১
বন্ধুত্বের কোন বয়েস হয় না । অধ্যাপনা জীবনের প্রথম থেকে ডঃ
অসিত বিশ্বাসকে ভুলি কী করে !
মানুষটা
আমার থেকে বছর বাইশের বড় হলেও বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ওর মধ্যে বেশী । দীর্ঘদিন প্রবাসে
রয়েছেন
। ভারতে
আসা যাওয়া একপ্রকার কমেই গেছে । গত দোলে ভারতে এসে আমাকে একপ্রকার
থ্রেট দিয়ে গেছেন । “
এবার
না গেলে সম্পর্কটা ভুলে যাও হতচ্ছাড়া ।“ বেশ
মিষ্টি লেগেছিল ওই স্নেহের বকাটা ।
বৈশাখের দ্বিতীয়
দিন । দেখি কুরিয়ারে একটা বই এসে হাজির । প্রেরক নরওয়েবাসী । মনটা ভালো হয়ে উঠলো ।
ভিতরে সংক্ষিপ্ত চিঠি , “ স্নেহের
রোহিতাশ্ব , আশাকরি
বইটি তোমার গবেষণার জন্য আদর্শ । কাজ যখন শেষ হবে এখানে একবার এসো
। একজনের
মুক্তি নির্ভর করছে ।“
সত্যি বলতে সেই সময়
মাথামুন্ড কিছুই বুঝি নি । অসিতদাকে ফোন করেও বিশেষ লাভ হল না । উনি কেবল জানালেন , “ শুক্রের অবসানে শুক্র কেবল কাঁদে / অভিশাপে তার বিশ্বাসঘাতক এবার ফাঁদে…। ভাইটি মন দিয়ে কাজ করো ।“ টুক করে ফোন কেটে দিলেন ।
ডিসেম্বরের সকাল ৯টা একটু আগেই বেজেছে । আন্তর্জাতিক
বিমানবন্দরে চেকিং পর্ব মিটিয়ে মনে মনে প্রস্তুত হচ্ছি ১৫ ঘন্টা সফরের ।
আমার
চামড়ার সাইড ব্যাগে দুটি জিনিষ বাদে বাকী লাগেজ প্লেনের পেটে ইতিমধ্যে
চালান হয়ে গেছে । রাজা হ্যবকের দুস্প্রাপ্য ডাইরী । গোপনীয়তার কারনে মলাটে নাম
রেখেছি , “ ফ্রাইডে
নাইট “ ।
মাঝে
মাস সাতেক যেটা একটু নতুন ভাবে আবিষ্কার করেছি সেই জমাট বাঁধা সবুজ গ্যাস – ‘ সেরোটো অ্যাভিনা ‘, রয়েছে ছোট্ট একটা পিন আঁটা মোটা অথচ শক্ত
ইঞ্চি তিনেকের শিশিতে । ভারতীয় ভেষজ যে কত আশ্চর্য এবং কার্যকারী তার প্রকৃষ্ট নমুনা
হল ওষুধটি । মানুষের মস্তিষ্ক এমন একটি বস্তু যে নিজে ব্যাথা বোঝে না ঠিকই কিন্তু
অদ্ভুত ভাবে তার কষ্টের অভিব্যক্তি জানিয়ে দেয় । তারই কিছুটা সমাধানে আবিষ্কার
করেছি ওষুধটিতে
।
কয়েকটি গিনিপিগ ছাড়া এখনও মানুষের উপর প্রয়োগ করার দুঃসাহস করে উঠতে পারি নি ।
এক মাস আগে অসিতদার আরেকবার ফোন এসেছিল , কেন জানি না মনে
হল সেরোটো অ্যাভিনা কাজে লাগলেও লাগতে পারে ।
২
খারাপ আবহাওয়ার জন্য দু’ঘন্টা
দেরী করে ভারতীয় বিমান নিশীথ সূর্যের রাজধানী অসলো বিমান বন্দরের মাটি ছুঁলো ।
নরওয়ে ইউরোপ মহাদেশের ব্যস্ততম নগরী হওয়া সত্ত্বেও প্রাকৃতিক দৃশ্য অসাধারণ ।
তাছাড়াও জড়িয়ে রয়েছে নানা মিথ ,
লৌকিক
গাঁথা । আমি বিমানেই ঘড়ি মিলিয়ে নিয়েছিলাম । সময় বলছে রাত ১০:৫০ মিনিট , ভারতীয়
সময় এখন ২:৩০ মিনিট । খিদেতে ভারতীয়
পেট চুঁইচুঁই করছে । ইতিউতি দেখতেই খেয়াল করি অসিত’দা
ছেলে ঋককে নিয়ে হাজির । আমাকে দেখতে পেয়ে খাঁটি বাংলায় বলে উঠলেন , “ রোহিত এই যে এদিকে ।“
কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরে বললেন , “ তাড়াতাড়ি চল । খুব খিদে পেয়েছে নিশ্চয় । এখানে কিছু খাবে ? না বৌদির হাতের সর্ষে দিয়ে শ্যামন মাছের ঝাল
খাবে ?” শেষের
দিকে দাদা আর ছেলের চোখে মিষ্টি হাসি ।
আমিও হেসে উত্তর দিলাম , “ বৌদিই ঠিক আছে , চলুন
এবার । খাওয়ার কথা বলে খিদে বাড়াতে হবে না আর ।“
এখানে একটা কথা বলা ভাল ,
আমি যত কটা প্রগতিশীল দেশে গেছি ,
লক্ষ্য
করেছি পরিবহণ আর ট্র্যাফিক ব্যাবস্থা অতুলনীয় । আমাদের গাড়ী বেশ গতি নিয়েছে । কথায়
কথায় দাদা জানালেন যে আমরা এখন বুকমাল যাচ্ছি । বুকমাল রাজধানী অসলোর পূর্বে
অবস্থিত । গাড়ী চলছে । রীতিমত ঠাণ্ডা লাগছে । আবহাওয়া পরিষ্কার ।
আকাশের
রঙ লাল আর হলুদের মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করেছে ।
আকেরসেলভা নদীর বাঁক পেরিয়েই অসিতদার মিষ্টি একটা বাড়ী ।
আলো কম থাকায় বুঝলাম , বাড়ীর
সামনের দিকটা বেশ ফাঁকা । পায়ের তলায় মখমলের মত কালচে ঘাসের গালিচা । পাশেই টিউলিপ
আর ডেফোডিলে বাগান সেজে উঠেছে ।
অসিত’দা
বেল টিপলেন । ঋক নিজের হাতেই আমার ব্যাগ রেখেছে । ভালো লাগলো বঙ্গ তনয়ের
ব্যাবহারটি । সুন্দর মিশুকে বাঙালী এই বোধের জন্য ওর মা বাবাকে অবশ্যই মনে মনে সাধুবাদ
দিতে হল । বাঙালী এখনো ভদ্রতা যে জানে তা ভেবে ভালোই লাগলো । তবে এই ভাব বেশীক্ষণ
ধোপে টিকলো না ।
“ ক্জার
কম নি “ বৌদির
এই কথায় বোকার মত দাঁড়িয়ে রইলাম । আর ওদিকে বাপ-ব্যাটা
হো হো করে হেসে কুটিপাটি ।
“ আরে
ভিতরে চল হে , বৌদি
আপ্যায়ন করছে তোমায় “ অসিতদা
কোন মতে হাসি থামিয়ে বললেন । আমি থতমত খেয়ে আছি দেখে বৌদি বাংলায় বললেন এবার , “ এসো ভাই ।“ আবার
চমক ।
বৌদি এগোট নরওয়ের মেয়ে । অসিত’দা ফ্রান্সে পরাশুনার জন্য
এসে প্রেম থেকে বিবাহ সম্পূর্ণ করেন এগোটের সাথে । ভদ্রমহিলা খুবই শিক্ষিত ।
নরওয়ের স্কুলে পড়াতেন । বর্তমানে দম্পতি অবসর জীবনযাপন করেন । একমাত্র ছেলে এখানেই চাকরী
করছে । বুঝলাম দাদা এখানে পাকাপাকি থেকে যাবেন বলে বদ্ধপরিকর । সত্যি মানুষ এক
আশ্চর্য জীব । যাযাবর বা পরিযায়ী পাখিরাও হয়তো এই প্রাণীকে দেখলে ঈর্ষা করে ।
৩
ঘুম দিব্যি হয়েছিল । ঘুম ভাঙতেই ভাবলাম , এ বাবা এখনও তো
ভোর । ভুল চিন্তা । আমি যে এখনও ভারত ভেবেই রয়েছি নিজের মধ্যে । না ভাবার কারণ নেই
। ঘরের মধ্যে প্রায় পুরোপুরি বাংলার পরিবেশ ।
বাগানে চা আর জলখাবারের ব্যাবস্থা । ছেলে ঋক অফিসে বেরিয়ে
গেছে । এখন আমরা তিনজন ।
অসিত’দা সরাসরি আসল কথায় আসলেন । বললেন , “ রোহিত এগোটের বিষয়ে বলার আগে তোমায় একটা প্রশ্ন করি ,
বিশ্বের ইতিহাসে কলঙ্কিত বা বিশ্বাসঘাতক চরিত্রের অভাব নেই । বলতে পারো এদেশের সে
কে হতে পারে ?”
