১
বৃষ্টিটা থেমে গেছে অনেকক্ষণ , কিন্তু সোঁদা গন্ধ বাষ্পের
মত সারা শরীরময় । আমি বৃষ্টি বরাবরই ভালোবাসি । তবে আজকের বৃষ্টিটা হঠাৎ । আকস্মিক
। বেশ কয়েকদিন ধরে একটানা ক্লান্তি মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল , দমকা হাওয়া আর বৃষ্টির
ছোঁয়ায় হুস করে সেগুলো কোথায় যেন মিলিয়ে গেল ।
মানুষ আজকাল হাসে কম , অনুভূতিগুলো কেমন যেন ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে
সকলের । আমিও বাদ পরি না অবশ্য । ‘এন্ড্রলিন সিঙ্গুলেট জাইরাস ‘ সম্পূর্ণ নাম । নাহ
এটা কোন রান্নার রেসিপির নাম ভেবে ভুল করবেন না । আমার নতুন আবিষ্কারের পোশাকি নাম
“ সিঙ্গুলেট জাইরাস ।“
রাতের খাওয়া শেষ করে খানিক আগেই উঠলাম । সময় খুব যে গভীর
তা নয় , কাঁটা বলছে সাড়ে এগারোটা । টুং করে মেসেঞ্জারে একজনের ম্যাসেজ আসতেই ভ্রূটা
কুঁচকে উঠলো । ভেবে দেখলাম পূর্ব পরিচিত নন , নামটা বেশ মজার । হারু ইটো । জাপানী
, পেশায় ও নেশায় বিজ্ঞানী । ফেসবুকে আমার কিছু পোষ্ট দেখে কথা বলতে চান । হারু ইটোর
সাথে কথা বলতে বলতে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছিলাম খেয়ালই নেই । লজ্জিত হলাম , ছিঃ ছিঃ কী
ভাবলেন ! চ্যাট ওপেন করতেই দেখলাম , তিনি ফোন নং দিয়েছেন আর অনুরোধ জানিয়েছেন যদি তার
সাথে একটু কথা বলি ।
চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতেই ফোনটা করেই ফেললাম । খানিকক্ষণ
রিং হওয়ার পর একটা মার্জিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে – “ হাই , করে অয়া দারেনা না কা ? “ শুনেই
হোঁচট খেলাম ।
কাপটা টেবিলের পাশে রেখে বললাম , “ আর ইউ মিঃ হারু ইটো
?” অপর প্রান্ত চুপ । মনে মনে একটু রেগে উঠেছি , একেই আই এস ডি কল , তারপর যদি কথা
নাই বলে … “ধুর” বলে ফোনটা কেটে দিলাম ।
মানুষের স্বভাব বড়ই বিচিত্র ,সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মও আজব দুনিয়া
এই নিয়ে ভাবছি । এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠল । ধরতেই “ মোশিয়াকিয়ারিমাসেন যা হিজো নি
জান্নেন , আই অ্যাম হারু ইটো “ জাপানী বিজ্ঞানী সকরুণ গলায় বলে উঠলেন । বেশ মজা লাগলো
। ওনাকে ওই বিশাল শব্দের অর্থ জিজ্ঞেস করাতে গর্বের সাথে বললেন , “ সরি , ভেরি সরি
।“ অর্থাৎ উনি আমার ফোন নিজে না ধরতে পারার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন ওটি বলে ।
মিনিট দশেকের কথায় ভদ্রলোক আমার মন জয় করে নিলেন । এরপর মাঝেমধ্যেই
নানা কথাবার্তা , বিজ্ঞান ইত্যাদি নিয়ে কথা চলত । হঠাৎ যেভাবে এসেছিলেন তেমনি দেখলাম
ভদ্রলোককে ফেসবুক তো দূর ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না । দুশ্চিন্তার কথা মাথায় আগে আসে ।
