১
সরু গলিটায় তখনও সূর্যের আলোটা ভালভাবে এসে
পরেনি । সূর্যের সাথে এমনি সম্পর্ক বহুবছর বজায় রেখে চলেছে মিত্তির লেন । আধ পাকা গলিটায় দুটো মানুষ
আড়াআড়ি ভাবে চলতে পারে আর মোটা মানুষ হলে একাই যেতে হয় । বৃষ্টি হলে সোনায় সোহাগা
! প্যান্ট , ধুতি ,শাড়ী আধ হাঁটু গুটিয়ে
ছপ ছপ করে মিত্তির লেনের জমা জলে হাল্কা ঢেউ তুলে এখানকার মানুষদের এগিয়ে চলাটাই
অভ্যাস । বলা যায় একপ্রকার অলিখিত রীতি ।
প্রথম প্রথম রাশিকার এই ঘিনঘিনে পরিবেশটা গা
গুলিয়ে তুলত । কিন্তু অভ্যাস নামক মহামানবীর দাস দাসী আমরা সকলেই, তাই রাশিকাও
প্রয়োজনে গায়ের ওড়নাটা নাকে চাপা দিয়ে দুর্গন্ধ এড়াতে সক্ষম হয়ে গেছে । বুকের খাঁজ
স্পষ্ট ভাবে ছেলে বুড়ো আড়চোখে দেখতে দেখতে নতুনত্ব আর কিছু পায় না । হ্যাঁ,
প্রমিতের কাছ থেকে হঠাৎ বেড়িয়ে আসার পর অনেকগুলো চোখ অবশ্যই উপর থেকে নীচ অবধি চেটে
যেত ।
রাশিকা এই মিত্তির লেনের চটলা ওঠা দু’কামরার
ঘরটি বেশ সস্তায় ভাড়ায় পেয়েছে মাস ছয়েক হল । অবশ্য এটি জোগাড় করে দিয়েছিল তারই
অফিসের এক কলিগ । বেজায় চটে গেছিল সেদিন রাশিকা ।
- “ আর জায়গা পেলি না ! জানলা খুলতেই পাশের দেওয়াল , প্রাইভেসি নেই !”
অরুণা হাঁসতে হাঁসতে জবাব দেয় , “ প্রাইভেসি আছে
তো ! ভালোই হয়েছে জানলার পাশে আরেক দেওয়াল তোদের গার্ড দিয়ে রাখবে ।”
- “ থাম !” মুখটা লাল করে রাশিকা চাপা গলায় বলে ওঠে । জীবনে এক টুকরো খোলা
বাতাস সবাই চায় । কে জানবে ভগবান কোন অলক্ষ্যে দেওয়ালের পর দেওয়াল তুলে দেয় ।
প্রেম ভালোবাসা অমূল্য সম্পদ ! ভাবতেও এখন হাসি পায় রাশিকার ! অতি আদর অতি কেয়ারিং
কী একটা দেওয়াল ! কে জানে ! তবে রাশিকা এইটুকু বুঝে গেছে , সম্পর্কের সংজ্ঞা যদি
একটা মানুষের স্বাভাবিক গতিপথকে রোধ করে দিয়ে শুধুমাত্র টিকিয়ে রাখা হয় তাহলে ,
মানুষের ছোট্ট এই প্রাণ খাঁচায় বন্ধী পাখীর মতি মাথা খুঁড়ে মরে ।
- কী রে ভাবছিসটা কী বলত ? দ্যাখ , প্রাইভেট কোম্পানির ওই সামান্য টাকায় একটা
বাচ্চা আর ঘর ভারা দিয়ে এর থেকে ভাল আর কিছু আশা করতে পারিস না !”
রাশিকা এর উত্তর সেদিন দেয় নি । উত্তরটা দিতে গিয়েও গলার মধ্যে পুঞ্জীভূত এক রাশ
কথা দুহাত দিয়ে মুখটাকে বন্ধ করে দেয় । আর তারপর থেকেই নিজেকে আর ছ’বছরের মেয়েকে নিয়ে আবার মানিয়ে নেওয়ার পালা করে চলেছে । হয়ত এখানেই জীবনের
তিন ভাগ কাটাতে হবে । পরে থাকা একভাগের ভবিষ্যৎ ভেবে লাভ নেই ! তবে জীবনের আবর্তে
লড়াইটা প্রতিনিয়ত যে ভাবে আবর্তিত হয় এবারে তার জোড়ালো দাবীদার হতে রাশিকার আর কোন
বাধা নেই ।
২
প্রমিতের সাথে যে রাশিকার বিয়ে হতে চলেছে খবরটা
দিতেই মনোরমা দেবীর মুখে ক্রমশ হাসি ছড়িয়ে যায় । যাক প্রমিতের পছন্দ হয়েছে !
