Saturday 30 March 2019

আত্মারা যখন অন্য গ্রহে


Related image
রাতটা এখন বেশ গভীর । টুক করে শব্দ হতেই কান সজাগ হয়ে উঠলো অ্যাটলাসের । মাথার মধ্যে টিঁ টিঁ কী বেশ ক্যাল্কুলেশন করেই এগিয়ে গেল দরজার কাছে ।
রাত । মহাশূন্যের রাতের রঙ কালচে বেগুনী । পৃথিবী এখান থেকে কয়েক লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে ।
কেবল অ্যাটলাসের নয় , তবে ওর মত যারা এই গ্রহের প্রহরী  তাদের চোখের মণিটা একটু লালচে ; হেক্সাস্কোপ  লেন্স ওদের চোখে আঁটা । লাখ লাখ আলোকবর্ষ দূরের জিনিষ স্পষ্ট দেখতে পারে ওরা ।
ডঃ চিন্তামণিকে আমরা কজনই বা চিনি ! নিজের ছোট্ট ল্যাবরেটরির ঠিক কোণায় রাখা আরাম কেদারায় এক সিপ বেয়ার গলায় ঢেলে গোঁফের তলায় হাল্কা হাঁসি রেখে  জেলির মত স্বচ্ছ আমন্ত্রণ পত্রটি পড়ছেন । । সাংকেতিক নাম ‘ মেথু । সহজেই বোঝা যায় ।
পড়া শেষ করে জেলি পত্র রেখে দিলেন  চৌক একটা ফ্লপিতে । প্রায় ১৪ বিলিয়ন প্রাচীন মেথুশিলা গ্রহে অ্যাটলাস থাকে । ওখানকার এক চোখ বাসিন্দারা ভাষা কী সেটা ঠিক জানে না । ওদের ইচ্ছে ওখানে পৃথিবীর মত স্কুল তৈরী করা । তাই অনেকদিনের বন্ধু ডঃ চিন্তামণিকে বক্তৃতা দেওয়ার জন্ ডেকেছে ।
 ফানেলের মত লম্বা মহাকাশ যানে দাঁড়িয়ে পরলেই হুসহুস করে উপরের দিকে টানতে থাকে । দিন দুয়েক লাগলো ১২৪০০ আলোকবর্ষ পার মেথুশিলায় পৌঁছাতে । আশ্চর্য এখানে মাইনাস ২১২ সেলসিয়াস অথচ ঠাণ্ডার লেশ মাত্র নেই ।
মনের কথাটা বুঝেই অ্যাটলাস গং গং একটা ধাতব শব্দ আর ইশারায় বলল , “ আপনি এই গ্রহের কাছে আসতেই  আপনার পেরিফেরিয়াল নার্ভে এই গ্রহের রশ্মি পরে আর তাই ঠাণ্ডা আপনি অনুভব করতে পারছেন না ঠিক আমাদেরই মত ।
চিন্তামণি খেয়াল করলেন এখানকার একজন থেকে আরেকজনের মুখের-চেহারার মিল না থাকলেও নারী আর পুরুষ … বোঝা কঠিন ! দিন আর রাত সব সময় কিসের যেন কাজে ব্যাস্ত ।
সকালের রঙ এখানে খুব সুন্দর । ফিকে গোলাপি আর কমলার মিশ্রণ । একটু ভালো করে লক্ষ্য করলেই দেখা যায় সাদা থোক থোক জুঁই ফুলের  মিল্কি ওয়ে । অ্যাটলাস বাকীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল অদ্ভুত 
খানিকটা এগোতেই নীল রঙের বালির ঢিবি । ওখানেই বসতে হবে । সামনের ছোট বড় মিলিয়ে শখানেক মেথুশিলার বাসিন্দা । সক্কলে একচোখে তাকিয়ে আছে ডঃ চিন্তামণির দিকে । অদ্ভুত নিস্পলক চাউনি । ভালো করে দেখার চেষ্টা করলেন , উঁহু কোন অভিব্যাক্তিই নেই ।
অনেকক্ষণ বক্তৃতা শেষ । একটিও হাতে তালি নেই ।
“ একী রে বাবা ! কিছু ভুল বললাম নাকি !” মনে মনে ভাবলেন ডক্টর ।
এই গ্রহের বাসিন্দারা বিস্ময়কর ভাবে একে অপরের কথা বুঝে যায় , তাই প্রকাশ কম । ভাষা খুব একটা নেই । তাই অ্যাটলাস এবারও ডক্টরের দিকে তাকিয়ে আগের মত যান্ত্রিক শব্দে বলল “ আসলে , আপনারা আমাদের কাছে খুবই আকর্ষণীয় । কিন্তু জ্যান্ত তো আর ধরে আনতে পারি না । ওটা অনুচিত ,তাই আপনাদের মৃত্যুর পর কিছু আত্মাকে আমরা এই গ্রহে নিয়ে আসি আর নতুন করে তৈরি করি ।“
কথা শুনে চিন্তামণির চিন্তা হুড়হুড় করে বেড়ে যায় , “ কিন্তু কেমন ধরনের…”
ইশারায় থামতে হয় তাকে । অ্যাটলাস জবাব দেয় , “ অনুভূতিহীন বা বলতে পারেন যাদের প্রকাশ ক্ষমতা ছিল না এমন সব মানব আত্মাদের ।“
“ কিন্তু ওদেরই বা কেন ? আরও তো আছে ?” ডক্টরের গলায় বিস্ময় ।
“ দরকার নেই বাকীদের । আমাদের এই গ্রহ ভাব আর ভাষা বোঝে না তেমন একটা । কাজই ধর্ম-অনুভব সব্বব কিছু । আপনাদের ওই ধরনের আত্মাগুলো এই গ্রহের বাকি সকলকে তারই টেরিং দেয় ।“
আজ রাতের যানে ফিরতে হবে । ধূধূ করা নিল-হলুদ বালির দেশ এটা । গাছ নয় তবে গাছের মত ঝিরঝিরে হাওয়া দেয় , ঠিক সেখানেই একটা গাঢ় সাদা পাথরের উপর গালে হাত দিয়ে বসে ভাবছিলেন মিথুশিলার সর্বনাশের কথা । এমন চলতে থাকলে …। বোঝে না কেন মেশিনেরও মোবিল লাগে ।
ঠিক তখনই একটা ট্রেতে গ্লাস নিয়ে হাজির অন্য একজন । ঢাকনা সরাতেই দুধের মতই কিন্তু খুব পাতলা সাদা তরল । লোকটি বলল , “ এটা  স্পেশ্যালি আপনারই জন্য তৈরি , স্পার জুশ ।“ অবাক হলেন ডঃ এর গলা তো পৃথিবীর মানুষের মতই ।
“ আ-আপ-নি পরাণ পুরুত !” মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক গলায় বললেন । চেহারা এখানকার মত অনেকটাই হয়েছে কিন্তু ভাষা আর ভাব এখনও পৃথিবীর মতই ।
গতবছর ক্যানসারে মারা যান । লোকে অবশ্য অনুশোচনা করে নি । বরং শ্রাদ্ধে কবজি ডুবিয়ে খেয়েছিল আর মনে মনে ওই নিরস মানুষটা যাওয়াতে খুশীই হয়েছিল ।
এখানে থাকতে থাকতে পরাণের আত্মা মনের কথা পড়তে শিখে গেছে । তাই ভাবটা বুঝেই উত্তর দিল, “ ঠিকই মনে করছো । আসলে আবেগ হল যত দুঃখের কারণ । যত ভাববে ততই কষ্ট । মরার আগে অবধি এটাই ভাবতাম । কিন্তু…”
-         “ কিন্তু কী ?
-         “ কিন্তু এখানে এসে যখন বাকী আত্মাদের সাথে দেখা করলাম , বুঝলাম মরার প সক্কলেরই একটা কথা প্রকাশ আর অনুভূতি না থাকলে বেঁচে থাকাটা আপাত সহজ হলেও সমাজ পরিন্ত হত এই গ্রহের মত স্পন্দন আর ভাষাহীন পাথরের মত ।“ কিছুক্ষণ চুপ থেকে পরাণ পুরুত উত্তর দিল ।
-         “ উপায় কী পুরুত মশাই ?”
-         “ তার জন্যই তো অ্যাটলাসের সাথে কথা বলে তোমায় এখানে আনা । তুমি বৈজ্ঞানিক । ঠিক পারবে তুমি ।“
মহাকাশযান সবুজ ধোঁয়া ছেড়েছে । খানিক পরেই রেখে আসবে ডক্টরকে পৃথিবীতে । চিন্তামণি নিজে বৈজ্ঞানিক ভেবে পাচ্ছিছিলেন না আবেগের কী ওষুধ । মনে পরে গেল পকেটে রাখা সেই তরল “এন্ড্রলিন সিঙ্গুলেট জাইরাস “। একবার উপহার হিসাবে দিয়েছিলেন প্রোফেসার রোহিতাশ্ব রায় ।
মহাকাশযানে ওঠার ঠিক আগে কয়েক ফোঁটা ঢেলে দিতেই চমৎকার ! গড়াগড়ি খাচ্ছে গ্রহের বাসিন্দারঅসুধকেউ হাসছে , কেউ গম্ভীর মুখ বিটকেল করে হাসতে হাসতে কাঁদছে । আর আজব সব শব্দ বেড়িয়ে আসছে মুখ থেকে । ভাষার জন্ম হচ্ছে । অ্যাটলাসও হাঁসতে হাঁসতে জানতে চাইলো , “ কী দিলেন আপনি ?“
  কাতুকুতুর ওষুধ ।“ মুচকি হেসে উত্তর দিলেন ডক্টর ।
মহাকাশ ওড়ার খানিক পরেই জানলা দিয়ে দেখলেন কালো কিছু ধোঁয়া । আত্মারা মুক্তি পেয়েছে ।
মাস কয়েক পর বাড়ীর ল্যাপটপে পিং শব্দে একটা ভয়েস ম্যাসেজ ।
“ আমাদের ভাষা সম্পূর্ণ এসেছে , মেথুশিলার রাষ্ট্রীয় ভাষার নাম – ‘ চিন্তামণি ভাষা ‘ ।। “