কিন্তু এতদূর থেকে চিন্তা ছাড়া আর কোন উপায়ও নেই ।
দিনের মত দিন যায় আমিও ভুলতে থাকি । সিঙ্গুলেট জাইরাসকে কী
কী ভাবে আরও কার্যকর করা যায় সে ভাবনায় ডুবে আছি । ঠিক এমনই একদিনে হারু ইটোর ফোন ।
অবাক হলাম ! কথা বলে বুঝলাম উনি বেশ চিন্তিত তাঁর বাবাকে নিয়ে । অনেক চিকিৎসা করিয়েও
কিছু লাভ হচ্ছে না । আত্মহত্যার চেষ্টা কয়েকবার করেও ফেলেছেন ।
২
ভিসা অফিসে রোহিতশ্ব রায় অর্থাৎ আমি , আবেদন জমা করেই দিলাম
শেষমেশ । বেশীদিন লাগলো না মঞ্জুরী পেতে । পাক্কা ৯ ঘন্টা ৩০ মিনিট পর টকিয়োর হেনেডা
বিমানবন্দরে অবতরণ করলাম । সুঠাম চেহারার ভদ্রলোক হারু ইটো । বৈজ্ঞানিকের থেকেও সিনেমার
অভিনেতা হলে বেশী মানাতো । খুবই বিনয়ী অথচ চোখেমুখে নিজের এবং নিজের দেশ সম্পর্কে মার্জিত
গর্ববোধ । ভালো লাগলো ।
সমুদ্রের ধার দিয়ে বেশ খানিকটা যাওয়ার পর মিঃ হারু গাড়ীর
স্পিড বাড়িয়ে দিলেন । অসাধারণ দৃশ্য । চারিদিকে ব্যাস্ততা অথচ জাদুর স্পর্শে সব কিছু
নিজের থেকেই যেন হয়ে যাচ্ছে । ভিড় আছে , নেই মারামারি । কখন যে ২৪ কিলোমিটার পার করে
সিনঝুকু শহরে চলে এলাম খেয়ালই করি নি । ৩৭ তলা বিল্ডিং এর পাশ কাটিয়ে আরেকটু এগোতেই
মিঃ হিরুর বাংলো । নাহ খুব একটা বড় না , তবে রুচিবোধ অসামান্য ।
আমি আগেও দুটি দেশে গেছিলাম আর এখানেও একটি বিষয় খেয়াল করলাম
, কাজের লোক তেমন নেই । ভারতে যে এর চাহিদা তুঙ্গে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । এর জন্য
পরাধীন ভারতের দাসত্ব চেতনা দায়ী কিনা বলতে পারবো না । রিকু , জাপানী বৈজ্ঞানিকের ছেলে
। দরজায় টোকা দেওয়ার পর খুলে দিল । আমাকে দেখেই একগাল হাঁসি । গোলগাল মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানালো । খানিক পরেই
এক ভদ্রমহিলা মিনিয়েচার করা সুদৃশ্য চায়ের কাপ হাতে নিয়ে হাজির । কিরা পরিহিতা ভদ্রমহিলা
যে মিঃ ইটোর স্ত্রী তা বুঝতে অসুবিধা না হলেও আমার বন্ধু ছেলে আর স্ত্রীএর সাথে পরিচয়
করিয়ে দিলেন । আধা ভাঙা ইংরাজিতেই কথা প্রথম থেকে শেষ অবধি হয়েছিল । বোঝার সুবিধার
জন্য বাংলায় লিখছি ।
ফ্রেস হয়ে গেছি অনেকক্ষণ । খিদে যে পেয়েছে তা নয় । ভারতীয়
পেট প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা আগে কী করে খেতে পারবে বলুন ! আমার রিস্টওয়াচে তখনও সকাল
১০ টা ছত্রিশ মিনিট । এদিকে মিসেস ইটো দুপুরের খাবার পরিবেশন করতে শুরু করে দিয়েছেন
। ড্রয়িং রুমের ঘড়িতে তখন দুপুর ২ টো বেজে গেছে । ভুল বুঝে সময়টা মিলিয়ে নিলাম ।
ভারতের মতই সাদা ভাতের সাথে মাছের পদ ( স্থানীয় নাম মেকারেল
মিযোরে-নি আর পাতি বাংলায় মুলো বাটার সাথে সিদ্ধ করা মেকারেল মাছ ) সাথে কিছু সিদ্ধ