- “ বুঝলে , প্রমিতের মা অবশ্য সামান্য কিছু চেয়েছেন কিন্তু প্রমিত বাধা
দেওয়াতে আর কিছু বলেন নি ” ডিউটি থেকে ফিরে জুতো খুলতে খুলতে মনোরঞ্জন বাবু
স্ত্রীকে বলেন ।
- “ আহা , সে কী দেব না নাকি , সামান্য হলেও তো দিতেই হয় ।”
- “ হুম ” ছোট্ট উত্তরটি এক বুক শ্বাস ছেড়ে মনোরঞ্জন বাবু দিয়েই বেড়িয়ে যান স্নান
ঘড়ের দিকে ।
কাঁটা তার পেরিয়ে মানুষের সংগ্রাম কী যে ভয়ঙ্কর
সেটা বোঝে না অনেকেই । দেশভাগ , দাঙ্গা , কম বয়েসী বড় মেয়েটার আব্রু রক্ষা করে আর
পোয়াতি বউকে নিয়ে ভোরের বনগাঁ লোকাল ধরে শেয়ালদা ষ্টেশন আসেন মনোরঞ্জন বাবু বেশ
কিছু বছর আগে ! মনে পরে , গাদাগাদি ভিড় । প্রতিটি মানুষ একটা পা রাখার জন্য
আরেকজনের হাতের উপর দাঁড়িয়ে থাকে । দয়ার স্থান তখন মাথায় । শুধু চিন্তা একটাই
বাঁচার । আজ হয়তো এগুলি ইতিহাস আর কারখানায় কিছু সুহৃদদের ‘ কাঁটাতার পেরনো পাবলিক
’ বলে ব্যাঙ্গের খোঁচা !
রাশিকা সেই পোয়াতি বউয়ের মেজো মেয়ে । তারপর আরও
তিনটি হয়েছে মা ষষ্ঠীর অসীম কৃপায় ! শেষেরটা ছেলে । কষ্টের ধুলোয় মাটিতে ঘামে একটু
একটু করে বড় করে তুলেছেন মনোরমা দেবী । মনোরঞ্জন বাবুর মাইনের থেকে স্ত্রী মনোরমা
দেবী কিছু বাঁচিয়ে রাখতেন লুকিয়ে চুরিয়ে ! পুরুষ মানুষের নানা সঙ্গ ও অঙ্গ দোষ
থাকে ; মনোরঞ্জনের সে সব না থাকলেও দয়ার হাতটা একটু বেশীই । সুতরাং , এই হাতসাফাইটাকে
সযত্নে লালন পালন করতেই হয়েছিল মনোরমা দেবীর ।
প্রমিতের সাথে আলাপ রাশিকার আগে থেকেই ছিল । ভালোবাসার নরম চাদরের
বুনট মনের মধ্যেই বুনে চলেছিল সে । ভেবেছিল , প্রমিত আগে বলুক । কিন্তু প্রমিতের মুখ থেকে
ওসব আই লাভ ইউ মার্কা কথা কোনদিনই বেরোয় নি । উল্টে , ঘামে ভেজা জামার গন্ধ ভিড়
ঠাসা লোকাল ট্রেনে রাশিকার নাকের কাছে আসতেই নিজেই বলে দিত , “ কিছু করার নেই , এ ভাবেই
যেতে হবে , পারলে দম আটকে রাখ ।”
এভাবেই চলতে চলতে ট্রেনের চাকা জীবনের এক মাঝের
ষ্টেশনে থামার মতই আসে এই বিয়ের প্রস্তাবে । রাশিকার মনে খুশীর হাওয়া কুলকুল করে
ভেসে ওঠে আগামী দিনের স্বপ্নে । প্রমিতের ভালবাসাটাই এমন । পরিশ্রমী ছেলে , একটু
ঠোঁট কাটা, ন্যাকামি কম এসব গুণাবলী কোন মেয়ের না ভাল লাগে !