নিউমা হোল্ডারে আত্মারা


Image result for abstract image of other planet
 কাল ৮ টা । ‘স্টালটাস’-এর মাধ্যমে অ্যাটলাসকে খবরটা দিতে গিয়ে চোখ খুশীতে ভরপুর ।
“ পেরেছি অ্যাটলাস । স্টেম সেলের মত আত্মার ব্যাঙ্ক থেকে  আত্মা দেওয়া যাবে মৃতের ডি এন এ-তে ।“
১২৪০০ আলোকবর্ষ দূরে মিথুশিলা গ্রহে ডক্টর চিন্তামণি এসেছেন । আগেই একটা ফ্ল্যাট বানিয়েছেন । পাশেই নদী , হলদে তার স্রোত আর অদূরেই মাথা উঁচু করে নীলচে বর্ণের বরফের পাহাড় । অ্যাটলাস জানিয়েছিল , এই গ্রহ থেকে আত্মাদের সঙ্গে কানেকশন করা নাকী সহজ । বাকী পরীক্ষাটা ওখানেই সারলেন । নতুন যন্ত্রের নাম রাখলেন ‘ নিউমা হোল্ডার ‘ ।
জন্মকালে বিজ্ঞান যেখানে চেতনার সাথে মেশে ঠিক সেই ইলেকট্রন মিশ্রিত জারক রস থাকে তার ‘ নিউমা হল্ডার’এ । ডি এন এ-তে আত্মরস ইঞ্জেক্ট করলেই পুনরায় সজীব হবে দেহ ।
পরাণ পুরুতের পঞ্চত্ব লাভ বহুকাল আগেই হয়েছে । বর্তমানে তার নিবাস মিথুশিলা গ্রহের পাঠশালায় ।
সবে ভোর হয়েছে । মোরগ গলা ফুলিয়ে ডাক ছাড়বে ঠিক এমন সময় “ আঁ আঁ “ শব্দে পুরুত গিন্নী ভির্মি খেয়ে দাঁতে হিটকি লেগে উল্টে পরে ।
পুরুত ভেবেছিলেন পঞ্চ ব্যঞ্জনে অনেক কাল পর দুপুরের খাবার চেটেপুটে খাবেন । হল উল্টো ওঝার ঝাঁটায় পিঠ গেল ছড়ে ।
কেবল পরাণই নয় । দেশের বর্তমান হাল দেখে চিন্তামণি রবীন্দ্রনাথ ,নজরুল থেকে শুরু করে নেতাজী মায় কৌটতে রাখা রামকৃষ্ণের দাঁতেও দিলেন ‘ পরমায়ু ‘ জারক । চোখের সামনে ছবির মহাপুরুষেরা বহুকালের ঘুম ভেঙে উঠলেন ।
ভক্তিতে গদগদ চিন্তামণি সক্কলকে নিয়ে বসলেন সন্ধ্যে বেলায় । জেগে ওঠার পরও গুরুদেব মোটা জোব্বা গায়ে গুণগুণ করে কী বেশ গাইছেন ! খেটো ধুতি পরে পরমহংস বেঁচে উঠেই যথারীতি “ মাটি টাকা টাকাই মাটি “ বলে ভাব সমাধিস্থ ! ডক্টর বুঝতে পারলে না ব্যাপারটা কী হল !
“ নেতাজী নতুন ভারত , লাগছে কেমন ?“ আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করেই ফেললেন ।
বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে শুকনো অথচ দৃঢ় গলায় বললেন , “ বেল্লিক ! বলেছিলাম রক্ত দাও স্বাধীনতা দেব ! সেই যে ভ্যানিস করে দিলি ...। শ্যামবাজারে ঠা ঠা রোদে ঘোড়ার পিঠে চেপে আমারই রক্ত গেল শুকিয়ে ।“
মুখ কাঁচুমাচু করে নজরুলের দিকে তাকাতেই তিনি বড় বড় চোখে গেয়ে উঠলেন , “ কারার ওই লৌহ কপাট... ! গানটা দারুন কাজে লাগিয়েছিস ভাই তোরা । দেশের সম্পত্তি লুট করে...ছ্যা ছ্যা ।“
মাথা নীচু করে থাকে ডক্টর । রবি ঠাকুর সস্নেহে বললেন , “ বাংলার মাটি বাংলার জলের দেশে রেখেছো মানুষ করে বাঙালী কর নি । ভাব রে বিষয়টা ভাব ।।“  