আলু আর শাকপাতা । মিঃ ইটো আনন্দের সাথে খেতে খেতে বললেন , “ রাতে ফগু মাছের আইটেম রান্না
করে খাওয়াবে গিন্নি বুঝলেন ডক্টর ; অসাধারণ রাঁধতে পারে । মনে মনে ভাবলাম মাছে ভাতে
বাঙালীর একদিন সর্ষে ইলিশ খাইয়ে দেখাবো , সিদ্ধ করা মাছ খেতে ভুলে গিয়ে আঙুল চাটতে
থাকবেন ।
৩
পরের দিন সকাল । এখানকার সকাল মিষ্টি সকাল , ফুরফুরে হাওয়া
। প্রসঙ্গত বলে রাখি গত রাতে ফগু মাছ কপালে জোটে নি । তার অন্যতম কারণ বিকালে হসপিটাল
থেকে ফোন আসে ,যে মিঃ ইটোর বাবার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে ।
ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে আমিই মুখ খুললাম , “ আপনার বাবার ঠিক
কী হয়েছে মিঃ ইটো ?” এক মনে স্যান্ডউইচ চিবোতে চিবোতে খানিক পরেই বললেন , “ ডক্টর যে
কারনে আপনাকে আমার এখানে আসার অনুরোধ করেছি তা আমি সবই বলব ।“ একটু থেমে পুনরায় বললেন
, “ এখন অফিসে বেরোতে হবে । আমার মিসেসে ছুটি নিয়েছেন । আপনি ওর সাথে এদিক ওদিক ঘুরে
আসতে পারেন , রাতে কথা হবে ।“ ওর কথায় বুঝলাম , বাবার বিষয়টা সুন্দর ভাবে এড়িয়ে যেতে
চাইছেন । আমিও আর জোর করলাম না ।
কিছুক্ষণ আগে রিকু আর মিঃ ইটো বেড়িয়ে পরলেন । এক মিনিটও দেরী
করতে জানেন না জাপানীরা । মিসেস ইটো আমাকে জানিয়ে গেলেন পাশের ঘরটা লাইব্রেরী রুম ।
একদিকে ভালোই হল । মিঃ ইটো জীবনে কী কী করেছেন আমার জানা নেই তবে অসাধারণ সব বইয়ের
কালেকশন । মূলত সবই জাপানী ভাষায় লিখিত তবে র্যাকের একটা ধারে এসে চোখ আটকে গেল –
“ হাগাকুরে ।“ বইটি হাতে তুলে নিয়ে দেখলাম বেশ পুরনো সংস্করণ । ইংরাজিতে লেখা সামুরাইদের
আধ্যাত্ম ও ব্যবহারিক দিক তুলে ধরেছেন লেখক । একটা চেয়ার টেনে চোখ বুলাতে লাগলাম ।
অদ্ভুত ভাবে খেয়াল করলাম বইটার অনেক জায়গায় পেন্সিল দিয়ে দাগ টানা ।
এক-দু জায়গায় লাল কালিতে “ সেপ্পুকু “ আর “টান্টো” শব্দে
মোটা করে দাগ । পাঠকের মনে এমন কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল বোঝার জন্য গভীর ভাবে পড়তে শুরু
করলাম । খেয়াল নেই সময়ের । মিসেস ইটো দরজায় নক করে ভেতরে আসলেন । আমার দিকে হাঁসি মুখে
জানতে চাইলেন , “ খুব বোর হচ্ছেন বলুন !” আমিও প্রত্যুত্তরে হেসে মাথা নাড়িয়ে না জানালাম
। ভদ্রমহিলা অদূরে রাখা আরেকটা চেয়ার টেনে বললেন , “ আসলে এটা আমার শ্বশুরের লাইব্রেরী
রুম । অসুস্থ হলেও দিনে একবার অন্তত আসা চাই-ই ।“ কথাটা শেষ করে র্যাকের আরেক প্রান্তে
রাখা একটা ছবির ফ্রেম দেখালেন ।
“ সামুরাই ! উনি সামুরাই ! “ আমি ছবিটা দেখিয়েই বললাম ।
“ ছিলেন একসময়ে মিঃ রায় । ৯৯ পেরিয়েছেন গত জানুয়ারিতে ।“
কথার খেই ধরেই বইটা পাশে সরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম , “ উনি কী
কোন কারনে ডিপ্রেশনে আছেন ?”
