১
শহরের আর পাঁচটা ছেলের মত বড় হলেও আপাত নিরীহ বলেই পরিচিত সোম । পুরো
নাম সৌমেন হালদার । স্কুল থেকে কলেজ এই নামটা খাতায় কলমে ছাড়া বিশেষ ব্যবহৃত হয় নি
। মোটামুটি নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি বলতে যা বোঝায় সেই রকম পরিবারেই
বড় হয়েছে । অবশ্য ছোট পরিবারে ঠাকুমা দাদু এদের স্থায়িত্ব কমই থাকে ।
তবে ওদের বাড়ীতে ঠাকুমা আছেন । দাদু ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় গত হয়েছেন ।
উদ্বাস্তু
জীবনের নানা জটিলতা কাটিয়ে মোহিনী দেবী স্বামী পুত্রের হাত ধরে চলে আসেন বাংলার পশ্চিমের এক শহরে । শাল , মহুয়া আর প্রাচীন গাছে ভরা ওই অঞ্চল তখন পুরোপুরি
শহরের তকমা পায় নি । আত্মীয় স্বজন প্রায় সকলেই থেকে যায় কলের কলকাতায় । মোহিনীর
সকাল শুরু হত কারখানার ভোঁ দিয়ে । কালো পিঁপড়ের দল যেমন লাইন দিয়ে চলে
গন্তব্যস্থলে , ঠিক তেমনি কারখানার মজুর থেকে শুরু করে পদস্থ অফিসারের একটাই তাড়া
তখন কারখানায় যাওয়া ।
আজ থেকে পঞ্চান্ন বছর আগেকার ছবিটা ছিল ভিন্ন রকমের । সুর তাল ছন্দ সবই ছিল ভিন্ন গ্রামে বাঁধা ।
একমাত্র ছেলেকে কী ভাবে বড় করবেন এ চিন্তা সব থেকে প্রধান ছিল । তবে কারখানার সুবাদে মালিক পক্ষ তৈরী করে দিয়েছেন স্কুল
হাসপাতাল সবকিছুই । নিখরচায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা । এতটা সুখ যে মোহিনী দেবী
পেয়ে যাবেন তা তিনি কেন আত্মীয় পরিমন্ডলেও কেউ ভেবে উঠতে পারে নি । সমস্যা বা অজুহাত একটাই , ফেলে আসা আত্মীয়রা এখানে আসতেই ভয় পায় !
-
“ রাঙ্গা পিসি
তোমাদের জায়গায় যাব কি গো ! ” কলকাতা গেলে যতবার মোহিনী এখানে আসার জন্য
অনুরোধ জানিয়েছেন ঠিক ততবারই কথার সুর ওই ভাবেই শুরু হয়েছে । মহিনী দেবীও ছাড়বার
পাত্রী নন ।
-
“ কেন রে ! এমন
বলছিস যেন আমরা কোন ভিন্ন গ্রহে থাকি ।”
-
“ না গো বড্ড দূরে চলে গেছ !”
-
“ বাব্বা ! আমিও তো ওখান থেকেই আসি । ট্রেনে মাত্র তিন ঘন্টা ” মোহিনী দেবী খেঁকীয়ে ওঠেন ।
এই ভাবেই দিন বছর চলতে থাকে কালের নিয়মে ।
যে সূর্য মহানগরীর ইঁট কাঠের বক্ষে আলো ফেলতো তার রেশও এসে পৌঁছাত পশ্চিমের এই মালভূমিতেও । প্রকৃতির কাছে সকলেই সমান । বিভেদটা মানুষের অবয়বে
যত না বেশী , তার থেকেও বেশী মনের এক গোপন কুঠুরীতে । খাটিয়ে মোহিনী দেবী কিন্তু ছেলে আর স্বামীকে নিয়ে টুকটুক করে সংসারের যাত্রা এগিয়ে নিয়ে
যেতে থাকেন ।
ভাইফোঁটায়
ভাইরাও আসতে পারেন না ,নানা কাজের দরুণ । আগে খুব করে চিঠিতে আসবার জন্য অনুরোধ জানাতেন । কিন্তু পর পর কয়েক বছর দেখে নিয়েছেন যে, তারা যেন কোন অগচরে