দেবী ফ্রিয়ার অভিশাপে কুইজলিং


Related image


বন্ধুত্বের কোন বয়েস হয় না । অধ্যাপনা জীবনের প্রথম থেকে ডঃ অসিত বিশ্বাসকে ভুলি কী করে ! মানুষটা আমার থেকে বছর বাইশের বড় হলেও বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ওর মধ্যে বেশী । দীর্ঘদিন প্রবাসে রয়েছেনভারতে আসা যাওয়া একপ্রকার কমেই গেছে । গত দোলে ভারতে এসে আমাকে একপ্রকার থ্রেট দিয়ে গেছেন । এবার না গেলে সম্পর্কটা ভুলে যাও হতচ্ছাড়া ।বেশ মিষ্টি লেগেছিল ওই স্নেহের বকাটা ।
 বৈশাখের দ্বিতীয় দিন । দেখি কুরিয়ারে একটা বই এসে হাজির । প্রেরক নরওয়েবাসী । মনটা ভালো হয়ে উঠলো । ভিতরে সংক্ষিপ্ত চিঠি , “ স্নেহের রোহিতাশ্ব , আশাকরি বইটি তোমার গবেষণার জন্য আদর্শ । কাজ যখন শেষ হবে এখানে একবার এসোএকজনের মুক্তি নির্ভর করছে ।
 সত্যি বলতে সেই সময় মাথামুন্ড কিছুই বুঝি নি । অসিতদাকে ফোন করেও বিশেষ লাভ হল না । উনি কেবল জানালেন , “ শুক্রের অবসানে শুক্র কেবল কাঁদে / অভিশাপে তার বিশ্বাসঘাতক এবার ফাঁদেভাইটি মন দিয়ে কাজ করোটুক করে ফোন কেটে দিলেন ।

