Saturday 30 March 2019

আত্মারা যখন অন্য গ্রহে


Related image
রাতটা এখন বেশ গভীর । টুক করে শব্দ হতেই কান সজাগ হয়ে উঠলো অ্যাটলাসের । মাথার মধ্যে টিঁ টিঁ কী বেশ ক্যাল্কুলেশন করেই এগিয়ে গেল দরজার কাছে ।
রাত । মহাশূন্যের রাতের রঙ কালচে বেগুনী । পৃথিবী এখান থেকে কয়েক লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে ।
কেবল অ্যাটলাসের নয় , তবে ওর মত যারা এই গ্রহের প্রহরী  তাদের চোখের মণিটা একটু লালচে ; হেক্সাস্কোপ  লেন্স ওদের চোখে আঁটা । লাখ লাখ আলোকবর্ষ দূরের জিনিষ স্পষ্ট দেখতে পারে ওরা ।
ডঃ চিন্তামণিকে আমরা কজনই বা চিনি ! নিজের ছোট্ট ল্যাবরেটরির ঠিক কোণায় রাখা আরাম কেদারায় এক সিপ বেয়ার গলায় ঢেলে গোঁফের তলায় হাল্কা হাঁসি রেখে  জেলির মত স্বচ্ছ আমন্ত্রণ পত্রটি পড়ছেন । । সাংকেতিক নাম ‘ মেথু । সহজেই বোঝা যায় ।
পড়া শেষ করে জেলি পত্র রেখে দিলেন  চৌক একটা ফ্লপিতে । প্রায় ১৪ বিলিয়ন প্রাচীন মেথুশিলা গ্রহে অ্যাটলাস থাকে । ওখানকার এক চোখ বাসিন্দারা ভাষা কী সেটা ঠিক জানে না । ওদের ইচ্ছে ওখানে পৃথিবীর মত স্কুল তৈরী করা । তাই অনেকদিনের বন্ধু ডঃ চিন্তামণিকে বক্তৃতা দেওয়ার জন্ ডেকেছে ।
 ফানেলের মত লম্বা মহাকাশ যানে দাঁড়িয়ে পরলেই হুসহুস করে উপরের দিকে টানতে থাকে । দিন দুয়েক লাগলো ১২৪০০ আলোকবর্ষ পার মেথুশিলায় পৌঁছাতে । আশ্চর্য এখানে মাইনাস ২১২ সেলসিয়াস অথচ ঠাণ্ডার লেশ মাত্র নেই ।
মনের কথাটা বুঝেই অ্যাটলাস গং গং একটা ধাতব শব্দ আর ইশারায় বলল , “ আপনি এই গ্রহের কাছে আসতেই  আপনার পেরিফেরিয়াল নার্ভে এই গ্রহের রশ্মি পরে আর তাই ঠাণ্ডা আপনি অনুভব করতে পারছেন না ঠিক আমাদেরই মত ।
চিন্তামণি খেয়াল করলেন এখানকার একজন থেকে আরেকজনের মুখের-চেহারার মিল না থাকলেও নারী আর পুরুষ … বোঝা কঠিন ! দিন আর রাত সব সময় কিসের যেন কাজে ব্যাস্ত ।
সকালের রঙ এখানে খুব সুন্দর । ফিকে গোলাপি আর কমলার মিশ্রণ । একটু ভালো করে লক্ষ্য করলেই দেখা যায় সাদা থোক থোক জুঁই ফুলের  মিল্কি ওয়ে । অ্যাটলাস বাকীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল অদ্ভুত 
খানিকটা এগোতেই নীল রঙের বালির ঢিবি । ওখানেই বসতে হবে । সামনের ছোট বড় মিলিয়ে শখানেক মেথুশিলার বাসিন্দা । সক্কলে একচোখে তাকিয়ে আছে ডঃ চিন্তামণির দিকে । অদ্ভুত নিস্পলক চাউনি । ভালো করে দেখার চেষ্টা করলেন , উঁহু কোন অভিব্যাক্তিই নেই ।
অনেকক্ষণ বক্তৃতা শেষ । একটিও হাতে তালি নেই ।
“ একী রে বাবা ! কিছু ভুল বললাম নাকি !” মনে মনে ভাবলেন ডক্টর ।
এই গ্রহের বাসিন্দারা বিস্ময়কর ভাবে একে অপরের কথা বুঝে যায় , তাই প্রকাশ কম । ভাষা খুব একটা নেই । তাই অ্যাটলাস এবারও ডক্টরের দিকে তাকিয়ে আগের মত যান্ত্রিক শব্দে বলল “ আসলে , আপনারা আমাদের কাছে খুবই আকর্ষণীয় । কিন্তু জ্যান্ত তো আর ধরে আনতে পারি না । ওটা অনুচিত ,তাই আপনাদের মৃত্যুর পর কিছু আত্মাকে আমরা এই গ্রহে নিয়ে আসি আর নতুন করে তৈরি করি ।“
কথা শুনে চিন্তামণির চিন্তা হুড়হুড় করে বেড়ে যায় , “ কিন্তু কেমন ধরনের…”
ইশারায় থামতে হয় তাকে । অ্যাটলাস জবাব দেয় , “ অনুভূতিহীন বা বলতে পারেন যাদের প্রকাশ ক্ষমতা ছিল না এমন সব মানব আত্মাদের ।“