ইতিহাস নিয়ে তেমন একটা ঞ্জান আমার নেই । তবে অগ্রহ আছে
মোটামুটি । খানিক চুপ থেকে বললাম ,” নেটের দৌলতে অনেক কিছু হাতের মুঠোয় , ভিদকুন
কুইজলিং সে তালিকায় পরে ।“
চায়ের কাপ বুক অবধি তুলে দাদা একটু সময় আমার দিকে তাকিয়ে
থেকে বললেন , “ সব কিছু কিন্তু নেটে থাকে না । বলতে পারো অনেক ইতিহাসের বইতেও থাকে
না । “ কথাটা সত্যি তাই কিছু উত্তর দিলাম না । অসিত’দা নিজেই বলতে থাকলেন আবার , “
এগোটের সম্পর্কের আত্মীয় হলেন অ্যালেকজান্ডার ভরোনিন । ভিদকুনের স্ত্রী । যদিও
তিনি পরবর্তীকালে সম্পর্কে আর থাকেন নি ।
১৯৪০ সালের ৮ এপ্রিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অংশরূপে ব্রিটিশ অপারেশন উইলফ্রেড শুরু হলে নরওয়েও তার নিরপেক্ষ ভূমিকা পরিত্যগ করে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। জার্মানির পরাক্রমশালী যুদ্ধ জাহাজ ‘ক্রইজার ব্লুচার’ নরওয়ে
দখলের জন্য দ্রুতই এগুতে থাকে।
কিন্তু পারে না । নরওয়ের প্রত্যাঘাতে ডুবে যায় । নরওয়ের লোক হয়েই কেবলমাত্র
ক্ষমতার লোভে ভিদকুন হিটলারকে সাহায্য করেছিল । করেছিল নিজের মাতৃভূমির প্রতি
বিশ্বাসঘাতকতা ... তুমি ভাবছো কেন বলছি এসব তাই না ...?” আমার দিকে তাকেলেন দাদা ।
বৌদি চুপচাপ চা খাচ্ছেন ।
আমি বললাম , “ ফাইডে নাইট ডায়েরীতে এসবের উল্লেখ ছিল কিন্তু
কম । সেখানে তো...”
আমাকে থামিয়েই বললেন অসিতদা , “ একটু ধৈর্য ধরতে হবে ভাই ,
আমি আসবো সে কথায় । ১৯৪৫ সালে ৩০ এপ্রিল হিটলারের আত্দহত্যার পর কুইজলিং বুঝতে পারেন দ্রুতই ঘনিয়ে আসছে তার দিন। যদিও এর আগে জার্মানির সাহায্য ভিদকুন নরওয়ের
অধিপতি হন । কথায় আছে ভগবানের মার একবার । পারলেন না ভিদকুনও । যুদ্ধ শেষে তিনিও
সব ক্ষমতা ধীরে ধীরে হারালেন । অবশেষে হলেন রাজবন্ধী ।“
এগোট বৌদি এবারে মুখ খুললেন , “ মিঃ রায় সে ইতিহাস অন্য ।
পরে বলা যাবে । ভিদকুন জেলে বেশ কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছিলেন কিন্তু
পারেন নি । ফায়ারিং স্কোয়াডেই গুলি করে মারা হয় । কিন্তু কথা হল কেন তিনি
আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন ? অ্যালেকজান্ডার ভরোনিনের সাথে আমার শেষ দেখা হয় ১৯৯০ এ
। আমাকে একটা ডায়েরী তখন দিয়ে বলেছিলেন , ‘ গুড ভিল অলদ্রি টিলগি অস ‘ অর্থাৎ
ঈশ্বর আমাদের ক্ষমা করবেন না । এর তিন বছর পর উনি মারা যান ।“
মনে মনে আশ্চর্য হলাম । ফ্রাইডে নাইটে দেবী ফ্রিয়ার কথা
উল্লেখ আছে । তিনি জীবনের সকল অনুভূতির দেবী । তিনি ইচ্ছা করলে সৌন্দর্য , যৌনতা ,
আবেগ সব কেড়ে নিয়ে হতাশার অন্ধকারে ঠেলে দিতে পারেন । আমি ভাবছিলাম সেই কথাই । মিল
পাচ্ছি , অনুমান করতে পারছি কিন্তু ধরতে পারছি না যে এরা ঠিক কী বলতে চাইছেন ।
“ বৌদি আমাকে কী করতে হবে বলুন । সব যেন ধোঁয়াশা । দাদা
একটা হেঁয়ালি করে চিরকুট পাঠিয়েছিলেন যদিও কিন্তু ...”
অসিত’দা জেটস্ট মাখানো পাউরুটির আমাকে দিয়ে বললেন , “ খেয়ে
দেখো ভালো লাগবে । ছাগলের দুধের চিজ আছে ওতে ।“
বেশ খেতে কিন্তু উত্তর না পেয়ে আবারও অসিত’দার দিকে তাকিয়ে
থাকলাম । দাদা পাউরুটি চিবোতে চিবোতে বললেন , “ দেখো এখানকার মানুষ খুবই স্বাধীন
মনের । আমরা মানে আমি দীর্ঘকাল এখানে থাকার জন্য তেমনটাই হয়ে গেছি
। ছেলের
বিয়ে হবে শীঘ্রই ।“
দাদা বার বার কথা এড়িয়ে যাচ্ছেন দেখে বিরক্তি লাগছিল কিন্তু
মুখে বললাম “ ভালোই তো দিন না । পাত্রী কী বঙ্গ তনয়া ?”
