃসঙ্গ কৈশোর জীবন । এত বড় কোলাহল মুখর
সংসারে সে এখন শুধুই নির্বাক দর্শক । একটা বেদম দলা পাকানো কান্না গলা বেয়ে চোখের
কাছে আসতেও অদ্ভুতভাবে সামান্য বাষ্পের মত জল চোখের কোণায় এসেই মিলিয়ে গেল ।
সারাদিনের দৌড়
ঝাঁপের পর মায়ের ফেলে দেওয়া তোষকহীন ফাঁকা খাটে জড়সড় হয়ে শুয়ে পড়তেই ঘুমে চোখ বন্ধ
হয়ে আসে । পেটে সারাদিন কিছুই পরে নি ।
সকালে উঠে
মায়ের জন্য অভ্যাস মত চা বসাতে যেতেই থমকে দাঁড়ায় । হাতে নেওয়া মায়ের কাপটা চুপচাপ
পাশে সরিয়ে রাখে । বস্তির এক বন্ধু রতন দাঁত মাজতে মাজতে এসে জিজ্ঞাসা করে , “ কিরে
সব ঠিক আছে তো ? মাসি যা কষ্ট পাছিল...”। রতনের
কথায় ‘স’ টানটা প্রবল । মুখের মধ্যে ভর্তি পেস্টটা থুক করে ফেলে তাকিয়ে
থাকে কেষ্টর দিকে । ব্যাবহারিক জীবনে হাব-ভাব তার বয়সকেও হাড় মানায় ।
-
“ হ্যাঁ ওই আর কি ?” কেষ্টও কল তলাতে মুখ ধুতে ধুতে জবাব
দেয় । কল তলা বস্তি জীবনের বলা যায় সকাল বেলার মিটিং পয়েন্ট । কথা বলার ফাঁকেই আরও
কিছু বাপের আমলের লোক জুটে যায় । এরা সান্ত্বনা মতামত দেওয়ার জন্য অসীম পারদর্শী ।
ছায়া যতদিন সুস্থ ছিল মাঝে মধ্যে আলটপকা এসে চা – বিস্কুট খেয়ে যেত । যেই শুনেছে
টি বি তখনই ভোঁ ভাঁ । আবার যখনই দেখল আর নেই তখনই রীতি নীতির মাতব্বরি মূলক কথার
ফুলঝুরি ।
-
“ কেষ্ট শ্রাদ্ধ শান্তি তো করতে হবে । আমি না হয় পুরুতের
সাথে কথা বলে নেব ,” ঝুনু কাকু ঝানু মাথায় বলে ওঠে ।
কেষ্ট চুপচাপ
শোনে । উত্তর না দিয়ে ঘড়ের দিকে পা বাড়ায় । পিছন ছাড়ে না ঝুনুর মত অসময়ের পরম
হিতকারীর দলও !
-
“ কাকু , আমি টাকা কোথায় পাবো বল ” শান্ত গলায় কোমরে
গোঁজা একফালি আসনটা খাটে পাততে পাততে উত্তর দেয় কেষ্ট ।
এতক্ষণে
কনোক্রমে চুপ ছিল রতন । আর থাকতে না পেরে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে , “ সে কি বে ? মায়ের
কাজ করবি না !!”
-
“ জানি না ” কেষ্টর এই ছোট্ট উত্তরে ঘরে উপস্থিত
হিতৈষীদের সাথে রতনের মুখও হাঁ হয়ে ঝুলে পরে ।
বলে কী কেষ্ট
! মাথাটাই গেছে ! হিন্দুর ছেলে !! পথের ভিখারীও চেয়ে চিনতে ওম নম করে সারে আর এ সোজা
না বলে দেয় ! হায় রে বিদেহী আত্মা !
কেষ্ট টান টান
করে শুয়ে পড়তেই ঘড়ের জনতা চাপা গুঞ্জন করতে করতে বেড়িয়ে যায় । খোলা দরজার এক চিলতে
রোদ তীক্ষ্ণ ভাবে ঘড়ের ফাটা মেঝেতে এসে আছাড় খায় ।
৩
মানুষের জীবনে
ছোট হোক বড়ো হোক শোরগোল একটা অপরিহার্য অঙ্গ । যতদিন এটা থাকবে ততদিন জুগের চাকা
গড়গড়িয়ে চলবে । যতদিন শাস্ত্রের বিধান আছে , ততদিন প্রায়শ্চিত্ত-আচার-বিচার –ধর্মীয়
ব্যাখ্যান আরাম করেই থাকবে নিজের নিজের পারস্পরিক যুক্তির ধ্বজা ধরেই । সমাজের
উঁচু স্তরে এক সুর-লয় বাজে , মধ্যতে দোতরফা ভিন্ন গ্রামের আর শেষে অন্য মাত্রার
মূর্ছনা । তবে সুরের এই নিরবচ্ছিন্নতার মাঝে লয় ছন্দও কাটে কেষ্টর মত উঠতি কিশোরের
দল । আর ঠিক তখনই আসে নানা সাঁড়াশি
আক্রমণ ।
-
“ ছিঃ ছিঃ কেষ্ট ! তোর বাপ মরার পর তোর মাও চেয়ে চিন্তে
হলেও নিদেন একটা কিছু তো করেছিল !”
