১
একটু এগিয়ে যেতেই কোমরে একটা চোট পেয়ে কাতরে উঠল ব্যাথায় । দু’চোখ জলে
টই টম্বুর । কিন্তু তার কথা-কষ্ট কেইবা শোনে ! ভাগ্যিস কয়েকজন একটু দূরেই দাঁড়িয়ে
ছিল । কিন্তু তাদের অবস্থা আরো খারাপ ।
ন্যাড়া গোছের যে , তার তো এমন আবস্থা যেন
দেখে মনে হচ্ছে কতকাল খায় নি । গা দিয়ে খড়ি উঠছে । আর ঠিক তার পাশের জন , তার আবার
পায়ে দগদগে ঘা । তবুও তারা কান্না দেখে চুপ করে থাকতে পারলো না । খুব কষ্টে হাওয়ায়
ভর করে একসাথে কোনক্রমে বলে উঠল –
“ ও বোন নদী ! লেগেছে তোমার ব্যাথা –
মানুষগুলো দুষ্টু শোনে না কোন কথা ।
এই দেখ না কি করেছে মোদের হাল –
কেটে নিয়েছে সব গাছেদের ডাল !”
নদী তখন গাছ ভাইদের দিকে তাকিয়ে জল ভরা
চোখে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল –
“ দিন-রাত বালি তুলে করছে চুরি –
জল ফুরিয়ে গেছে কি করে যাব বাড়ী !”
গাছেরা তাকিয়ে দেখলো তাদের নদী বোনের জল
প্রায় শুকিয়ে গেছে । বালি চোরেরা এমন করে বালি খুঁড়েছে যে সাগর মায়ের বাড়ী পৌঁছান
খুবই কঠিন হয়ে পরেছে । তখন সেই রোগা গাছ ন্যাড়া মাথা দুলিয়ে বলে উঠল –
“ ও বোন তুমি আজ বড্ড ক্লান্ত ,
দিন খানেক বিশ্রাম নাও -
বিহিত আমরা করে তবেই হব শান্ত ।”
নদীও বুঝল । সেই যে কবে দূর পাহাড় বাবার
কোল থেকে ঝাঁপিয়ে পরেছে আর মা সাগরের কাছে যেতে গেলে শরীরে বল চাই অনেক ! গাছেদের
অনুরোধ মেনে নদী বোন পাথরগুলোর বুকে মুখ গুঁজে বিশ্রাম নিতে থাকল ।
২
মাঝে মধ্যেই বাতাস দাদা এমন রেগে উঠছে তা
আর বলার না ! দাদার নাক দিয়ে যেন আগুনের হল্কা বেরোচ্ছে । সূর্য দাদু ঘুমাতে গেছে
ঘন্টা খানেক আগেই । পূর্ণিমার আলোয় চাঁদ মামা গাছেদের সাথে কথা বলতে বলতে খানিকটা
ধমকের সুরে বাতাস মামাকে জিজ্ঞাসা করে বলে –
“ ভাগ্নে বাতাস কেন এত রাগ আজ ?
ঠাণ্ডা মাথায় হয় সকল রকম কাজ ।”
মামার কথা শুনে ফুস ফুস করে শব্দ তুলে আরও
ক্ষেপে ভাগ্নে বাতাস জবাব দিল –
“ মামু ! জানোই তো সব –
কেন করি এত কলরব !
মানুষগুলো আমার গায়ে দিচ্ছে নোংরা ,
শরীরের জ্বালায় জ্বলে গেল চামড়া !”
চাঁদ মামা , গাছ ভাই সবাই বাতাসের দুঃখের
কথা জানে । সারা শরীরে কত কি বিষাক্ত জিনিষ ছড়িয়ে দিচ্ছে ! চাঁদ মামার কাছ দিয়ে এক
টুকরো মেঘ সেই সময় ভেসে যাচ্ছিল । ওদের কথা শুনে মামার মুখের কাছে এমন করে থমকে
দাঁড়াল যাতে মনে হল , চাঁদ মামার মুখটা অভিমানে দুঃখে কালো হয়ে গেছে ।
মামা থম মেরে খানিক পরে বলল –
“ ভাগ্নেরা বুঝি রে সব নানা বহর –
আমার জমিতেও বানাচ্ছে বাড়ী-শহর !”