ডিসেম্বরের সকাল ৯টা একটু আগেই বেজেছে । আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চেকিং পর্ব মিটিয়ে মনে মনে প্রস্তুত হচ্ছি ১৫ ঘন্টা সফরের আমার চামড়ার সাইড ব্যাগে দুটি জিনিষ বাদে বাকী লাগেজ প্লেনের পেটে ইতিমধ্যে চালান হয়ে গেছে । রাজা হ্যবকের দুস্প্রাপ্য ডাইরীগোপনীয়তার কারনে মলাটে নাম রেখেছি , “ ফ্রাইডে নাইট মাঝে মাস সাতেক যেটা একটু নতুন ভাবে আবিষ্কার করেছি সেই জমাট বাঁধা সবুজ গ্যাস – ‘ সেরোটো অ্যাভিনা ‘, রয়েছে ছোট্ট একটা পিন আঁটা মোটা অথচ শক্ত ইঞ্চি তিনেকের শিশিতে । ভারতীয় ভেষজ যে কত আশ্চর্য এবং কার্যকারী তার প্রকৃষ্ট নমুনা হল ওষুধটি । মানুষের মস্তিষ্ক এমন একটি বস্তু যে নিজে ব্যাথা বোঝে না ঠিকই কিন্তু অদ্ভুত ভাবে তার কষ্টের অভিব্যক্তি জানিয়ে দেয় । তারই কিছুটা সমাধানে আবিষ্কার করেছি ওষুধটিতে কয়েকটি গিনিপিগ ছাড়া এখনও মানুষের উপর প্রয়োগ করার দুঃসাহস করে উঠতে পারি নি ।
এক মাস আগে অসিতদার আরেকবার ফোন এসেছিল , কেন জানি না মনে হল সেরোটো অ্যাভিনা কাজে লাগলেও লাগতে পারে ।
খারাপ আবহাওয়ার জন্য দুঘন্টা দেরী করে ভারতীয় বিমান নিশীথ সূর্যের রাজধানী অসলো বিমান বন্দরের মাটি ছুঁলো । নরওয়ে ইউরোপ মহাদেশের ব্যস্ততম নগরী হওয়া সত্ত্বেও প্রাকৃতিক দৃশ্য অসাধারণ । তাছাড়াও জড়িয়ে রয়েছে নানা মিথ , লৌকিক গাঁথা । আমি বিমানেই ঘড়ি মিলিয়ে নিয়েছিলাম । সময় বলছে রাত ১০:৫০ মিনিট , ভারতীয় সময় এখন ২:৩০ মিনিট । খিদেতে ভারতীয় পেট চুঁইচুঁই করছে । ইতিউতি দেখতেই খেয়াল করি অসিতদা ছেলে ঋককে নিয়ে হাজির । আমাকে দেখতে পেয়ে খাঁটি বাংলায় বলে উঠলেন , “ রোহিত এই যে এদিকে ।
কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরে বললেন , “ তাড়াতাড়ি চল । খুব খিদে পেয়েছে নিশ্চয় । এখানে কিছু খাবে ? না বৌদির হাতের সর্ষে দিয়ে শ্যামন মাছের ঝাল খাবে ?” শেষের দিকে দাদা আর ছেলের চোখে মিষ্টি হাসি ।
আমিও হেসে উত্তর দিলাম , “ বৌদিই ঠিক আছে , চলুন এবার । খাওয়ার কথা বলে খিদে বাড়াতে হবে না আর ।
এখানে একটা কথা বলা ভাল , আমি যত কটা প্রগতিশীল দেশে গেছি , লক্ষ্য করেছি পরিবহণ আর ট্র্যাফিক ব্যাবস্থা অতুলনীয় । আমাদের গাড়ী বেশ গতি নিয়েছে । কথায় কথায় দাদা জানালেন যে আমরা এখন বুকমাল যাচ্ছি । বুকমাল রাজধানী অসলোর পূর্বে অবস্থিত । গাড়ী চলছে । রীতিমত ঠাণ্ডা লাগছে । আবহাওয়া পরিষ্কার আকাশের রঙ লাল আর হলুদের মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করেছে ।
আকেরসেলভা নদীর বাঁক পেরিয়েই অসিতদার মিষ্টি একটা বাড়ী । আলো কম থাকায় বুঝলাম , বাড়ীর সামনের দিকটা বেশ ফাঁকা । পায়ের তলায় মখমলের মত কালচে ঘাসের গালিচা । পাশেই টিউলিপ আর ডেফোডিলে বাগান সেজে উঠেছে ।
অসিতদা বেল টিপলেন । ঋক নিজের হাতেই আমার ব্যাগ রেখেছে । ভালো লাগলো বঙ্গ তনয়ের ব্যাবহারটি । সুন্দর মিশুকে বাঙালী এই বোধের জন্য ওর মা বাবাকে অবশ্যই মনে মনে সাধুবাদ দিতে হল । বাঙালী এখনো ভদ্রতা যে জানে তা ভেবে ভালোই লাগলো । তবে এই ভাব বেশীক্ষণ ধোপে টিকলো না ।
ক্‌জার কম নি বৌদির এই কথায় বোকার মত দাঁড়িয়ে রইলাম । আর ওদিকে বাপ-ব্যাটা হো হো করে হেসে কুটিপাটি ।
আরে ভিতরে চল হে , বৌদি আপ্যায়ন করছে তোমায় অসিতদা কোন মতে হাসি থামিয়ে বললেন । আমি থতমত খেয়ে আছি দেখে বৌদি বাংলায় বললেন এবার , “ এসো ভাই ।আবার চমক ।
বৌদি এগোট নরওয়ের মেয়ে । অসিত’দা ফ্রান্সে পরাশুনার জন্য এসে প্রেম থেকে বিবাহ সম্পূর্ণ করেন এগোটের সাথে । ভদ্রমহিলা খুবই শিক্ষিত । নরওয়ের স্কুলে পড়াতেন । বর্তমানে দম্পতি অবসর জীবনযাপন করেনএকমাত্র ছেলে এখানেই চাকরী করছে । বুঝলাম দাদা এখানে পাকাপাকি থেকে যাবেন বলে বদ্ধপরিকর । সত্যি মানুষ এক আশ্চর্য জীব । যাযাবর বা পরিযায়ী পাখিরাও হয়তো এই প্রাণীকে দেখলে ঈর্ষা করে ।
ঘুম দিব্যি হয়েছিল । ঘুম ভাঙতেই ভাবলাম , এ বাবা এখনও তো ভোর । ভুল চিন্তা । আমি যে এখনও ভারত ভেবেই রয়েছি নিজের মধ্যে । না ভাবার কারণ নেই । ঘরের মধ্যে প্রায় পুরোপুরি বাংলার পরিবেশ ।
বাগানে চা আর জলখাবারের ব্যাবস্থা । ছেলে ঋক অফিসে বেরিয়ে গেছে । এখন আমরা তিনজন ।
অসিত’দা সরাসরি আসল কথায় আসলেন । বললেন , “ রোহিত  এগোটের বিষয়ে বলার আগে তোমায় একটা প্রশ্ন করি , বিশ্বের ইতিহাসে কলঙ্কিত বা বিশ্বাসঘাতক চরিত্রের অভাব নেই । বলতে পারো এদেশের সে কে হতে পারে ?”
ইতিহাস নিয়ে তেমন একটা ঞ্জান আমার নেই । তবে অগ্রহ আছে মোটামুটি । খানিক চুপ থেকে বললাম ,” নেটের দৌলতে অনেক কিছু হাতের মুঠোয় , ভিদকুন কুইজলিং সে তালিকায় পরে ।“
চায়ের কাপ বুক অবধি তুলে দাদা একটু সময় আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন , “ সব কিছু কিন্তু নেটে থাকে না । বলতে পারো অনেক ইতিহাসের বইতেও থাকে না । “ কথাটা সত্যি তাই কিছু উত্তর দিলাম না । অসিত’দা নিজেই বলতে থাকলেন আবার , “ এগোটের সম্পর্কের আত্মীয় হলেন অ্যালেকজান্ডার ভরোনিন । ভিদকুনের স্ত্রী । যদিও তিনি পরবর্তীকালে সম্পর্কে আর থাকেন নি ।
 ১৯৪০ সালের এপ্রিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অংশরূপে ব্রিটিশ অপারেশন উইলফ্রেড শুরু হলে নরওয়েও তার নিরপেক্ষ ভূমিকা পরিত্যগ করে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। জার্মানির পরাক্রমশালী যুদ্ধ জাহাজক্রইজার ব্লুচারনরওয়ে দখলের জন্য দ্রুতই এগুতে থাকে। কিন্তু পারে না । নরওয়ের প্রত্যাঘাতে ডুবে যায় । নরওয়ের লোক হয়েই কেবলমাত্র ক্ষমতার লোভে ভিদকুন হিটলারকে সাহায্য করেছিল । করেছিল নিজের মাতৃভূমির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা ... তুমি ভাবছো কেন বলছি এসব তাই না ...?” আমার দিকে তাকেলেন দাদা ।
বৌদি চুপচাপ চা খাচ্ছেন ।
আমি বললাম , “ ফাইডে নাইট ডায়েরীতে এসবের উল্লেখ ছিল কিন্তু কম । সেখানে তো...”
আমাকে থামিয়েই বললেন অসিতদা , “ একটু ধৈর্য ধরতে হবে ভাই , আমি আসবো সে কথায় । ১৯৪৫ সালে ৩০ এপ্রিল হিটলারের আত্দহত্যার পর কুইজলিং বুঝতে পারেন দ্রুতই ঘনিয়ে আসছে তার দিন। যদিও এর আগে জার্মানির সাহায্য ভিদকুন নরওয়ের অধিপতি হন । কথায় আছে ভগবানের মার একবার । পারলেন না ভিদকুনও । যুদ্ধ শেষে তিনিও সব ক্ষমতা ধীরে ধীরে হারালেন । অবশেষে হলেন রাজবন্ধী ।“
এগোট বৌদি এবারে মুখ খুললেন , “ মিঃ রায় সে ইতিহাস অন্য । পরে বলা যাবে । ভিদকুন জেলে বেশ কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছিলেন কিন্তু পারেন নি । ফায়ারিং স্কোয়াডেই গুলি করে মারা হয় । কিন্তু কথা হল কেন তিনি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন ? অ্যালেকজান্ডার ভরোনিনের সাথে আমার শেষ দেখা হয় ১৯৯০ এ । আমাকে একটা ডায়েরী তখন দিয়ে বলেছিলেন , ‘ গুড ভিল অলদ্রি টিলগি অস ‘ অর্থাৎ ঈশ্বর আমাদের ক্ষমা করবেন না । এর তিন বছর পর উনি মারা যান ।“
মনে মনে আশ্চর্য হলাম । ফ্রাইডে নাইটে দেবী ফ্রিয়ার কথা উল্লেখ আছে । তিনি জীবনের সকল অনুভূতির দেবী । তিনি ইচ্ছা করলে সৌন্দর্য , যৌনতা , আবেগ সব কেড়ে নিয়ে হতাশার অন্ধকারে ঠেলে দিতে পারেন । আমি ভাবছিলাম সেই কথাই । মিল পাচ্ছি , অনুমান করতে পারছি কিন্তু ধরতে পারছি না যে এরা ঠিক কী বলতে চাইছেন ।
“ বৌদি আমাকে কী করতে হবে বলুন । সব যেন ধোঁয়াশা । দাদা একটা হেঁয়ালি করে চিরকুট পাঠিয়েছিলেন যদিও কিন্তু ...”
অসিত’দা জেটস্ট মাখানো পাউরুটির আমাকে দিয়ে বললেন , “ খেয়ে দেখো ভালো লাগবে । ছাগলের দুধের চিজ আছে ওতে ।“
বেশ খেতে কিন্তু উত্তর না পেয়ে আবারও অসিত’দার দিকে তাকিয়ে থাকলাম । দাদা পাউরুটি চিবোতে চিবোতে বললেন , “ দেখো এখানকার মানুষ খুবই স্বাধীন মনের । আমরা মানে আমি দীর্ঘকাল এখানে থাকার জন্য তেমনটাই হয়ে গেছিছেলের বিয়ে হবে শীঘ্রই ।“
দাদা বার বার কথা এড়িয়ে যাচ্ছেন দেখে বিরক্তি লাগছিল কিন্তু মুখে বললাম “ ভালোই তো দিন না । পাত্রী কী বঙ্গ তনয়া ?”
“ নো মাই ডিয়ার । পাত্রী নয় পাত্র । ঋক সমকামী । একটি ছেলে কে ভালোবাসে । বিয়ে করতে চায় ওর সাথে ।“ কথাটা শেষ করে দম্পতি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার অভিব্যাক্তি ঠাওর করার চেষ্টা করতে লাগলেন । আমি নিজেও স্বাধীনচেতা । ভারতও এ বিষয়ে অনেকটাই এগিয়েছে যদিও ।
সংযত গলায় বললাম , “ বেশ তো সমস্যা কী ?”
ঠিক একদিন পর অলিভার সমেত আমরা সকলেই ট্রমসো শহরে পারি দিলাম । অলিভার হানসেনকে ঋক ভালোবাসে । ওর আদি বাড়ী নরওয়ের এই ছোট্ট শহরে । এখানকার দৃশ্য বিশেষ কিছু বলার নেই । কারণ ওই দৃশ্য বর্ণনা করার ক্ষমতা আমার নেই তেমন । উপরে ঘন-গাঢ় তুঁতে নীলের মিশ্রণ আর পায়ের তলায় মচমচ করছে বরফ ।
অসিত’দা বললেন , “ ভায়া নর্দার্ন লাইট বা অরোরা বুরিয়াল বলে এই আলোকে । চলবে ২১ শে জানুয়ারী অবধি । সারা পৃথিবী থেকে কত মানুষ আসে এই রহস্যময় আলোর খেলা দেখতে ।“
আমি অবাক বিস্মিত । ‘হে প্রকৃতি কী অপার মহিমা তোমার , আমরা তো কীটস্য কীট ।‘ সেইদিন বেশী কথা হয় নি । শুধু এটুকু ঋকের কাছে জেনেছিলাম অলিভার হানসেনের বৃদ্ধ দাদু ইগিল হানসেনের নব্বই এর কোঠায় বয়স । তিনি দেবী ফ্রিয়ার উপাসক ।
অলিভার মা জীবিত । বাবা মারা গেছেন কয়েকবছর আগে । চাকরী সূত্রে অসলোতেই থাকে অলিভার । মাঝেমধ্যে এখানে আসে । ওর আর ঋকের কথা তারা জানেন । মেনেও নিয়েছেন ।
আমি অসিত’দার কানে কানে বললাম , “ আমরা কী ঘটকালী করতে এসেছি ?”
হাঁটা একটু থামিয়ে দাদা জবাব দিলেন , “ অবাক লাগছে তাই না । ভারত হলে ভাবাই যায় না । এখানে অবশ্য ২০০৯ সালেই স্বীকৃতি পায় । তবে কী জানো দাদু প্রাচীনপন্থী ।ওঁর মতটা খুব জরুরী । যদিও অমতেও অসুবিধা নেই ।“