মনোরমা দেবী উঠে পরে লেগেছেন এমন দুর্দিনে
বাজারে একছেলের পরিবার পেয়ে । তাদের রাশিকের কপালে এমন জুটবে ভাবতেও পারে নি !
- “ বুঝলি রাশি , তোর কপাল যে এতটা ভাল, লোকে হিংসা করবে ; তোকে নিয়ে তো কম
কথা শুনতে হয় না ! বোকা , কথা বলতে জানে না কত কথা ...!” মনোরমা দেবী মেয়ের চিবুকে
হাত বোলাতে বোলাতে বলে যান ।
এ কথা সত্যি রাশিকা একটু বোকা । জীবনের হিসাব
নিকাশ কম বোঝে । তবে তার কয়েকটি মহা গুণ আছে , সে ঠাণ্ডা প্রকৃতির , স্বল্প চাহিদা
, ঘর সাজাতে ভালোবাসে , গানের গলা দিব্যি খাসা । এসব তার জন্মগত । তবে জন্মগত
প্রতিভাগুলি অচিরেই শুকনো কাঠে পরিণত হয় ; কে দেবে মর্যাদা এসব এই চলতি বাজারে !
৩
- “ এই রাশি জায়গা রেখেছি, এদিকে আয় ,” রাই ট্রেনের কামরা থেকে চেঁচিয়ে ওঠে ।
কোনমতে গুঁতোগুঁতি করে, কয়েকটা জাম্প মেরে এগিয়ে
যায় রাশিকা । ঘামটা মুছতে মুছতে বলে , “ কী রে কে মরল আবার , এত লেটে ঢুকল !”
- “ ও কে যেন লেভেল ক্রসিংটা পার হচ্ছিল আর ব্যাস...” রাই হরহরিয়ে বলতে থাকে ।
এ লাইনে এসব রোজনামচা । একটু হইহই তারপর খবরগুলো ধীরে ধীরে বাসি ঠোঙার মত এদিক
ওদিক নেতিয়ে পরে থাকে ।
রাই পরের ষ্টেশনে নামতেই জানলার ধারে সরে আসে
রাশিকা । কয়েকটা চুলের গোছা মুখের উপর উড়তে থাকে হাওয়ায় । নোনতা জলগুলো টুকরো
টুকরো নুনের দানার মত লেপ্টে থাকে পরজীবীর মত সারা শরীরে ।
রাশিকার দৃষ্টি চলে যায় জানলার বাইরে । পুরনো
দৃশ্য আজ আবার নতুন । যে পুকুরটায় কাল একটু বেঁচে থাকা জল দেখেছিল , আজ তা ছাই আর
মাটিতে ভরাট । বিয়ের পর রাশিকাও মানিয়ে নিয়েছিল প্রমিতের সংসারটা । চেষ্টা করেছিল
মনের মত গড়ে তোলার । প্রমিত যে এ ব্যাপারে সাহায্য করে নি তা বলা ভুল । বেচারা
সারাদিন হাড় ভাঙা খাটনি খেটে যতটা পেরেছে দিয়েছে । মাস মাইনের টাকাটা কোনদিন আগেই
বউয়ের হাতে তুলে দেয় নি , মায়ের স্থান সর্ব প্রথম । ঠাকুরের আসনে খামটা ঠেকিয়ে ছেলের হাতে তুলে দিতেন
রাশিকার শাশুড়ি’মা ।
- “ প্রমিত , বেশী খরচাটা একটু বন্ধ কর , নতুন ডেসিং টেবিল তো আর বৌমার বাড়ী
থেকে এলো না !” সামান্য কথাটা বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেন ।
সত্যিই একজোড়া শাড়ী, খাট ছাড়া আর কিছুই দিতে
পারেন নি রাশিকার মা-বাবা । হাজার হলেও বাকী দুটো তো আছে !