প্রায় বাদের খাতায় হয়ে পরেছেন । দমে যান
নি তিনি । প্রতি ভাইফোঁটায় ঠাকুরের সিঙ্ঘাসনে ভাইদের নাম করে
চন্দনের ফোঁটা পরিয়ে দিতেন । আর নিজের মনেই খুশী হতেন । মানুষ স্বভাব ও অবস্থার
দাস । স্বভাব ও পরিবেশ একে অপরের পরিপূরকও বটে । দুজন দুজনের ভালো বন্ধু ।
২
সোমের বাবা বিকাশকে আর কলকাতার ছেলে বলা
যায় না । যদিও নাড়ীর সুত্র ও জন্মস্থান ওই কলকাতা । কিন্তু বড় হয়ে ওঠা , পড়াশুনা এমন কী মহিনী দেবীর তাড়ায় বিয়েও হয় এই শিল্পাঞ্চলে । হ্যাঁ তাড়া একটা ছিলই
বিকাশের । ছাত্র হিসেবে ভালোই ছিল । ভালো খেলতে পারত । সম্ভাবনাময় এক ছেলে ।
ভাগ্যটা আরও ভাল হল যখন এই বিকাশই বাবার কারখানাতেই খেলার যোগে চাকরীটা পেয়ে যায় । মোহিনী দেবীর আর তার স্বামীর চিন্তা অনেকটাই কমে
যায় । ভীষণ আগলে মানুষ করেছিলেন তাদের একমাত্র সন্তানটিকে ।
মাঝে মাঝে ভাবেন , কী করেন নি সেই প্রথম
দিন থেকে ! স্বামীর একটা স্থায়ী চাকরী জোটানোর জন্য নতুন কারখানার বড় বড় বাংলোর
অফিসারদের পা ধতেও বাকী রাখেন নি । স্বামীর চাকরী যতদিন না পাকা হয়েছে , ততদিন
স্বামীর সাথে প্রায় অন্ধকার ঘড়ে মোমবাতির আলোয় কুঁজো হয়ে ঠোঙা বানানোর জন্য হাতে
হাত লাগিয়েছেন । ছোট্ট বিকাশ যাতে হামা দিয়ে না বেড়িয়ে যায়, মায়ের মন শক্ত করে
ন্যাকড়ার দড়ি দিয়ে একটা পা বেঁধে রাখতেও পিছিয়ে যান নি । সন্ধ্যেবেলায় ঠাকুরকে ধুপকাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে বলতেন ,
“ তোমার দুয়ারে এসে পরেছি মঙ্গলে রেখ ।”
তরুন যুবক বিকাশ , মোহিনী
দেবী আর কান্তি বাবুর ছোট্ট আরামের সংসার দিব্যি কাটে এখন । সত্যিই হিংসা করার মত ।
চিঠিতে আজকাল আত্মীয় পরিজনেরা লেখে , ‘
ভাগ্য তোদের কোথা থেকে কোথায় নিয়ে গেল । ছেলে স্বামীর সরকারী চাকরী ! আমাদের দিন কেটে যাচ্ছে মোটামুটি । পারলে দেখিস তো তোদের ওখানে চাকরী হয় কি না ...ইতি দিয়ে শেষ ।’ মোহিনী দেবী কোন প্রতিশোধ নয়
বরং কিছুটা অবজ্ঞা করতেন এ সব আবেদন । এরা সব সুখের পায়রা । নিয়মের রাজত্বে, যে হিংসায় জ্বলছে তাকে জ্বলতে দাও । নিজে বাঁচো আগে । কাঁটা তার যেদিন তারা পেরিয়ে এসেছিল সেদিন ভাগ্য
দেবতা কোন ফাঁকে এই চরম বাস্তবটাও লিখে দিয়েছিলেন ।
উৎস থেকে মোহনায় লীন হওয়ার আগে কত যে
গতিপথ , বাঁক নিতে হয় সে এক মাত্র জানে নদী । জীবনের প্রবাহ বেশ খানিকটা স্রোতস্বিনীর
মতই । হঠাৎ মোহিনী দেবীর মধ্যে দেখা যায় এক মানসিক বিকার । স্বামী পুত্র মিলে
ডাক্তার দেখায় । পথ্য ও ওষুধের নিয়মে সেরেও ওঠেন মোহিনী দেবী । কী থেকে এমনটা হল
তা ঈশ্বরেই জানেন । ডাক্তার শুধু বলেছিলেন , “ অতিরিক্ত মনের চাপের জন্য এমনটা