বাড়ীর দরজা খুললেন মা মার্গিট হানসেন । বয়েস আনুমানিক ৫৬ । দেখলেই মন ভালো হয়ে যায় এমন মহিলা । ইংরাজি জানেন না । সুতরাং দোভাষীর ভার খুশী মনে নিল অলিভার । আমি যদিও বাকী ঘটনা-কথা বাংলাতেই লিখলাম ।
ভদ্রমহিলা আমাদের বসতে বলে প্রত্যেককে এক গ্লাস করে গ্লগ দিয়ে গেলেন । খাবো কী খাবো না বুঝতে পারছিলাম না । অলিভার মিষ্টি ছেলে । আমার চেয়ার পিছনে এসে দুহাত দিয়ে গলা জড়িয়ে বলল , “ খেয়ে নাও । দারুন খেতে । আলু , ধনেপাতা আর লোকাল স্পিরিট দিয়ে ঘরে বানানো ওয়াইন । অতিথি এলে আমরা দেই ঠিক চায়ের মত ।“ তাকিয়ে দেখি অসিত’দা চুমুক দিতে দিতে হাসছেন । অর্থাৎ অভয় দিলেন । মিষ্টি মিষ্টি স্বাদ ।
আমরা এখানে এসেছি দেড় ঘন্টা পার হয়ে গেছে । হঠাৎ একটা পায়ের আওয়াজে মার্গিট জানালেন ইগিল অর্থাৎ ওর শ্বশুরমশাই আসছেন ।
বৃদ্ধের পরনে মোটা জোব্বা । বরফের মত লম্বা সাদা চুল । পিছনে দুই হাত । আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ । ঘরের পরিবেশটা রাশভারী মানুষটার উপস্থিতিতে থমথমে হয়ে গেল ।
নিজেই বসলেন কোণার দিকের আরাম কেদারায় । চোখ দুটি বন্ধ । দেওয়াল ঘড়িতে টিকটিক শব্দ ছাড়া এতগুলো মানুষের নিঃশ্বাসও যেন এক লহমায় থেমে গেছে । বেশ অনেকক্ষণ পর তাকালেন পুনরায় অলিভার আর ঠিক পরেই ঋকের দিকে । চোখ দুটি দিয়ে যেন বিদ্যুতের ঝলকানি । সহসা তীক্ষ্ণ গলায় ওদের দুই জনের দিকে আঙুল তুলে বললেন , “ ফোরবান্নেলেশ আভ ফ্রিয়া , হেলস ভিল ইক্কি ভ্যারে ব্রা...। গো ব্রট লপ ...।
কথাটা শোনার পরেই দেখলাম আমি ছাড়া সকলের চোখেই কেমন জানি না ভয়ের ছাপ । বৃদ্ধ কথাটা বলার পরেই ঝিম মেরে বসে পড়লেন । মনে হল সমস্ত শক্তি উনি হারিয়েছেন । অলিভার আর ঋক ধরাধরি করে পাশের একটা ঘরে নিয়ে গেল । খানিক পর এসে জানালো যে ওদের দাদু ঘুমিয়ে পরেছে ।
মিসেস মার্গিট রাতের খাবার পরিবেশন করেছেন একটু আগেই । এগোট বৌদি নিজেদের ভাষায় কথা বলতে বলতে হাতে হাতে কাজ করে দিচ্ছেন । আমার কেন জানি না সব মিলিয়ে একটা অস্বস্তি লাগছে । বাধ্য হয়েই বলেই ফেললাম , “ অসিত’দা সব কাজ ফেলে এসেছি দেশে কিন্তু এখনও অবধি ঘটকালী ছাড়া আসার উদ্দেশ্য কিছুই বুঝলাম না !”
অসিত’দা খেতে খেতে বাঁ হাত দিয়ে আমার হাতে হাত রেখেই বললেন ,” রোহিত উদ্দেশ্য কিন্তু তোমার চোখের সামনেই ছিল । বৃদ্ধ ইগিল । কাল সকালে বাইরে কোথাও বলি কেমন ।“