- “ আমার জন্য তোমার খুব কষ্ট করতে হচ্ছে বল ” কথাটা প্রমিতের পিঠে হাত রেখে
ধীরে ধীরে বলে রাশিকা ।
- “ আরে না না মায়ের কথাটায় কিছু মনে কর না, তবে বুঝতেই পারছ আমার একার রোজগার
।”
রাশিকা বেশী কিছু চায় নি আর । প্রমিতও নিয়ম
মাফিক বউয়ের মনের কথার মাপ বুঝে এনে যেত । অবশ্যই খুশী হত রাশিকা । আর খুটখাট
অশান্তি শাশুড়ি বৌয়ের , এ এক চিরকালীন ধর্ম ! মেয়ের মত আর মেয়ে , একটু তো পার্থক্য
থাকবেই । তাও বাঁচোয়া ননদ , দেয়র নেই ! অবশ্য এই খোঁচাটা শুনতে হত প্রমিতের কাছ
থেকে মাঝে মধ্যে ।
-
“ দিদি আপনার মনে হয় চলে আসছে
” পাশ থেকে আরেক ডেইলি প্যাসেঞ্জার বলে ওঠেন । সচকিত হয়ে ওঠে রাশিকা । কখন যে এতটা
রাস্তা হুস করে পেরিয়ে গেল ! একটু উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই প্রায় ধাক্কা দিয়ে বসে
পরে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীটি । এখন আর এসব গায়ে লাগে না বিশেষ । স্থান ছেড়ে তোমাকে
দিতেই হবে , তা জীবন হোক আর ট্রেনের কামরাই হোক । ভাবনার গতিকে আপাতত শিকেয় তুলে
তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে নেমে পরে রাশিকা তার নির্ধারিত ষ্টেশনে । কী চমৎকার ভাবে এখন
অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে । কলেজ লাইফে প্রমিত আগে থেকেই একটু গার্ড করে দাঁড়াত রাশিকার
অজান্তেই ; আর এখন রাশিকা নিজের গার্ড নিজেই করে । প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াতেই ভোঁ করে
হাল্কা গম্ভীর শব্দ করে আপ লোকালটি বেড়িয়ে যায় ।
৪
কানা মিত্তির লেনের সাক্ষী গোপালের মত স্ট্রিট
বাল্বটা আজ কদিন ধরেই কষ্ট পাচ্ছিল , আজ নিশ্চুপ বিদ্রোহ জানিয়েছে । কোনমতে অন্ধকারটা
হাতড়ে বাড়ী ঢোকে রাশিকা । সারাটাদিনই প্রায় ছোট্ট বাচ্চাটা তালাবন্ধী । অবশ্য ,
মাঝে মধ্যে পাশের বাড়ীর কাকিমা তালা খুলে দেখে যান, এই যা রক্ষে । এই ভাড়ার বাড়ীতে
আসার মাস দুয়েকের মধ্যে এই সহৃদয়া মহিলাটি মোটামুটি সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন ।
অগত্যা দায় যখন শুধু রাশিকার তখন তা নিতে খুব একটা কুণ্ঠা বোধ করে নি । ঘরে ঢুকেই
মেয়েকে জড়িয়ে ধরে । আদো আদো গলায় এক বিক্ষুব্দ প্রতিবাদ ওঠে , “ আজ কেন এত দেরীতে
এলে, আমার বুঝি ভয় করে না !”
চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে তোলে মেয়ের দু’গাল । এই টুকু
মেয়েকে কী করে বোঝায় , কোম্পানির বস’দের নানা ‘ হাত ’ থাকে ! তারপর ট্রেন লেট !