আমার কথাটা শুনে কিছুটা অবাক যে হয়েছেন তা ওনার মুখই বলে
দিচ্ছিল । তাও সংযত ভাবেই উত্তর দিলেন , “ বাবার বন্ধুর নাম টয়টমি টানাকা মাঝেমধ্যেই
আসতেন । গত মাসে দুই বৃদ্ধের মধ্যে বাকবিতণ্ডা শুরু হয় । মাঝে কিছুদিন আমি আর মিঃ ইটো
জাপানের পশ্চিমে বেড়াতে যাই । বাড়ীতে রিকুই ছিলো । কলেজের পরীক্ষার জন্য যেতে পারে
নি …
“ সেদিন আজও ভুলবো না ডক্টর ! বাড়ীতে যখন ঢুকলাম , দেখি মেঝেতে
পরে আছেন বাবার বন্ধু । পেটটা গভীর ভাবে কাটা । হসপিটালে নিয়ে গেলাম কিন্তু বাঁচাতে
পারলাম না ।“ মিসেস ইটোর গলায় হতাশা আর বিষণ্ণের ছাপ । বুঝলাম এই কারনেই তার শ্বশুর
অসুস্থ হয়ে পড়েছেন কিন্তু মৃত্যুর কারণটাই বা কী ? মনের মধ্যে প্রশ্ন থেকেই গেল ।
ভদ্রমহিলা আর কোন কথাই বললেন না । যেমন নিঃশব্দে এসে ছিলেন
ঠিক তেমনই বেড়িয়ে গেলেন ।
৪
সন্ধ্যে ঠিক ছটার মধ্যে বাড়ীর সকলেই চা খান একসাথে । আজও
ব্যতিক্রম হয় নি । মিঃ হারু নিজেই বললেন , “ ডক্টর । আপনি ঠিকই ধরেছেন বাবা ডিপ্রেশড্
। মিসেস সবই বলেছে আমাকে । বর্তমানে বাবা ‘ হিকিকোমোরি’তে আক্রান্ত । তাছাড়া , ওই ঘটনার
জন্য টয়ট্মি আঙ্কেলের ছেলে ধমকিও দিচ্ছে ।“
হিকিকোমোরি হীনমন্যতা আর লজ্জা থেকে উদ্ভূত মানসিক ব্যাধি
। আমি এই সময়ে ছোট্ট একটা কাগজের টুকরো পকেট থেকে বার করে দিলাম । মিঃ ইটো রিডিং গ্লাস
দিয়ে পড়ে ফ্যাকাশে মুখে নিজের স্ত্রীর হাতে তুলে দিলেন । মিসেস ইটো অস্ফুট শব্দে বললেন
, “ জিসেই ! “ আমি ওনার দিকে তাকাতেই মিঃ হারু ইটো বললেন , “ মৃত্যুর কবিতা । সামুরাই
হারিকিরি করার আগে এমন কবিতা লেখেন … আপনি পেলেন কোথায় ?”
আমি সোফায় পিঠটা একটু টানটান করে বললাম , “ আচ্ছা মিঃ আকিফুমি
অর্থাৎ আপনার বাবা আমার লেখা জার্নাল কীভাবে পেলেন কারণ জার্নালটা বেশী পুরনো নয় !”