“ নো মাই ডিয়ার । পাত্রী নয় পাত্র । ঋক সমকামী । একটি ছেলে
কে ভালোবাসে । বিয়ে করতে চায় ওর সাথে ।“ কথাটা শেষ করে দম্পতি আমার মুখের দিকে
তাকিয়ে আমার অভিব্যাক্তি ঠাওর করার চেষ্টা করতে লাগলেন । আমি নিজেও স্বাধীনচেতা ।
ভারতও এ বিষয়ে অনেকটাই এগিয়েছে যদিও ।
সংযত গলায় বললাম , “ বেশ তো সমস্যা কী ?”
৪
ঠিক একদিন পর অলিভার সমেত আমরা সকলেই ট্রমসো শহরে পারি
দিলাম । অলিভার হানসেনকে ঋক ভালোবাসে । ওর আদি বাড়ী নরওয়ের এই ছোট্ট শহরে ।
এখানকার দৃশ্য বিশেষ কিছু বলার নেই । কারণ ওই দৃশ্য বর্ণনা করার ক্ষমতা আমার নেই
তেমন । উপরে ঘন-গাঢ় তুঁতে নীলের মিশ্রণ আর পায়ের তলায় মচমচ করছে বরফ ।
অসিত’দা বললেন , “ ভায়া নর্দার্ন লাইট বা অরোরা বুরিয়াল
বলে এই আলোকে । চলবে ২১ শে জানুয়ারী অবধি । সারা পৃথিবী থেকে কত মানুষ আসে এই
রহস্যময় আলোর খেলা দেখতে ।“
আমি অবাক বিস্মিত । ‘হে প্রকৃতি কী অপার মহিমা তোমার , আমরা
তো কীটস্য কীট ।‘ সেইদিন বেশী কথা হয় নি । শুধু এটুকু ঋকের কাছে জেনেছিলাম অলিভার হানসেনের
বৃদ্ধ দাদু ইগিল হানসেনের নব্বই এর কোঠায় বয়স । তিনি দেবী ফ্রিয়ার উপাসক ।
অলিভার মা জীবিত । বাবা মারা গেছেন কয়েকবছর আগে । চাকরী
সূত্রে অসলোতেই থাকে অলিভার । মাঝেমধ্যে এখানে আসে । ওর আর ঋকের কথা তারা জানেন ।
মেনেও নিয়েছেন ।
আমি অসিত’দার কানে কানে বললাম , “ আমরা কী ঘটকালী করতে
এসেছি ?”
হাঁটা একটু থামিয়ে দাদা জবাব দিলেন , “ অবাক লাগছে তাই না ।
ভারত হলে ভাবাই যায় না । এখানে অবশ্য ২০০৯ সালেই স্বীকৃতি পায় । তবে কী জানো দাদু
প্রাচীনপন্থী ।ওঁর মতটা খুব জরুরী । যদিও অমতেও অসুবিধা নেই ।“
বাড়ীর দরজা খুললেন মা মার্গিট হানসেন । বয়েস আনুমানিক ৫৬ ।
দেখলেই মন ভালো হয়ে যায় এমন মহিলা । ইংরাজি জানেন না । সুতরাং দোভাষীর ভার খুশী
মনে নিল অলিভার । আমি যদিও বাকী ঘটনা-কথা বাংলাতেই লিখলাম ।
ভদ্রমহিলা আমাদের বসতে বলে প্রত্যেককে এক গ্লাস করে গ্লগ
দিয়ে গেলেন । খাবো কী খাবো না বুঝতে পারছিলাম না । অলিভার মিষ্টি ছেলে । আমার
চেয়ার পিছনে এসে দুহাত দিয়ে গলা জড়িয়ে বলল , “ খেয়ে নাও । দারুন খেতে । আলু , ধনেপাতা
আর লোকাল স্পিরিট দিয়ে ঘরে বানানো ওয়াইন । অতিথি এলে আমরা দেই ঠিক চায়ের মত ।“
তাকিয়ে দেখি অসিত’দা চুমুক দিতে দিতে হাসছেন । অর্থাৎ অভয় দিলেন । মিষ্টি মিষ্টি
স্বাদ ।
আমরা এখানে এসেছি দেড় ঘন্টা পার হয়ে গেছে । হঠাৎ একটা পায়ের
আওয়াজে মার্গিট জানালেন ইগিল অর্থাৎ ওর শ্বশুরমশাই আসছেন ।
বৃদ্ধের পরনে মোটা জোব্বা । বরফের মত লম্বা সাদা চুল ।
পিছনে দুই হাত । আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ । ঘরের পরিবেশটা রাশভারী
মানুষটার উপস্থিতিতে থমথমে হয়ে গেল ।
নিজেই বসলেন কোণার দিকের আরাম কেদারায় । চোখ দুটি বন্ধ ।
দেওয়াল ঘড়িতে টিকটিক শব্দ ছাড়া এতগুলো মানুষের নিঃশ্বাসও যেন এক লহমায় থেমে গেছে ।
বেশ অনেকক্ষণ পর তাকালেন পুনরায় অলিভার আর ঠিক পরেই ঋকের দিকে । চোখ দুটি দিয়ে যেন
বিদ্যুতের ঝলকানি । সহসা তীক্ষ্ণ গলায় ওদের দুই জনের দিকে আঙুল তুলে বললেন , “
ফোরবান্নেলেশ আভ ফ্রিয়া , হেলস ভিল ইক্কি ভ্যারে ব্রা...। গো ব্রট লপ ...।
কথাটা শোনার পরেই দেখলাম আমি ছাড়া সকলের চোখেই কেমন জানি না
ভয়ের ছাপ । বৃদ্ধ কথাটা বলার পরেই ঝিম মেরে বসে পড়লেন । মনে হল সমস্ত শক্তি উনি
হারিয়েছেন । অলিভার আর ঋক ধরাধরি করে পাশের একটা ঘরে নিয়ে গেল । খানিক পর এসে
জানালো যে ওদের দাদু ঘুমিয়ে পরেছে ।
মিসেস মার্গিট রাতের খাবার পরিবেশন করেছেন একটু আগেই । এগোট
বৌদি নিজেদের ভাষায় কথা বলতে বলতে হাতে হাতে কাজ করে দিচ্ছেন । আমার কেন জানি না
সব মিলিয়ে একটা অস্বস্তি লাগছে । বাধ্য হয়েই বলেই ফেললাম , “ অসিত’দা সব কাজ ফেলে
এসেছি দেশে কিন্তু এখনও অবধি ঘটকালী ছাড়া আসার উদ্দেশ্য কিছুই বুঝলাম না !”