সেই দিন অনেক রাত ধরে গাছ , চাঁদ , মেঘ ,
বাতাস সকলে মিলে জোরদার মিটিং সারল । রাতের তারারা আসরে আজ যোগ দিয়েছে । শেষে
ধ্রুবতারা গলা ঝেড়ে বলে উঠল –
“ আমার এ সংসারে বড়ই হচ্ছে অনাসৃষ্টি –
মানুষকে শিক্ষা দিতে সজাগ রাখো দৃষ্টি ।”
ধ্রুবতারার কথা সহজে ফেলবার না । বয়েস হয়ে
গেলেও হাসি তার লেগেই থাকে । তাকে দেখে অনেকেই শিক্ষা নেয় । তাই এই দিদিমার কথা
আদেশ হিসেবেই মানে সকলে । আর মনে সবাই প্রতিজ্ঞা নিয়ে বসল পরবর্তী প্ল্যানটা সফল
করার জন্য ।
৩
পাখীদের প্রথম ডাকের সাথে সাথে দূরে একটা
একঘেয়ে শব্দ ভোরের হাওয়ার সাথে মিশে যেতে থাকে । ঝুপ ঝাপ আওয়াজের সাথে সাথে একটার
পর একটা ট্রাক বালি বোঝাই হয়ে চলেছে ।
ঘাম মুছতে মুছতে একজন অপর জনকে দম নিয়ে
বলে , “ ভাই , আকাশটা আজ মেঘলা , জ্যাক এক্তু ঠাণ্ডায় কাজটা চটপট সারা যাবে ।”
- “ তা আর বলতে ! মেঘের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে
বৃষ্টি হলেও হতে পারে !” অপরজন হাল্কা হেসে বলে ।
তারপর আবার শুরু করে বালি খোঁড়ার কাজ ।
এমন সময় একদল মেঘ সূর্য দাদুকে ফিসফিস করে বলে –
“ ও দাদু অনেক দিয়েছ আলো –
আজ ঘুমাও , শরীর থাকবে ভাল ।”
দাদু আর করে কী ! বয়েসও হয়েছে অনেক ,
কোনদিন ছুটি নেয় নি আজ অবধি । তবে আজ কী ভেবে মেঘ নাতিদের দিকে মিটিমিটি হেসে বলে –
“ বেশ কথা মেঘ নাতি –
পরে না হয় জ্বালাব বাতি ।”
কথাটা সারতেই বাকি মেঘের দল বাতাসে ভর করে
সারা আকাশ ভরিয়ে দিল । দেখতে দেখতে প্রায় অন্ধকার হয়ে গেল চারিধার । গত রাতের
যুক্তি মত আকাশ-পাতাল কাঁপিয়ে বিদ্যুৎ জ্যাঠা কড়-কড়াত করে বাজ ফেলতে বাজ ফেলতে
লাগল । সঙ্গে সঙ্গে একজোট হয়ে বৃষ্টির দল ঝাঁপিয়ে পরলো শুকনো নদী তটে ।
বালি চোররা এমনটা যে দুম করে হবে তা
ভাবতেই পারে নি । দিব্যি ছিল আবহাওয়া । এমন
মুষলধারে বৃষ্টির সাথে জোট বেঁধে ঝড় বইতে শুরু করে দিল যে তারা পড়ি কী মড়ি হয়ে
ছুট দিল কাছের জঙ্গলটার দিকে ।
কিন্তু হায় জঙ্গল তো নামেই ! গাছ আর তেমন কোথায় ! যে
ক’টা গাছ আছে তাদেরও অধিকাংশের ডাল-পালা কাটা । আর এতগুলো বালি চোর কোথায় গিয়ে
মাথাটা বাঁচাবে তা ভেবেই পাচ্ছে না ।
-
“ ভাই সব সামনেই
ওই একটা ঝাঁকড়া বট গাছ দেখা যাচ্ছে চল ওদিকে , কিছুটা তো বাঁচা যাবে ,” একজন নেতা
গোছের লোক জোড় গলায় চেঁচিয়ে বলল ।
বাকী সকল তাদের দলের মাথার আদেশ শুনে ছুটে গেল বট গাছের
দিকে । বট গাছও যেন অপেক্ষাতেই ছিল ।
দুষ্টু লোকগুলো তার ডালের নীচে দাঁড়াতেই ধপাস করে একটা
ডাল মড় মড় করে ভেঙে পড়ল তাঁদের ঘাড়ের ওপর । “ বাবা গো ” বলে চিৎকার করে ওঠে বালি
চোরের দল । কোনক্রমে প্রবল ঝড়বৃষ্টির মধ্যে নিজেদের শরীর থেকে ভাঙা ডালপালা সরাতে
লাগল ।
৪
কিছুক্ষণ হল ঝড় বৃষ্টি থেমেছে । মেঘ নাতিরা সরে যেতেই
সূর্য দাদু আড়মোড়া ভেঙে একটু করে উঠতে থাকে । কাজ শেষ করে মেঘ-বাতাস-হাত-পা কাটা
গাছের দল ফিক ফিক করে হাসতে থাকে । সামনেই কয়েকজন বটদাদুর মোক্ষম মার খাওয়ার ফলে
খোঁড়াতে খোঁড়াতে যাচ্ছে ।
তাদের দলের চাঁইয়ের অবস্থা আরো শোচনীয় । মাথা ফেটে রক্ত
ছুটছে । কোমরে বেজায় লেগেছে । বেজার মুখে ওই অবস্থায় নদীর শুকনো চরের দিকে এগোতেই
তাদের মাথায় হাত ! একী ! কোথায় তাঁদের ট্রাক , বাকী সব সরঞ্জাম ? একটু আগেই ছিল
খটখটে বালিতে ভরা নদীর পাড় । আর এখন বয়ে চলেছে হুড় হুড় করে নদীর জল প্রবল বেগে ।
হায় হায় করে উঠল তাদের মন । ওদিকে সূর্য-বাতাস-গাছ সকলে
মিলে তাদের আদরের নদী বোনকে বলল একসাথে –
“ যাও যাও নদী সাগর মায়ের কোলে ,
প্রকৃতির বিরুদ্ধে গেলে রুখব দলে দলে ।
মানুষ অনেক করেছে
অন্যায়-অপরাধ ,
শাস্তি দিয়ে করেছি একসাথে প্রতিবাদ ।”
বালি
চোররা এসব কথা কিন্তু শুনতে পেল না । কারণ তারা তো প্রকৃতিকে ভালোবাসেই না ।
কিন্তু এটা বেশ টের পেল তাদের সব কাজ পন্ড হয়েছে । আর আজকের ঘটনা থেকে অনুভব করল ,
প্রকৃতির করুণ হাল করলে কারোরই রক্ষা নেই , কেউ ভাল থাকবে না।।
No comments:
Post a Comment