- “ আচ্ছা বাবা আর রাত হবে না ” কান ধরে মিথ্যে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে ওঠে
রাশিকা । এ অভিনয়, এ মিথ্যা সুখের ; যা একটি বাচ্চার হৃদয়ে প্রতিফলন হিসাবে চীরস্থায়ী ভাবে থেকে যায় ।
স্নান সেরে মেয়েকে পড়াতে বসে রাশিকা । কটাদিন
পরেই পরীক্ষা শুরু । ষ্টোভে প্রেসার কুকার বসাতে যায় । মা – মেয়ের সিদ্ধ ভাতই
যথেষ্ট । প্রতিদিন ফলমূল খাওয়ানোর সাধ্য নেই । যদি হয় এমনই হবে । প্ল্যাটফর্মের
ফোঁকরে কত লোক তো দিব্যি ঘর ফেঁদে থাকে । তারাও যদি লড়াই করে টিকে থাকতে পারে
তাহলে রাশিকা তার মেয়েকে নিয়ে থাকে রাজপ্রাসাদে ।
রাশিকা বোঝে , মন নামক বস্তুটিকে আমরা স্বান্তনা
দেই না , দেই মিথ্যের ফাঁকি । যাকে নিজেদের আত্মতৃপ্তির জন্য বলি ‘ মনকে বুঝ দেওয়া
’ ! সত্যিই হাস্যস্কর এ জীবন ।
কয়েকদফা প্রেসারের সিটিটা চিৎকার করে উঠতেই
রাশিকা কলের কাছে নিয়ে সেটি । কুকারের মাথায় জল ঢালতেই ফস করে উঠে একরাশ ধোঁয়া । ছোট্ট কামরা দু’খানকে ভাতময় গন্ধে ভরিয়ে তোলে ।
মেয়ের কাছে ফিরে এসে আবার বসে সে । বইটা তুলে
ধরে ভ্রূ নাচিয়ে জানতে চায় , “ কী রে মুখস্থ হল ?” মেয়ে কাঁধ নাড়াতেই রাশিকা আবার
বলে , “ এবার লেখ না দেখে ।”
জানলাটা অনেকক্ষণ বন্ধ । খুলতেই পাশের বাড়ীর
কাকিমার আক্রোশময় ধ্বনি ভেসে এল । রাশিকা একটু ঝুঁকে বোঝার চেষ্টা করতেই বুঝল , এ আক্রোশ নয় ! বেস্পতিবার , লক্ষ্মীর প্রতি
গলা সাধা । যেন আকুল বেকুল করা স্বর, এবারে মা মুখ তোল ! মা লক্ষ্মীর কানের ভিতর
দিয়ে মরমে পশিয়া তোলা ! জানলার ধারে মুচকে মুচকে নিজের মনেই হেসে ওঠে ।
একটু গলা জিরিয়ে আবার কাকিমার আক্রমন –
‘... শ্বশুর শাশুড়ী প্রতি নহে ভক্তিমতি ।
বাক্যবাণ বর্ষে সদা তাহাদের প্রতি ।।
স্বামীর আত্মীয়গণে না করে আদর ।
থাকিতে চাহেগো সদা হয়ে স্বতন্তর ।।
লজ্জা আদি গুণ যত নারীর ভূষণ...’
হাওয়াটা বন্ধ হয়ে যেতেই পাল্লা দুটো টেনে আটকে
দিল রাশিকা । একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও প্রতি বৃহস্পতিবার সেই প্রাচীন কথামালা ! ‘
সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে ’, এটা কী এক তরফা কেবল ! প্রমিতের সংসারে সেও তো বার
বার শুনে এসেছে ‘ রাশি তোমার দ্বারা কিচ্ছু হবে না , একটা বাজারের হিসাবও ঠিক করতে
পার না !’
মাঝে মধ্যে বউকে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করে
ব্যাঙ্ক , বাজার পাঠাত প্রমিত ; যাতে তার অবর্তমানে রাশি নিজের কাজ নিজেই করতে
পারে । প্রমিতের এই শিক্ষায় হয়ত কোন ভুল ছিল না , ছিল পদ্ধতির ত্রুটি । তাই রাশি
এদিক থেকে ওদিক হলেই শুনতে হত , ‘ তোমাকে বিয়ে করেই ভুল করেছি ; বানী , তোমার
বান্ধবীকে দেখ তো !”
বানী প্রমিত আর রাশিকার কলেজ ফ্রেন্ড । বানী এ
সব ব্যাপারে একদম চৌখোস ! বাজার হাট থেকে শুরু করে মাসকাবারি হিসাব নিকাস সব কলমের
ডগায় । সত্যিই রাশিকা বানী নয় । তবে স্বামীর এই আক্ষেপ তিলে তিলে রাশিকার মনকে
নীলচে এক সর্পিল বক্র রেখার জটিল বোধের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল নিয়ত । সে কী কিছুই জানে
না !!
এ কেমন জীবন ! সাংসারিক টানা পোড়নে একদিকে
প্রমিতের ভালোবাসা আর অন্যদিকে কঠোর বাস্তব বুঝিয়ে রাশিকাকে এক ঘরে করে তোলা !