অসিত’দা খেতে খেতে বাঁ হাত দিয়ে আমার হাতে হাত রেখেই বললেন
,” রোহিত উদ্দেশ্য কিন্তু তোমার চোখের সামনেই ছিল । বৃদ্ধ ইগিল । কাল সকালে বাইরে
কোথাও বলি কেমন ।“
৫
তেলেগ্রাফবুক্তা হল ট্রমসো শহরের অন্যতম সুন্দর সমুদ্র সৈকত
। দিনের টিকিট কেটে শৈলশিখর বেষ্টিত নিরালা এক জায়গায় আমি আর অসিত’দা বসলাম । হুহু
করে বইছে শীতল বাতাস । দাদা মুখ খুললেন , “ ফ্রাইডে নাইট ডায়েরীতে দেবী ফ্রিয়ার
অভিশাপ যে লেগেছিল তা তুমি জেনেছো ।
ভরোনিন যে ডায়েরী দিয়েছিলেন , সেটা তাঁর যে লেখা নয় সেটা সহজেই অনুমান করা
যায় । বহুবছর আগে রাজা হ্যবনের পাঠাগারের দায়িত্ব প্রাপ্ত গ্রন্থাগারিক এটি হাতে
পান এবং লোভে পরে ওটি বিক্রী করে দিয়েছিলেন জার্মানীতে ।“
একটা পাখি অনেকক্ষণ ধরে ডেকে যাচ্ছে । দাদার কথার মাঝেই
টানা শিষ দিচ্ছে । আমার মন ওইদিকেই ।
“ ওটা হোয়াইট টেল ঈগল । শোন এবার । বেন মিলার সেই জার্মান ব্যাবসায়ীর কাছ থেকে হস্তান্তরিত
হয় বইটি ফ্রান্সে । এর কারণ অবশ্য অদ্ভুত । বেন মিলার তাঁর এক জীবনীতে লিখেছিলেন , ‘ বইটি
পাওয়ার পর আমার ঘর অন্ধকারে ডুবে যায় । আমি হতাশায় পরি যখন জানতে পারি আমার পৌত্র
সমকামী । অর্থাৎ আমার বংশ শেষ । আমি ক্রমেই বুঝতে পারি রাজা হ্যবন ইচ্ছে করেই বইটি
তাঁর সুরক্ষিত পাঠাগার থেকে কৌশলে সরিয়েছিলেন । লোকে জানলো চুরি ! হা ঈশ্বর লোভের
শাস্তি পেলাম ।‘ আমার মনে হয় বর্তমানে যে ফ্রাইডে নাইট আমরা পেয়েছি তার মধ্যে
মিলার নিজের লেখা কিছু অংশ জুড়ে পাচার করেছিলেন ফ্রান্সে ... অ্যালেকজান্ডার
ভরোনিনের কাছে ।“
এতক্ষণ এক নাগাড়ে কথা বলার পর থামলেন অসিত’দা । আমি ভাবতে
লাগলাম এই জটিল অঙ্ক । খানিক পরে বললাম ,” কিন্তু লাভ কী দাদা অ্যালেকজান্ডার
ভরোনিনের কাছে ওটি বিক্রী করে ?”