তেলেগ্রাফবুক্তা হল ট্রমসো শহরের অন্যতম সুন্দর সমুদ্র সৈকত । দিনের টিকিট কেটে শৈলশিখর বেষ্টিত নিরালা এক জায়গায় আমি আর অসিত’দা বসলাম । হুহু করে বইছে শীতল বাতাস । দাদা মুখ খুললেন , “ ফ্রাইডে নাইট ডায়েরীতে দেবী ফ্রিয়ার অভিশাপ যে লেগেছিল তা তুমি জেনেছো ।  ভরোনিন যে ডায়েরী দিয়েছিলেন , সেটা তাঁর যে লেখা নয় সেটা সহজেই অনুমান করা যায় । বহুবছর আগে রাজা হ্যবনের পাঠাগারের দায়িত্ব প্রাপ্ত গ্রন্থাগারিক এটি হাতে পান এবং লোভে পরে ওটি বিক্রী করে দিয়েছিলেন জার্মানীতে ।“
একটা পাখি অনেকক্ষণ ধরে ডেকে যাচ্ছে । দাদার কথার মাঝেই টানা শিষ দিচ্ছে । আমার মন ওইদিকেই ।
“ ওটা হোয়াইট টেল ঈগল । শোন এবার । বেন মিলার সেই জার্মান ব্যাবসায়ীর কাছ থেকে হস্তান্তরিত হয় বইটি ফ্রান্সে । এর কারণ অবশ্য অদ্ভুত । বেন মিলার তাঁর এক জীবনীতে লিখেছিলেন , ‘ বইটি পাওয়ার পর আমার ঘর অন্ধকারে ডুবে যায় । আমি হতাশায় পরি যখন জানতে পারি আমার পৌত্র সমকামী । অর্থাৎ আমার বংশ শেষ । আমি ক্রমেই বুঝতে পারি রাজা হ্যবন ইচ্ছে করেই বইটি তাঁর সুরক্ষিত পাঠাগার থেকে কৌশলে সরিয়েছিলেন । লোকে জানলো চুরি ! হা ঈশ্বর লোভের শাস্তি পেলাম ।‘ আমার মনে হয় বর্তমানে যে ফ্রাইডে নাইট আমরা পেয়েছি তার মধ্যে মিলার নিজের লেখা কিছু অংশ জুড়ে পাচার করেছিলেন ফ্রান্সে ... অ্যালেকজান্ডার ভরোনিনের কাছে ।“
এতক্ষণ এক নাগাড়ে কথা বলার পর থামলেন অসিত’দা । আমি ভাবতে লাগলাম এই জটিল অঙ্ক । খানিক পরে বললাম ,” কিন্তু লাভ কী দাদা অ্যালেকজান্ডার ভরোনিনের কাছে ওটি বিক্রী করে ?”
গ্লাভস দুটো খুলে দুই হাতের তালু ঘসতে ঘসতে বললেন , “ এক ঢিলে দুই পাখী শিকার । আসলে মিলারের রাগ গিয়ে পরে নরওয়ের রাজার উপর । তারজন্যই হিটলার নরওয়ে দখল করতে পারে নি । দুর্ভাগ্যের বিষয় ভরোনিন যে ভিদকুনের স্ত্রী মিলার জানতেন না । ভুল করে সেই অভিশপ্ত বই দিলেন ভরোনিনের কাছে । ভেবেছিলেন রাজার বংশধরও একইভাবে অবলুপ্তি হবে । কপাল ! এগোট আমার স্ত্রী সেই ভিদকুনেরই বংশধর ।“
আর কোন কথা হল না । গাড়ীতে যেতে যেতে আমি বললাম , “ আপনি কী আশাহত দাদা ? ছেলে...!” মুখটা গম্ভীর দেখে আর কিছু বললাম না ।খানিকটা যাওয়ার পর অসিত’দা রাস্তার একপাশে গাড়ীতে ব্রেক কষে বললেন , “ এ অভিশাপ শেষে আমারও লাগলো । আমি মেনে নিতে পারছি না । অথচ ওরা এই সম্পর্ক থেকে বেরোবে না আমি জানি । বহু বছরের সম্পর্ক ।“
গলায় আকুতি । আমি হেসে বললাম , “ এত চিন্তা করছেন কেন । এ কোন অভিশাপ নয় দাদা । দুজনের ভালোবাসা এ তো প্রাকৃতিক । আপনি এত বছর বাইরে থেকেও এখনও মুক্ত মনের হতে পারেন নি ।“
খেয়াল করলাম অসিত’দা চয়াল শক্ত করে আমার কথা হজম করলেন । স্টেয়ারিং এ হাত রেখে বললেন , “ তোমার সেরোটো অ্যাভিনা , যার কথা বলেছিলে ওটা ঋকের উপর প্রয়োগ কর । ওঁকে মুক্ত হতেই হবে এই অভিশপ্ত জীবন থেকে ...।“ শেষের দিকে গলার স্বর জোরালো অথচ শান্ত ।