প্রমিত এটা মনে মনে ভাল করেই জানত , রাশিকার বদলে বাণীর মত কোন মেয়ে তার জীবনে
আসলে ‘ পতিরে করিছে হেলা না শুনে বচন ’ অনায়াসে হতে পারত । লাগত মায়ের সাথে কথার
কুরুক্ষেত্র ! সংসারে দুজনই যদি একটিভ হয় তাহলে পাঁচালীর গলায় কবেই দড়ি ঝুলত ।
৫
প্রমিতের সাথে মিউচিউয়াল ডিভোর্স করতে বাধ্য হয়
নি রাশিকা । কারণ , যে গরল তার আত্মাকে ক্রমশ অকেজ করে তুলছিল , তার থেকেই
শেষবারের জন্য নিজেই কথাটা তুলেছিল সে ।
দমদম থেকে বন্ধুর বিইয়ের নেমন্তন্ন খেয়ে ফিরতে
বেশ রাত হয়েছিল । সাড়ে পাঁচ বছরের মেয়েটাকে কোলের মধ্যে বসিয়ে রেখেছিল প্রমিত ।
প্রায় ফাঁকা কামরা । গ্যালোপিং ট্রেন হু হু করে ছুটে চলেছিল । চাকার তীব্র আওয়াজের
মাঝেই রাশিকা বলেছিল , “ আমি তোমাকে মুক্তি দিতে চাই ।”
এ মুক্তি কাকে দিতে চেয়েছিল ? নিজেকে , না,
প্রমিতকে ! হয়ত নিজের সত্ত্বাকে ! একান্ত স্বার্থপরতা । তবুও নিজে সে করতে পারে,
চালাতে পারে নিজের জীবনকে এটাই হয়ত সেদিন বোঝাতে চেয়েছিল ।
-
“ পাগল ! এক পা চলতে আজও
শিখলে না ” বলেই হেসেই উঠেছিল প্রমিত ।
কিন্তু অদ্ভুত এক জেদ , আত্মবিশ্বাস জেগে উঠেছিল
নিজের মধ্যে । শেষবার প্রমিত বলেছিল , “ তোমরা মেয়েরা সব একা কী করতে পার ? যখন
দশটা লোক তোমাকে একা পেয়ে ছিঁড়ে খাবে ... একা থাকতে গেলেও আত্মরক্ষা জানা উচিৎ...
যতসব ফালতু পেঁচাল ।”
তার কয়েকদিনের মধ্যে রাশিকা জানিয়েছিল তার
অন্তিম মতামত । প্রমিত আর আটকায়নি । মেয়েকে দিতে চায় নি সে কিন্তু রাশিকা সে কথাও
মানে নি ।
পাশের এক সহযাত্রী পেপারটা
পড়তে পড়তে বলে উঠলেন , “ কি যে হচ্ছে আজকাল ! রেপ যেন ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে ।”
সকালের নিত্যদিনের ট্রেনে আজও রাশিকা চলেছে কাজে
। হ্যাঁ , রেপ – ধর্ষণ আজকের নতুন নয় । ধর্ষণ শুধুই কী দেহের ! মনেরও তো ধর্ষণ হয়ে
চলে রাত দিন মুহূর্তে মুহূর্তে , জীবনের সাথে জীবনের, সকলের...।
সজোরে ট্রেনে এক ব্রেক । কিছুক্ষণ বসে থাকতেই
রাশিকা বুঝল আজ কপালে দুর্ভোগ । কখন ছাড়বে জানা নেই , রেল অবরোধ । কষ্ট করে একে ওকে
ধরাধরি করে অন্যদের মত সেও নামে । পাথুরে ট্রেকে হেঁটে চলেছে , যদি ওপার থেকে কোন
বাস পাওয়া যায় । সামনেই বিক্ষুব্ধ জনরাশি , জোর গলায় স্লোগান – ‘ সংগ্রামশীল
মানুষদের উপর অত্যাচার চলবে না ,করতে দেব না ...’
দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে যেতে
হঠাৎ নিস্তব্দ নিঃস্পন্দ লোকাল ট্রেনটির দিকে একটু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় রাশিকা, মনে
মনে হেসে ওঠে । ঘড়ির কাঁটা কখন দশটা পেড়িয়ে গেছে, চাকরীটা থাকলে হয় !!