“ কিন্তু ওদেরই বা কেন ? আরও তো আছে ?” ডক্টরের গলায় বিস্ময় ।
“ দরকার নেই বাকীদের । আমাদের এই গ্রহ ভাব আর ভাষা বোঝে না তেমন একটা । কাজই ধর্ম-অনুভব সব্বব কিছু । আপনাদের ওই ধরনের আত্মাগুলো এই গ্রহের বাকি সকলকে তারই টেরিং দেয় ।“
আজ রাতের যানে ফিরতে হবে । ধূধূ করা নিল-হলুদ বালির দেশ এটা । গাছ নয় তবে গাছের মত ঝিরঝিরে হাওয়া দেয় , ঠিক সেখানেই একটা গাঢ় সাদা পাথরের উপর গালে হাত দিয়ে বসে ভাবছিলেন মিথুশিলার সর্বনাশের কথা । এমন চলতে থাকলে …। বোঝে না কেন মেশিনেরও মোবিল লাগে ।
ঠিক তখনই একটা ট্রেতে গ্লাস নিয়ে হাজির অন্য একজন । ঢাকনা সরাতেই দুধের মতই কিন্তু খুব পাতলা সাদা তরল । লোকটি বলল , “ এটা  স্পেশ্যালি আপনারই জন্য তৈরি , স্পার জুশ ।“ অবাক হলেন ডঃ এর গলা তো পৃথিবীর মানুষের মতই ।
“ আ-আপ-নি পরাণ পুরুত !” মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক গলায় বললেন । চেহারা এখানকার মত অনেকটাই হয়েছে কিন্তু ভাষা আর ভাব এখনও পৃথিবীর মতই ।
গতবছর ক্যানসারে মারা যান । লোকে অবশ্য অনুশোচনা করে নি । বরং শ্রাদ্ধে কবজি ডুবিয়ে খেয়েছিল আর মনে মনে ওই নিরস মানুষটা যাওয়াতে খুশীই হয়েছিল ।
এখানে থাকতে থাকতে পরাণের আত্মা মনের কথা পড়তে শিখে গেছে । তাই ভাবটা বুঝেই উত্তর দিল, “ ঠিকই মনে করছো । আসলে আবেগ হল যত দুঃখের কারণ । যত ভাববে ততই কষ্ট । মরার আগে অবধি এটাই ভাবতাম । কিন্তু…”
-         “ কিন্তু কী ?
-         “ কিন্তু এখানে এসে যখন বাকী আত্মাদের সাথে দেখা করলাম , বুঝলাম মরার প সক্কলেরই একটা কথা প্রকাশ আর অনুভূতি না থাকলে বেঁচে থাকাটা আপাত সহজ হলেও সমাজ পরিন্ত হত এই গ্রহের মত স্পন্দন আর ভাষাহীন পাথরের মত ।“ কিছুক্ষণ চুপ থেকে পরাণ পুরুত উত্তর দিল ।
-         “ উপায় কী পুরুত মশাই ?”
-         “ তার জন্যই তো অ্যাটলাসের সাথে কথা বলে তোমায় এখানে আনা । তুমি বৈজ্ঞানিক । ঠিক পারবে তুমি ।“
মহাকাশযান সবুজ ধোঁয়া ছেড়েছে । খানিক পরেই রেখে আসবে ডক্টরকে পৃথিবীতে । চিন্তামণি নিজে বৈজ্ঞানিক ভেবে পাচ্ছিছিলেন না আবেগের কী ওষুধ । মনে পরে গেল পকেটে রাখা সেই তরল “এন্ড্রলিন সিঙ্গুলেট জাইরাস “। একবার উপহার হিসাবে দিয়েছিলেন প্রোফেসার রোহিতাশ্ব রায় ।
মহাকাশযানে ওঠার ঠিক আগে কয়েক ফোঁটা ঢেলে দিতেই চমৎকার ! গড়াগড়ি খাচ্ছে গ্রহের বাসিন্দারঅসুধকেউ হাসছে , কেউ গম্ভীর মুখ বিটকেল করে হাসতে হাসতে কাঁদছে । আর আজব সব শব্দ বেড়িয়ে আসছে মুখ থেকে । ভাষার জন্ম হচ্ছে । অ্যাটলাসও হাঁসতে হাঁসতে জানতে চাইলো , “ কী দিলেন আপনি ?“
  কাতুকুতুর ওষুধ ।“ মুচকি হেসে উত্তর দিলেন ডক্টর ।
মহাকাশ ওড়ার খানিক পরেই জানলা দিয়ে দেখলেন কালো কিছু ধোঁয়া । আত্মারা মুক্তি পেয়েছে ।
মাস কয়েক পর বাড়ীর ল্যাপটপে পিং শব্দে একটা ভয়েস ম্যাসেজ ।
“ আমাদের ভাষা সম্পূর্ণ এসেছে , মেথুশিলার রাষ্ট্রীয় ভাষার নাম – ‘ চিন্তামণি ভাষা ‘ ।। “

No comments:

Post a Comment

আত্মারা যখন অন্য গ্রহে

১ রা তটা এখন বেশ গভীর । টুক করে শব্দ হতেই কান সজাগ হয়ে উঠলো অ্যাটলাসের । মাথার মধ্যে টিঁ টিঁ কী বেশ ক্যাল্কুলেশন করেই এগিয়ে গেল দরজার ...