-
“ হুম বিশু কাকা তা করেছিল , লাভ কী !”
-
“ তবে তুই কেন করবি না বলছিস , এটা ঠিক নয় বাপু !”
রোয়াকে বসে মাথা দোলাতে দোলাতে বাপের বয়সী এক লোক বলে চলে ।
-
“ দেখ কাকা , আমার টাকাও নেই আর যা ছিল তাও শেষ ।”
রতন , গালকাটা চিতা এরা হল এই বস্তির সব
সমস্যার নিরাময়ের কেন্দ্র । এরাই তো কেষ্টর মায়ের বডিটা ‘ হরিবল ’ ধ্বনি তুলে
বস্তির ওই মাঝ দুপুরকে একত্রিত করে তুলেছিল । শ্মশানে পকেট কালেকশন করা চাঁদার
সাথে কেষ্টর দেওয়া টাকাটা মিলিয়ে নান অঙ্ক কষেছিল । কাজের শেষে শ্মশানের মোড়ের
মাথায় টোপা টোপা রসগোল্লা সমেত বিলিতিটা ঢুক ঢুক করে গিলতেও কিন্তু ভুল করে নি ।
মাংস পরোটা ম্যানেজ করতে পারে নি এই যা ।
ক্ষুরে গাল কেটে গেছিলো এক কায়দা বাজিতে
চিত্তের । তারপর থেকেই রোয়াবি করে নাম রাখে গালকাটা চিতা ।
-
“ দূর ওসব নিয়ে চিন্তা করিস না বুঝলি । সব ম্যানেজ হয়ে
যাবে ” গলাটা নামিয়ে বলে চিতা । খানিক কী ভেবে পাড়ার বয়স্কদের দিকে তাকিয়ে বলে , “
কী কাকু হবে না ? আমরা থাকতে কাকীমার আত্মার শান্তি হবে না !”
-
“ সে তো ঠিকই আমরা তো তাই বলছি ভাই ” এক বুড়ো বলে ওঠে ।
-
“ তা আঙ্কেল এবার তোমরা একটু পাতলা হও , আমরা সব ঠিক করে
নিচ্ছি ।”
রতন ফোঁড়ন কেটে চিতার সঙ্গ নিয়ে বলে ওঠে “
হ্যাঁ এবার ফোট তো সব, খালি খাওয়ার তাল ।”
জঙ্গলে আর মানব সমাজে এক জায়গায় বড্ড সুন্দর
এক গভীর মিল আছে । জোয়ান উঠতি কেশর সিংহকে ঘন কেশরের অভিজ্ঞ সিংহ একটু মেনে চলে ।
নিয়মের রাজত্বে একটা না একটা চরম মিশেল থাকেই । রতনরা হল সেই উঠতি কিশোর । দাঁতের ধারের পরীক্ষা
পুরোপুরি না শিখলেও , মাড়ির জোরটা একটু বেশীই থাকে ।
কেষ্টর টালি ভাঙা ঘড় ফাঁকা হয়ে গেলে রতন কেষ্টর কাঁধে হাত দিয়ে বলে , “
কিছু তো খাস নি ? সেদ্ধ কিছু বানাতে না পারলে বল , পঞ্চার মা ভাতে ভাত করে দেবে ।”
কেষ্ট নাসূচক মাথা দুলিয়ে জানায় , “ আমি
ব্যবস্থা করে নেব ।”
অগত্যা ওরা বেশী কথা না বাড়িয়ে পরে । অনেক কাজ সামনেই । তাছাড়া নিজেদেরও তো কিছু ধান্দা আছে । সংসারে মজার কিছু
দিক আছে । কেষ্টর পেটে আট ক্লাসের বেশী বিদ্যা নেই । তবে সে জীবনকে অন্যভাবে দেখে
। হয়তো পুরো না হলেও আংশিক ভাবে চিন্তা করে । ধর্ম- আচারের এক শৃঙ্খল আছে , তাকে কেউ পুরোটা অস্বীকার করতে
পারে না কখনই । কিন্তু আচার- রীতি- নীতি কখনই গলার ফাঁসও হয়ে বসা উচিৎ না । আর যদি
হয়, তবে তা অন্যায় ।
মায়ের জন্য তার যে শ্রদ্ধা ভালোবাসা নেই তা
নয় । তবে ধার করে , ভিক্ষা করে শ্রাদ্ধ করবে এটা ঠিক তার মনের এক জায়গায় বারবার
ধাক্কা খাচ্ছিল । খাঁচায় বদ্ধ পাখি যেমন মাথায় ঠোক্কর খায় , খুঁজতে থাকে মুক্তির
উপায় । কেষ্ট দেখেছিল বাবার কাজের সময় মা কীভাবে প্রায় সব দিয়ে আচারের সব দিক
আপ্রাণ ভাবে মেটানোর চেষ্টা করেছিল ।
বস্তির কয়েক পরিবারকে লুচি আলুরদম মিস্টি
খাওয়ানোর পরও দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে বিজ্ঞ লোকেরা মন্তব্য করেছিল ‘ লুচিটা আরেকটু
ভাজতে হত ’ বা ‘ মিস্টিটা যে কেন আরেকবার যাচাই করলো না !’