গ্লাভস দুটো খুলে দুই হাতের তালু ঘসতে ঘসতে বললেন , “ এক
ঢিলে দুই পাখী শিকার । আসলে মিলারের রাগ গিয়ে পরে নরওয়ের রাজার উপর । তারজন্যই
হিটলার নরওয়ে দখল করতে পারে নি । দুর্ভাগ্যের বিষয় ভরোনিন যে ভিদকুনের স্ত্রী
মিলার জানতেন না । ভুল করে সেই অভিশপ্ত বই দিলেন ভরোনিনের কাছে । ভেবেছিলেন রাজার
বংশধরও একইভাবে অবলুপ্তি হবে । কপাল ! এগোট আমার স্ত্রী সেই ভিদকুনেরই বংশধর ।“
আর কোন কথা হল না । গাড়ীতে যেতে যেতে আমি বললাম , “ আপনি কী
আশাহত দাদা ? ছেলে...!” মুখটা গম্ভীর দেখে আর কিছু বললাম না ।খানিকটা যাওয়ার পর
অসিত’দা রাস্তার একপাশে গাড়ীতে ব্রেক কষে বললেন , “ এ অভিশাপ শেষে আমারও লাগলো ।
আমি মেনে নিতে পারছি না । অথচ ওরা এই সম্পর্ক থেকে বেরোবে না আমি জানি । বহু বছরের
সম্পর্ক ।“
গলায় আকুতি । আমি হেসে বললাম , “ এত চিন্তা করছেন কেন । এ
কোন অভিশাপ নয় দাদা । দুজনের ভালোবাসা এ তো প্রাকৃতিক । আপনি এত বছর বাইরে থেকেও
এখনও মুক্ত মনের হতে পারেন নি ।“
খেয়াল করলাম অসিত’দা চয়াল শক্ত করে আমার কথা হজম করলেন ।
স্টেয়ারিং এ হাত রেখে বললেন , “ তোমার সেরোটো অ্যাভিনা , যার কথা বলেছিলে ওটা ঋকের
উপর প্রয়োগ কর । ওঁকে মুক্ত হতেই হবে এই অভিশপ্ত জীবন থেকে ...।“ শেষের দিকে গলার
স্বর জোরালো অথচ শান্ত ।
বাড়ী ফিরে দেখলাম বৃদ্ধ ইগিল দুই নাতির সাথে রসিকতা করছেন ,
বাচ্চাদের মত হাসছেন । গতরাতের তীক্ষ্ণ ভাব উধাও ।
অসিত’দা গাড়ী থেকেই নেমেই আমার হাত দুটি ধরে বললেন , “ দেবী
ফ্রিয়া আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন ভাই । বৃদ্ধ ইগিলের উপর দীর্ঘদিন ভর করেন দেবী । কাল
সন্ধ্যে বেলায় নরওয়ে ভাষায় ওটাই বলে সতর্ক করেছিলেন দেবী । আমি নিয়ে যাবো সেই
ঝরনার গুহায় যেখানে আজও দেবী রয়েছেন । ইগিল তার পুরোহিত ।“
৬
বৃদ্ধ ইগিল মার্গিটকে বাদে সকলকে নিয়ে সেইদিন সন্ধ্যেবেলা
অন্য পথ ধরে নিয়ে গেলেন সেটেরগ্রোট্টা গুহায় । ট্রমসোর বাড়ী থেকে এই গুহা অবধি
সুড়ঙ্গ পথেই এলাম । সাধারণরাও নাকী এখানে বেড়াতে আসেন তবে অন্যপথে ।
পথ যত এগোচ্ছে বাইরের যেটুকু আলো ছিল তাও অন্ধকার এখন । অদ্ভুত
ভিজে ভিজে গন্ধ । কয়েক জায়গায় হাঁটু মুড়ে প্রায় হামাগুড়ি দিতে হচ্ছে । ঘুটঘুটে
অন্ধকার পথটা ইগিলের হাতের তালুর মত চেনা । প্রত্যকের কোমরের সাথে দড়ি বাঁধা ,যাতে
কেউ হারিয়ে না যাই । ইগিলের পিছনেই অলিভার । তারপরে এগোট বৌদি আর আমি সকলের শেষে ।
আমার সামনে ঋক ।
একসময় থামলাম । কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছি না । কথা বলা বারণ ,
দেবী নইলে কুপিত হবেন । খানিক পরেই গুণগুণ শব্দ ক্রমশ গাঢ় হতে লাগলো । বুঝলাম ইগিল
কাকে যেন আহ্বান করছেন ।
“ ভোকনে ফ্রিয়া ভি আর আল্লে হার , দেবী ফ্রিয়া জাগো এসেছি
আমরা ...।” গুহার দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বৃদ্ধের আহ্বান । কেমন যেন গায়ে কাঁটা দেওয়ার মত পরিবেশ । পায়ের তলাটা বেশ
ভিজে ভিজে লাগছে । ঠিক তখনই ধপ করে জ্বলে উঠলো মশালের মত একটা জিনিষ । আলোর
স্পর্শে কতগুলো বাদুর ফরফর করে বেরিয়ে গেল ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে ।
উজ্জ্বল আলোয় চোখটা প্রথমে ধাঁধিঁয়ে গেছিলো । হাতটা সরাতেই