বাড়ী ফিরে দেখলাম বৃদ্ধ ইগিল দুই নাতির সাথে রসিকতা করছেন , বাচ্চাদের মত হাসছেন । গতরাতের তীক্ষ্ণ ভাব উধাও ।
অসিত’দা গাড়ী থেকেই নেমেই আমার হাত দুটি ধরে বললেন , “ দেবী ফ্রিয়া আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন ভাই । বৃদ্ধ ইগিলের উপর দীর্ঘদিন ভর করেন দেবী । কাল সন্ধ্যে বেলায় নরওয়ে ভাষায় ওটাই বলে সতর্ক করেছিলেন দেবী । আমি নিয়ে যাবো সেই ঝরনার গুহায় যেখানে আজও দেবী রয়েছেন । ইগিল তার পুরোহিত ।“
বৃদ্ধ ইগিল মার্গিটকে বাদে সকলকে নিয়ে সেইদিন সন্ধ্যেবেলা অন্য পথ ধরে নিয়ে গেলেন সেটেরগ্রোট্টা গুহায় । ট্রমসোর বাড়ী থেকে এই গুহা অবধি সুড়ঙ্গ পথেই এলাম । সাধারণরাও নাকী এখানে বেড়াতে আসেন তবে অন্যপথে ।
পথ যত এগোচ্ছে বাইরের যেটুকু আলো ছিল তাও অন্ধকার এখন । অদ্ভুত ভিজে ভিজে গন্ধ । কয়েক জায়গায় হাঁটু মুড়ে প্রায় হামাগুড়ি দিতে হচ্ছে । ঘুটঘুটে অন্ধকার পথটা ইগিলের হাতের তালুর মত চেনা । প্রত্যকের কোমরের সাথে দড়ি বাঁধা ,যাতে কেউ হারিয়ে না যাই । ইগিলের পিছনেই অলিভার । তারপরে এগোট বৌদি আর আমি সকলের শেষে । আমার সামনে ঋক ।

একসময় থামলাম । কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছি না । কথা বলা বারণ , দেবী নইলে কুপিত হবেন । খানিক পরেই গুণগুণ শব্দ ক্রমশ গাঢ় হতে লাগলো । বুঝলাম ইগিল কাকে যেন আহ্বান করছেন ।
“ ভোকনে ফ্রিয়া ভি আর আল্লে হার , দেবী ফ্রিয়া জাগো এসেছি আমরা ...।” গুহার দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বৃদ্ধের আহ্বান । কেমন যেন  গায়ে কাঁটা দেওয়ার মত পরিবেশ । পায়ের তলাটা বেশ ভিজে ভিজে লাগছে । ঠিক তখনই ধপ করে জ্বলে উঠলো মশালের মত একটা জিনিষ । আলোর স্পর্শে কতগুলো বাদুর ফরফর করে বেরিয়ে গেল ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে ।

উজ্জ্বল আলোয় চোখটা প্রথমে ধাঁধিঁয়ে গেছিলো । হাতটা সরাতেই অবাক । গভীর গুহার একধার দিয়ে যে সবুজ নদী বয়ে যাচ্ছে ঠিক তার কোন বরাবর গুহার একটা দেওয়াল উঠে গেছে । লম্বাটে আকৃতির দেবী ফ্রিয়ার প্রস্তর মূর্তি । পাশেই অদ্ভুত পাথরের সিংহাসন । আলো লেগে সেখান থেকে নানা বর্ণ ঠিকরে বেরোচ্ছে । এগোট বৌদি ‘ ফ্রিয়া ফ্রিয়া ‘ বলে মাথা নত করলেন । ইগিলের এক হাতে মশাল । আমি ওর চোখের দিকে তাকাতেই ভয় পেয়ে গেলাম । ক্রোধ যেন ঝরে পরছে । অলিভার অসিত’দার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ।

কিন্তু একী ...!! ভুল দেখছি না তো ! ঋক ওখানে কেন ? অসংখ্য আলোর মাঝে দেবীর পায়ের তলায় ! ওখানে তো ইগিলের থাকার কথা । ঋকের হাত ক্রমশ উপরে উঠছে আর বৃত্তাকারে ঘুরছে । মুখে বিড়বিড় করে যেটা বলছিল তা প্রতিধ্বনিত হয়ে গুহার চারিদিকে ছড়িয়ে পরছে –
“ চতুরবর্নম ময়া সৃষ্টং গুনকর্মবিভাগশঃ
তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধাকর্তারমব্যয়ম্‌ ।“
আমার হাত কেন জানি না ঠিক সেই মুহূর্তে কাঁধে ঝোলানো চামড়ার ব্যাগে চলে গেছে । অস্তিত্ব অনুভব করার চেষ্টা করলাম  ‘ সেরোটো অ্যাভিনা ‘র ছোট্ট শিশিটাকে । পেলাম না । চুরি হয়ে গেল নাকী !
দাদা আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললেন , “ ঋক ভারতীয় সংস্কৃতির উপর বেশ চর্চা করতো জানতাম কিন্তু ও কী বলল জানো রোহিতাশ্ব ?”
আমিই যে সংস্কৃতে বিশাল পন্ডিত তা নয় তবে এটা ঠিক ভেষজ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সংস্কৃতের সাহায্য নিতে হয় প্রায়ই । আমি বললাম , “ ভগবৎ গীতার চতুর্থ অধ্যায়ের ঞ্জান যোগ । শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন কর্মের জন্য চার বর্ণের সৃষ্টি । এই বর্নের উপরেই আমার অবস্থান । কর্মেই ধর্ম নিহিত । “
অসিত’দা খানিকটা উত্তেজিত হয়ে বললেন , “ পাগল হল নাকী ছেলেটা গীতা আওড়াচ্ছে দেবী ফ্রিয়ার আসনে !!”
আকস্মিক বৃদ্ধ ইগিলের মুখে হাসির রেখা দেখা দিল । মশালটা হাত থেকে খসে পরতেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো , “ নর্স , দেবি ফ্রিয়ার আশীর্বাদ ...নর্স তুমি ধন্য ...। অভিশাপ থেকে মুক্তির রাস্তা দেখাও দেবী ।“
ঋকের হাত এখন মুঠো । চোখ খোলা । স্থির হয়ে আছে মণি । আমরা এগিয়ে গেলাম ঋকের কাছে । অপর হাতের ইশারায় আরও কাছে আসতে বলল । গেলাম । প্রত্যেকের হাত খুলতে বলল আঙুল নাড়িয়ে ।
সবুজ আলোয় গুহা ভরে উঠলো । সেরোটো অ্যাভিনা !! তারই আলো । ছিপি খুলে ইগিল আর অসিত’দাকে দিলো ঋক । অলিভার হাত বাড়াতেই এগোট বৌদি ওর হাতটা ধরে হ্যাঁচকা টান মারতেই হুমড়ি খেয়ে পরে ঋকের উপর । মুহূর্তের মধ্যে শিশিটা শক্ত পাথরে লেগে ভেঙে চুরমার হয়ে যায় । লক্ষ্য করলাম একটা সবুজ গ্যাস ধীরে ধীরে সুক্ষ তরলে পরিণত হয়ে যাচ্ছে । এক-দু ফোঁটা ঋকের ঠোঁটের উপর গিয়ে লাগলো ।
খানিক পরে ধুপ করে দুবার শব্দ হতেই দেখি ইগিল আর অসিত’দা মাটিতে পরে আছেন । পা আর ঠোঁটটা তিড়তির করে কাঁপছে । বৌদি ছুটে যেতে চাইলেন কিন্তু আমি বাধা দিলাম । বৌদির চোখে আশঙ্কা ওই তিনজনকে ঘিরে । অলিভার ঋকের মাথাটা নিজের কোলের উপর নিয়ে বসে আছে । কিন্তু আমি শান্ত ।পরম নিশ্চিন্ত ।

জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে অসিত’দার একটা চিঠি পেলাম । সঙ্গে একটা কার্ড ।
“ ভাই রোহিতাশ্ব ,
          ভারতীয় ভেষজকে দেবী ফ্রিয়ার প্রসাদ ভেবে আমরা খেয়েছিলাম । দেখলাম মিথ্যে কল্পনার জগত থেকে ইগিলের মত আমিও বেরোতে পেরেছি । মাথাটা বড্ড হালকা লাগে । ভালো স্বপ্ন দেখি । স্প্লিট মেন্টালিটি কখন যে প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়াতে পরিণত হয়েছিল তা আমরা কেউই টের পাই নি ।
ইগিলের সাথে পরিচয় আমার দীর্ঘদিনের । দেবী ফ্রিয়ার প্রতি আকর্ষণ ক্রমেই বাড়তে থাকে ইগিলের কৃপায় । বুঝতেই পারি নি ওর মত আমিও একটা অলীক কল্পনার রাজ্যে মাঝে মধ্যে চলে যেতাম । অবশেষে বুঝি আমার প্রতি ইগিলের একটা আক্রোশ ছিল । কারণ তিনিই ছিলেন রাজা হ্যবনের সেই গ্রন্থাগারিক । বহুবছর রাজার গ্রন্থাগারে থাকার দৌলতে পৃথিবীর নানা ভাষা-দর্শন সম্পর্কে গভীর ঞ্জান লাভ করেন । সংস্কৃতও বাদ যায় নি । ভিদকুন কুইজলিং বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন রাজার সাথে । ইগিল জানতেন এই প্রাসাদ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে ভিদকুনের হাতে । তাই রাজার সাথে পরামর্শ করে একটা মিথ্যা প্রচার ওই ডায়েরীর পাতায় লিখে রেখেছিলেন । ডায়েরীটা মূল্যবান এক নথি । তাই এই ব্যাবস্থা করেন তিনিই । পরে পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হলে ভেবেছিলেন বেন মিলারের কাছ থেকে কিনে নেবেন । কিন্তু ততদিনে চলে গেছে এগোটের আত্মীয়ের কাছে । ‘ ফ্রাইডে নাইটে’র কথা আমিই বলেছিলাম ইগিলকেতারপর থেকেই আরও বেশী করে দেবী ফ্রিয়া আমার জীবনে , সাথে নাতি অলিভারঋকের প্রতি ভালোবাসা , ফ্রিয়ার উপর অলৌকিকতা সব গ্রাস করতে থাকে । যখন মাথা ঠান্ডা থাকতো তখন বুঝতাম কেন ইগিল এমন করছে । প্রতিশোধ । আমি যে ভিদকুনের আত্মীয় হয়ে গেছি এগোটকে বিয়ে করে । রাজভক্ত ইগিল প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন আমাকে ধীরে ধীরে পাগল করে ।
আমি আর ইগিল সমকামী বিবাহে রাজী কোন কালেই ছিলাম না । কিন্ত ঋকের প্রতি আমি যেমন ঠিক অলিভারও ইগিলের জীবনে দুর্বলতা । ইগিল পরে দেখলেন ভুল করে ফেলেছেন অলিভারকে ঋকের জীবনে এনে । কারণ ওদের সম্পর্ক নাটক নয় ।
ইগিল নিজেও আমার মত সিজোফ্রেনিয়াতে ভুগছিলেন । মিথ্যে অভিনয় করতে করতে মিথ্যেটাই সত্যি হয়ে গেছিলো । তবে তোমার সেরোটো অ্যাভিনা অসাধারণ । আমরা সুস্থ এবং ভালবাসার কাছে পরাজিত হয়ে ঋক আর অলিভার বিয়ে দিতে চলেছি । তোমাকে আসতে হবে ভাই । ফোন করে এত কথা যেহেতু বলা যায় না তাই এই চিঠি ।
 ভালো থেকো ।
ইতি
তোমার দাদা ।

পুনঃ এটা জানতে পারলাম না ঋক কীভাবে সেরোটো অ্যাভিনা পেলো । আর বস্তুটি আসলে কী ?

চিঠিটা ভাঁজ করে ফোনে একটা ম্যাসেজ লিখলাম ।
“ গুহায় যাওয়ার আগের দিন ঋক আর বৌদির কাছে অনেকটাই জানতে পেরেছিলাম । বলতে পারেন আমার , বৌদি আর ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ঋকের অভিনয় ছিল সেদিন ।
ঋকের ঠোঁটে যেটুকু লেগেছিল তাতে মন্দের ভালো হয়েছে , সকল নেগেটিভ চিন্তা যা এতদিন আপনারা ওর মনে ঢুকিয়েছিলেন নানা ছলে তা দূর হয়েছে ।
ও হ্যাঁ ওষুধটা ওটের খড় আর আমাদের শরীরের হরমোন সেরোটোনিন দিয়ে বিশেষ ভাবে তৈরী । একটা কথা গীতার ওই শ্লোক আর ইউরোপের নস বা ফ্রিয়ার দর্শন কিন্তু সমকামী মান্যতা দিয়েছে । ব্যাখ্যা নিজের নিজের মত ।
যাইহোক ঋক আর অলিভারকে আমার আশীর্বাদ জানাই ।।“

আত্মারা যখন অন্য গ্রহে

১ রা তটা এখন বেশ গভীর । টুক করে শব্দ হতেই কান সজাগ হয়ে উঠলো অ্যাটলাসের । মাথার মধ্যে টিঁ টিঁ কী বেশ ক্যাল্কুলেশন করেই এগিয়ে গেল দরজার ...