হারু ইটোর মুখে এতক্ষণ পর হাল্কা হাসির আভাস দেখা দিল । বললেন
, “ আসলে আমার বৈজ্ঞানিক হওয়ার পিছনে বাবার অবদান সব থেকে বেশী । তাছাড়া আপনার মমি
কান্ড আর আমেরিকায় ট্যানিফ্লরার কান্ড সারা পৃথিবীতে হইচই ফেলে দেয় । আপনার রিসেন্ট রিসার্চ
সিঙ্গুলেট জাইরাসের কথা পত্রিকায় বেরোতেই নিয়ে আসি পড়তে । বাবাও পড়তে চান এই দুঃখ দূর
করার বা আবেগ প্রকাশ করার ওষুধের বিষয়ে …
“ বুঝলাম । আমি ওই
মৃত্যুর কবিতা ওখানেই পেয়েছি মিঃ হারু । “ বললাম ঠিকই কিন্তু মিঃ হারুর প্রায় লোমহীন
ভ্রূ কুঁচকেই থাকলো । আবারও বললাম , “ লাইব্রেরীতে হাগাকুরে বইতে উনি কয়েক জায়গায়
লাল কালি ব্যবহার করেছিলেন যার রঙ দেখে খুব একটা পুরনো লাগলো না । আবার হঠাৎ বিজ্ঞানের
পত্রিকা চোখে পরতেই দেখলাম আমার লেখার জায়গায় এই জাপানী কবিতাটা । যদিও কিছুই বুঝি
নি ।“
বিহ্বলতা কাটিয়ে মিসেস ইটো আমার দিকে তাকিয়ে বললেন , “ হারু
বলার আগেই আমি বলি কেন আপনাকে আমরা ডেকেছি…
রিকু এতক্ষণ একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল , এখন মায়ের পাশে এসে
বসল । মিসেসে ইটো মাথাটা সামনের দিকে খানিক তুলে বললেন , “ দেখুন আমিও ওর সাথে দীর্ঘদিন
বিজ্ঞানের সেবায় নিযুক্ত । আপনার লেখা পড়ে বুঝেছিলাম এ এক যুগান্তকারী আবিষ্কার , মানুষের
উপকারে আসবে । সা ( স্যার ) আমরা চাই আপনি মিঃ আকিফুমি উপর প্রয়োগ করুন । উনি নিদারুণ
মানসিক কষ্টের হাত থেকে মুক্তি পাবেন ।“
মিসেস ইটোর সাথে সাথে লক্ষ্য করলাম মিঃ ইটোর চোখেমুখে প্রত্যাশার
ছোঁয়া । আমি বললাম , “ তা কী করে সম্ভব …?”
“ সা , আমি জানি এ শুধু দুঃখ নিবারণের ওষুধ নয় বরং আপনি এক
জায়গায় ছোট্ট করে উল্লেখ করেছেন যে কষ্টের কারনে মানুষ হতাশায় থাকে সেই কারণটাই সিঙ্গুলেট
জাইরেট ভুলিয়ে দেয় ,“ আমার কথা সম্পূর্ণ না করতে দিয়েই মিঃ ইটো বলে উঠলেন । আমি কিছু
বলতে যাবো ঠিক তখনই ডোর বেলের শব্দ আসে । রিকু খুলতে যায় ।
আকস্মিক রিকুর কণ্ঠে চীৎকার জাপানী ভাষায় , “নাজে আনাতা কোকো
নিরু নদেসকা ? ডেরু…!”
মিঃ হিরু ছুটে গেলেন । পিছনে মিসেস ইটো । আমি বোকার মত উদগ্রীব
হয়ে বসেই থাকলাম । খানিক পর দেখি মা ছেলের হাত ধরে টানতে টানতে ঘরে ঢুকছেন । পিছনে
মিঃ হিরুর সাথে বেশ উত্তেজিত ভঙ্গীতে এক যুবক । যুবক রাগত গলায় বলে , “ এত বড় সাহস
কী করে হয় যে রিকু বলে আমি কে ? বেড়িয়ে যেতে
বলে ? শোনো , আমি বলে দিচ্ছি আমার বাবা নিজে পরম মৃত্যুর হাতে যান নি , তাকে তোমরা
হত্যা করেছ ।“ কথাটা শেষ করে আমার দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে অদ্ভুত হাঁসি হাসে যুবক ।