অবাক । গভীর গুহার একধার দিয়ে যে সবুজ নদী বয়ে যাচ্ছে ঠিক তার কোন বরাবর গুহার
একটা দেওয়াল উঠে গেছে । লম্বাটে আকৃতির দেবী ফ্রিয়ার প্রস্তর মূর্তি । পাশেই
অদ্ভুত পাথরের সিংহাসন । আলো লেগে সেখান থেকে নানা বর্ণ ঠিকরে বেরোচ্ছে । এগোট
বৌদি ‘ ফ্রিয়া ফ্রিয়া ‘ বলে মাথা নত করলেন । ইগিলের এক হাতে মশাল । আমি ওর চোখের
দিকে তাকাতেই ভয় পেয়ে গেলাম । ক্রোধ যেন ঝরে পরছে । অলিভার অসিত’দার গা ঘেঁষে
দাঁড়িয়ে আছে ।
কিন্তু একী ...!! ভুল দেখছি না তো ! ঋক ওখানে কেন ? অসংখ্য
আলোর মাঝে দেবীর পায়ের তলায় ! ওখানে তো ইগিলের থাকার কথা । ঋকের হাত ক্রমশ উপরে
উঠছে আর বৃত্তাকারে ঘুরছে । মুখে বিড়বিড় করে যেটা বলছিল তা প্রতিধ্বনিত হয়ে গুহার
চারিদিকে ছড়িয়ে পরছে –
“ চতুরবর্নম ময়া সৃষ্টং
গুনকর্মবিভাগশঃ
তস্য কর্তারমপি মাং
বিদ্ধাকর্তারমব্যয়ম্ ।“
আমার হাত কেন জানি না ঠিক সেই মুহূর্তে কাঁধে ঝোলানো চামড়ার
ব্যাগে চলে গেছে । অস্তিত্ব অনুভব করার চেষ্টা করলাম ‘ সেরোটো অ্যাভিনা ‘র ছোট্ট শিশিটাকে । পেলাম
না । চুরি হয়ে গেল নাকী !
দাদা আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললেন , “ ঋক ভারতীয়
সংস্কৃতির উপর বেশ চর্চা করতো জানতাম কিন্তু ও কী বলল জানো রোহিতাশ্ব ?”
আমিই যে সংস্কৃতে বিশাল পন্ডিত তা নয় তবে এটা ঠিক ভেষজ নিয়ে
কাজ করতে গিয়ে সংস্কৃতের সাহায্য নিতে হয় প্রায়ই । আমি বললাম , “ ভগবৎ গীতার চতুর্থ
অধ্যায়ের ঞ্জান যোগ । শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন কর্মের জন্য চার বর্ণের সৃষ্টি । এই বর্নের
উপরেই আমার অবস্থান । কর্মেই ধর্ম নিহিত । “
অসিত’দা খানিকটা উত্তেজিত হয়ে বললেন , “ পাগল হল নাকী
ছেলেটা গীতা আওড়াচ্ছে দেবী ফ্রিয়ার আসনে !!”
আকস্মিক বৃদ্ধ ইগিলের মুখে হাসির রেখা দেখা দিল । মশালটা
হাত থেকে খসে পরতেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো , “ নর্স , দেবি ফ্রিয়ার আশীর্বাদ ...নর্স
তুমি ধন্য ...। অভিশাপ থেকে মুক্তির রাস্তা দেখাও দেবী ।“
ঋকের হাত এখন মুঠো । চোখ খোলা । স্থির হয়ে আছে মণি । আমরা
এগিয়ে গেলাম ঋকের কাছে । অপর হাতের ইশারায় আরও কাছে আসতে বলল । গেলাম । প্রত্যেকের
হাত খুলতে বলল আঙুল নাড়িয়ে ।
সবুজ আলোয় গুহা ভরে উঠলো । সেরোটো অ্যাভিনা !! তারই আলো ।
ছিপি খুলে ইগিল আর অসিত’দাকে দিলো ঋক । অলিভার হাত বাড়াতেই এগোট বৌদি ওর হাতটা ধরে হ্যাঁচকা টান মারতেই হুমড়ি
খেয়ে পরে ঋকের উপর । মুহূর্তের মধ্যে শিশিটা শক্ত পাথরে লেগে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়
। লক্ষ্য করলাম একটা সবুজ গ্যাস ধীরে ধীরে সুক্ষ তরলে পরিণত হয়ে যাচ্ছে । এক-দু
ফোঁটা ঋকের ঠোঁটের উপর গিয়ে লাগলো ।
খানিক পরে ধুপ করে দুবার শব্দ হতেই দেখি ইগিল আর অসিত’দা
মাটিতে পরে আছেন । পা আর ঠোঁটটা তিড়তির করে কাঁপছে । বৌদি ছুটে যেতে চাইলেন কিন্তু
আমি বাধা দিলাম । বৌদির চোখে আশঙ্কা ওই তিনজনকে ঘিরে । অলিভার ঋকের মাথাটা নিজের
কোলের উপর নিয়ে বসে আছে । কিন্তু আমি শান্ত ।পরম নিশ্চিন্ত ।
৭
জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে অসিত’দার একটা চিঠি পেলাম । সঙ্গে
একটা কার্ড ।
“ ভাই রোহিতাশ্ব ,
ভারতীয় ভেষজকে দেবী ফ্রিয়ার প্রসাদ ভেবে