মানুষ কিসের তৃপ্তির জন্য শ্রাদ্ধে লোক
খাইয়ে আচার সাধন করে ! অপক্ক মাথার কেষ্ট পুরো বিশ্লেষণ ঢোকাতে পারে নি । আজ মা
চলে যাওয়ার পর নানা সত্যের মধ্যে এটা বুঝতে পারছে , যতই কর অভিযোগ সমালোচনা ;
আবহমানকাল ধরেই শাখা প্রশাখা নিয়ে থেকে যাবেই কিছু অদৃশ্য মাকড়সার জালের মত নানা
তথ্যাবলী । নদীর গতিপথে নানান বাঁকের দৃশ্যপটের মত জীবিত থাকবেই নানা মতের
ধারাবাহিকতা ।
৪
স্টিমারটা যখন এক পাড় থেকে তেড়ছা ভাবে গঙ্গার
বুক কেটে ধীরে ধীরে বাঁক নিচ্ছিল তখন উঁচু উঁচু বিল্ডিঙের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো
ভোরের ধোঁয়া ওঠা নদীর বুক’কে আরেক নতুন অর্ঘ্যে সাজিয়ে তুলছিল । কেষ্ট নির্নিমেষ চোখে
দেখে যাচ্ছে । সোনালী কিরণ যেন মা গঙ্গার শরীরে স্নিগ্ধ কোমল পূজার ফুলের মত তার নির্মল
শ্রদ্ধা নিবেদন অনাদিকালের মত করে চলেছে ।
নিজের জায়গা ছেড়ে এক
উঠতি কিশোর চলেছে অপর এক প্রান্তে । ষ্টেশনে হয়ত কোন এক ট্রেন করে আছে অপেক্ষা !
প্রতীক্ষমাণ অন্য কোন এক গন্তব্যের জন্য ! বড্ড হাল্কা লাগছে নিজেকে আজ । দু’হাত
দিয়ে মুখটা ঢেকে ভাবার চিন্তা করে কেষ্ট । সমাজ কী বলবে , শাস্ত্র কী জবাব চাইবে
তা সে জানে না ! তবে নিজে হয়তো নিজেকেই উত্তর দিতে শিখেছে ।
অনেকের নানা পরামর্শ উপেক্ষা
করেছে কেষ্ট । হ্যাঁ উপেক্ষাই ! বোধটা যদি নিজের মনের কষ্টিপাথরে নিখাদ সত্য লাগে
, তবে তা পরম সত্যানুসন্ধান ।
একটু পরেই ঘাটে লঞ্চ লাগে
। সব ভিড়ের মাঝে রেলের টিকিট কাটে । কোথাকার বা কোন ট্রেনের তা এখানে অপ্রাসঙ্গিক
। নির্দিষ্ট সময়ে এক বগিতে উঠে বসে সে ।
সিগন্যাল সবুজ হওয়ার সাথে
সাথেই দুলতে শুরু করে দানবটি । ধীরে ধীরে
নেয় গতি । জানলার দিকে তাকিয়ে থাকে কেষ্ট । চাকার ঘর্ষণের মাঝেও যেন সে পায়
উত্তরের পুনরাবৃত্তি । ‘ কেষ্ট তুই ঠিকই করেছিস বাপের রিক্সা আর চিলতে ঘোরটা বেচে
দিয়ে । ভাল করেছিস টি বি রুগীদের সেবাকেন্দ্রে কিছু টাকার ভাগটা দিয়ে ।’ না কেষ্ট
মহামানব নয় ! তবে এক কিশোরের চেতনা ।
ক্রমে ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে অন্য লাইনে একের
পর এক পার হয়ে গতি নিয়ে নিয়েছে । পরম শান্তির ঘুমে চোখ বন্ধ করে কেষ্ট ।।
No comments:
Post a Comment