“ ওহ মিঃ রায় আপনার ছবি কয়েকবার দেখেছি । কী যেন নাম…? সিঙ্গু…হ্যা
মনে মনে পরেছে সিঙ্গুলেট খাওয়ানোর পরামর্শ দিচ্ছে বুঝি আমাদের , যাতে সব ভুলে যাই
…অ্যাঁ …।“
মাথা ঠাণ্ডা রেখে বোঝার চেষ্টা করলাম আমার এই নতুন আবিষ্কারের
জল অনেকটাই গড়িয়েছে । সংযত গলায় উত্তর দিলাম , “ দেখুন আপনাকে চিনি না আর তাছাড়া এমন
কোন প্রস্তাব এরা আমার কাছে রাখেন নি ।“
“ উঁহু , ডোন্ট বিলিভ দেম ,বরং আপনি আমার সাথে যোগাযোগ রাখুন
ডলার পাইয়ে দেব আর ওদের দিকে থাকলে…হ্যা হ্যা…” অদ্ভুত গলায় হাঁসতে হাঁসতে যুবকটি যেমন
ভাবে এসেছিল ঠিক তেমন ভাবেই খানিকটা টলতে টলতে বেড়িয়ে গেল । ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি
হয়ে গেল যে বাড়ীর সকলেই স্তম্ভিত ।
আমি মিঃ ইটোর দিকে তাকাতেই উনি আমার হাত দুটো ধরে বললেন
, “ ও হল টয়ট্মি আঙ্কেলের ছেলে আকিও । আপনার কথা , আবিষ্কার সবই আলোচনা করতাম যেহেতু
ওরা বাবার বন্ধুর পরিবার। কিন্তু এই ঘনিষ্ঠতা এমন বিপর্যয় ডেকে আনবে বুঝতে পারি নি
।“
আমি শান্ত গলায় বললাম , “ মিঃ ইটো আমি অধ্যাপক । বিজ্ঞানের
সৃষ্টি আমার ব্যাবসা নয় । আপনি আমার দ্রুত ফিরে যাওয়ার ব্যাবস্থা করুন ।“ কথাটা বলে
নিজের বেডরুমের দিকে হাঁটা লাগালাম ।
৫
এখন আমি
কলকাতায় । কিছুদিন আগেই ফিরে এসেছি । নিজের ল্যব্রেটরীর ঘরেই বসে । সেইদিন রাতটা
বিভীষিকাময় ছিল । খেয়ে শুতে একটু দেরী হয়েছিল । রাত কটা হবে জানি না । বেডরুমে
হাল্কা টোকা
পরার শব্দ কানে যেতেই আলো জ্বালালাম । খুলতেই দেখি রিকু
দাঁড়িয়ে আছে , কিছু যেন বলতে চায় ।
বসতে বলে
জিজ্ঞেস করলাম , “ কিছু বলতে চাও ?” রিকুর বক্তব্যের মূল কথা তুলে ধরছি । দাদুর
সাথে তার ব্যাবহার বন্ধুর মত । বাল্য বন্ধু টয়টমি টানাকার সাথে বুশো অর্থাৎ
সামুরাই বিদ্যা শিখেছিলেন টয়টমির বাবার কাছে একদম ছোট্ট থেকেই । মাত্র ১৭ বছরের
মাথায় তারা একটি নাটক করেন ‘ মার্কোপোলো ব্রীজ ’। আর এই নাটকের আড়ালেই দ্বিতীয়
চীন-জাপানের যুদ্ধ বাধে ১৯৩৭-এ
। ঠিক এক বছরের মাথায় দুই বন্ধু মিলিটারিতে ভর্তি হন এবং যুদ্ধে
অংশগ্রহণ করতে পারেন তাদের ওই বিদ্যার দৌলতেই ।
কালের
পরিহাস খুবই নিষ্ঠুর । টয়টমি ধীরে ধীরে চীনের কাছে কাঁচা পয়সার লোভে বিক্রি হয়ে
যান । দাদু আকিফুমি খুবই আহত হন এই ঘটনায় । বারবার তিনি বোঝান , এটা সামুরাইদের
ধর্ম নয় । কিন্তু শোনে কে কার কথা ! অনেক পরে অবশ্য টয়টমি অনুতপ্ত হন ,ততদিনে যা হওয়ার হয়ে গেছে । দাদু মনে
প্রানে ঘৃণা করতেন তার বাল্য বন্ধুকে । বয়স বাড়তে থাকে । আবার যোগাযোগ স্থাপন হয় ।
কথাগুলো মন
দিয়ে শুনছিলাম । ঠিক তখনই ইয়েল লক খোলার হাল্কা শব্দ কানে আসে । রিকু খুলতেই মাথা