আমরা খেয়েছিলাম । দেখলাম মিথ্যে কল্পনার জগত থেকে ইগিলের মত আমিও বেরোতে পেরেছি ।
মাথাটা বড্ড হালকা লাগে । ভালো স্বপ্ন দেখি । স্প্লিট মেন্টালিটি কখন যে প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়াতে পরিণত হয়েছিল তা আমরা কেউই
টের পাই নি ।
ইগিলের সাথে পরিচয় আমার দীর্ঘদিনের । দেবী ফ্রিয়ার প্রতি
আকর্ষণ ক্রমেই বাড়তে থাকে ইগিলের কৃপায় । বুঝতেই পারি নি ওর মত আমিও একটা অলীক
কল্পনার রাজ্যে মাঝে মধ্যে চলে যেতাম । অবশেষে বুঝি আমার প্রতি ইগিলের একটা আক্রোশ
ছিল । কারণ তিনিই ছিলেন রাজা হ্যবনের সেই গ্রন্থাগারিক । বহুবছর রাজার গ্রন্থাগারে
থাকার দৌলতে পৃথিবীর নানা ভাষা-দর্শন সম্পর্কে গভীর ঞ্জান লাভ করেন । সংস্কৃতও বাদ
যায় নি । ভিদকুন কুইজলিং বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন রাজার সাথে । ইগিল জানতেন এই
প্রাসাদ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে ভিদকুনের হাতে । তাই রাজার সাথে পরামর্শ করে একটা
মিথ্যা প্রচার ওই ডায়েরীর পাতায় লিখে রেখেছিলেন । ডায়েরীটা মূল্যবান এক নথি । তাই
এই ব্যাবস্থা করেন তিনিই । পরে পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হলে ভেবেছিলেন বেন মিলারের কাছ
থেকে কিনে নেবেন । কিন্তু ততদিনে চলে গেছে এগোটের আত্মীয়ের কাছে । ‘ ফ্রাইডে
নাইটে’র কথা আমিই বলেছিলাম ইগিলকে। তারপর থেকেই আরও বেশী করে দেবী ফ্রিয়া আমার
জীবনে , সাথে নাতি অলিভার। ঋকের প্রতি ভালোবাসা , ফ্রিয়ার উপর অলৌকিকতা
সব গ্রাস করতে থাকে । যখন মাথা ঠান্ডা থাকতো তখন বুঝতাম কেন ইগিল এমন করছে ।
প্রতিশোধ । আমি যে ভিদকুনের আত্মীয় হয়ে গেছি এগোটকে বিয়ে করে । রাজভক্ত ইগিল
প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন আমাকে ধীরে ধীরে পাগল করে ।
আমি আর ইগিল সমকামী বিবাহে রাজী কোন কালেই ছিলাম না । কিন্ত
ঋকের প্রতি আমি যেমন ঠিক অলিভারও ইগিলের জীবনে দুর্বলতা । ইগিল পরে দেখলেন ভুল করে
ফেলেছেন অলিভারকে ঋকের জীবনে এনে । কারণ ওদের সম্পর্ক নাটক নয় ।
ইগিল নিজেও আমার মত সিজোফ্রেনিয়াতে ভুগছিলেন । মিথ্যে অভিনয়
করতে করতে মিথ্যেটাই সত্যি হয়ে গেছিলো । তবে তোমার সেরোটো অ্যাভিনা অসাধারণ । আমরা
সুস্থ এবং ভালবাসার কাছে পরাজিত হয়ে ঋক আর অলিভার বিয়ে দিতে চলেছি । তোমাকে আসতে
হবে ভাই । ফোন করে এত কথা যেহেতু বলা যায় না তাই এই চিঠি ।
ভালো থেকো ।
ইতি
তোমার দাদা ।
পুনঃ এটা জানতে পারলাম না ঋক কীভাবে সেরোটো অ্যাভিনা পেলো ।
আর বস্তুটি আসলে কী ?
চিঠিটা ভাঁজ করে ফোনে একটা ম্যাসেজ লিখলাম ।
“ গুহায় যাওয়ার আগের দিন ঋক আর বৌদির কাছে অনেকটাই জানতে
পেরেছিলাম । বলতে পারেন আমার , বৌদি আর ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ঋকের অভিনয়
ছিল সেদিন ।
ঋকের ঠোঁটে যেটুকু লেগেছিল তাতে মন্দের ভালো হয়েছে , সকল
নেগেটিভ চিন্তা যা এতদিন আপনারা ওর মনে ঢুকিয়েছিলেন নানা ছলে তা দূর হয়েছে ।
ও হ্যাঁ ওষুধটা ওটের খড় আর আমাদের শরীরের হরমোন সেরোটোনিন
দিয়ে বিশেষ ভাবে তৈরী । একটা কথা গীতার ওই শ্লোক আর ইউরোপের নস বা ফ্রিয়ার দর্শন
কিন্তু সমকামী মান্যতা দিয়েছে । ব্যাখ্যা নিজের নিজের মত ।
যাইহোক ঋক আর অলিভারকে আমার আশীর্বাদ জানাই ।।“