আর মুখে কাপড় জড়ানো একজন হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকেই শক্ত একটা কাঠের ব্যাটন দিয়ে সজোরে
মাথায় আঘাত করে বসে । রিকু চোখের সামনে পরে যায় , মাথা দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে জামা ভিজিয়ে তোলে
। আমি হতভম্ভ ! মিঃ আর মিসেস ইটো তারা কোথায় ? কথাটা ভাবছি নিজের অজান্তেই । লোকটা
ব্যাটন তুলে আমার দিকে এগিয়ে আসে ।
“ ডক্টর রায়
সিঙ্গুলেট জাইরাস আমাকে দিন । আপনি যে সঙ্গে এনেছেন রিকু আমাকে আগেই জানিয়েছে । ও
ভেবেছে আপনাকে ভুলিয়ে জিনিষটা হাতাবে , সে আমি করতে দেব না ।“
অবাক হওয়ার
পালা । একটু আগেই কথা বলছিল যে শান্ত ছেলেটা তার মনেই...। ছিঃ । জেদ চেপে গেল ,”
না কেউই পাবে না , এটা মানুষের সেবার জন্য আবিষ্কার করেছি ।“
বিছানার পাশেই বেড ল্যাম্পের কাছে একটা ছোট্ট
কাঁচের শিশি রাখা ছিল । শিকারী ঈগলের মত ছোঁ মারতে যেতেই ঘটলো অঘটন । কার্পেটের
মধ্যে পা ফেঁসে উপর হয়ে টয়টমির ছেলে হুমড়ি খেয়ে আমার গায়ের উপর পরে যায় । আমিও টাল
সামলাতে না পেরে উপর হয়ে পরলাম খাটের একধারে ।
মাথার কাছে
ছোট্ট একটা বন্দুক । রিকু মাথার একদিক চেপে আছে আরেক হাতে ৯৯ এম এম গ্লক ২৬ বন্দুকের নল আকিও-র দিকে । আমি
উঠে ব্যাগ থেকে কয়েক ফোঁটা সিঙ্গুলেট জাইরাস আকিওর মুখে ঢেলে দিলাম । খানিকক্ষণ
রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতেই অদ্ভুত গলায় হেসে উঠলো । সেই রাগ হিংসা উধাও । বরং
শান্ত একটা ভাব । বুঝলাম কাজ হচ্ছে । বাইরে রাখা শিশিটাকে ভেবেছিল আমার সেই
ওষুধ ।
বাইরে
বেরিয়ে এসে দেখি মিঃ আর মিসেস ইটো অচৈতন্য । ইমারজেন্সি সার্ভিসে ফোন করে অতঃপর
হসপিটালে রওনা হলাম । বলে রাখি ভালো
ছেলের মত আকিও খুবই সাহায্য করেছিল নিয়ে যেতে ।
বৃদ্ধ আকিফুমিকে
বাঁচানো যায় নি । জরা তাকে গ্রাস করেছিল । তবে পরের দিন মারা যাওয়ার আগে বলে গেছিলেন
, “ অহংকার চলে গিয়ে যখন প্রায়শ্চিত্য বোধ জেগে ওঠে তখনই প্রকৃত চৈতন্য জেগে ওঠে ।
হাগাকুরে তাই তো শিখিয়েছে ।“
বৃদ্ধের ইশারায় তার দিকে এগোতেই তিনি আমার হাত দুটো ধরে বললেন
, “ সা , জেইসিটা লিখেছিল টয়টমি । ওই দিন নিজেই টান্টো দিয়ে নিজের পেট চীরে সম্মানজনক
মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে প্রকৃত সামুরাইয়ের পরিচয় দেয় । বিগত সকল ভুলের মাফ প্রভু যেন
ওকে করেন ।“
মিঃ ইটো আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন সজল চোখে । আমি সান্ত্বনা
দিয়ে বললাম , “ মিঃ ইটো , ওষুধ সকল রোগের নিরাময় নয় । পরজন্ম বলে যদি কিছু থাকে ওঁরা
নিশ্চয় শান্তিতেই থাকবেন ।।“
No comments:
Post a Comment