হয়েছে ।” কান্তিবাবু , ছেলে বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিলেন ডাক্তারের কথা শুনে । মনের চাপ
আবার কোথা থেকে হল । অবশ্য এ বিষয়ে তাদের কম ধারনাই থাকা স্বাভাবিক । কারণ তাদের
অধিকাংশ দিনই কাটত ভোঁ শব্দে আর কারখানার এক নাগাড়ে বেজে চলা যান্ত্রিক আওয়াজে ।
সত্তরের উত্তাল শতকে সমগ্র বাংলা কাঁপছে । মোহিনী আর কান্তি সামলে চলেছেন সংসার আর
বিকাশের উঠতি বয়সকে । স্বামী-ছেলে খেলতে,
চাকরীতে যান আর ঘরে বসে পলতে কাটতে কাটতে বাড়ীতে সুস্থ ভাবে ফিরে আসার জন্য মনে
মনে প্রার্থনা করতে থাকেন ।
আন্দোলনের রেশ
কমতেই তরুণ বিকাশের উপর মায়ের নির্দেশ আসে , “ এবার বিয়ে করে সংসার সামলাও, আমি
অনেক কাল দেখেছি আর না ।”
গাছ থেকে পরে বিকাশ । মায়ের উপর বেশী কথাও
বলা যায় না । তবুও মনে জোর নিয়ে একদিন বলেই ফেলে, “ এখন কী মা , সবে একুশ বছর , দাঁড়াও ভালো করে সব গুছিয়ে নি ।”
-
“ তোমাকে যা বলছি
তাই কর । আর কী এমন গোছানোর আছে শুনি !” রাগে
গজ গজ করতে করতে মোহিনী দেবী বলে ঘড় থেকে উঠোনে বড়ি শুকাতে দিতে বেড়িয়ে পরেন ।
এরপর বিকাশের কেন কান্তিবাবুরও বিশেষ কিছু কথা চলতে পারে না । কান্তিবাবু স্ত্রীর আঁচল
ধরা স্বামী নন । বরং তিনি জানেন , মোহিনী না থাকলে বর্তমানের সুখ হয়ত কোনদিনই আসত
না । আরাম করে এখন ফ্যানের হাওয়া , প্রতি রবিবার ভরপেট মাংস খেয়ে আরামে ঢেঁকুর
তোলা বেড়িয়ে যেত ; তার স্ত্রী তার কাছে এক শক্তি, এটা সমীহ । এক নারীর জেদ ,
অধ্যাবসায়ের প্রতি সম্মান । পুরুষের এই বোধ থাকাটা দরকার ।
যাইহোক এক তরফা নির্দেশ হয়ে যায় । বিকাশের একটাই চিন্তা ।
তার মা বলে নয় , যে মেয়েকে আনবে তাকে হতে হবে শান্ত
ধাঁচের । না হলে শাশুড়ির সাথে ঘড় করা দু’দিনেই লাটে উঠবে । মোহিনী দেবীর কথার ঝাঁজ
আর মাঝে মধ্যে মানসিক বিকার ক’টা মেয়েই বা মেনে নেবে ।
আগেই বলেছিলাম মোহিনী দেবীর কপালটা অনেক
দিক দিয়েই ভাল । ছেলে ও সংসারের মানান সই মেয়েও পেয়ে যান । বিকাশেরও হয়ে যায়
বিয়ে । দু’বছরের মাথায় জন্ম হয় সোমের । শুরু হয় আবার এক নব প্রজন্মের যাত্রা ।
৩
সোম দাদু ঠাকুমার চোখের মণি । নাতিকে নিয়ে তাদের স্বপ্ন । স্বামী
কান্তিবাবুর মৃত্যুর পর এই নাতিই যেন তার সব থেকে আপন জন । ফেলে আসা নানা স্মৃতি যখন ভিড় করে আসে
তখন সুযোগ পেলেই নাতির কাছে গল্প করেন । সোম কিন্তু দাদুকেই বেশী পছন্দ করত । সে
যখন ছোট্টটি ছিল তখন ঠাকুমা বাবা মা সকলকে লুকিয়ে কত কী আবদার পূরণ করতেন । দুরন্ত
ক্যানসার দাদুকে যখন ছিনিয়ে নিয়ে যায় তখন সোমের ক্ষুদ্র হৃদয়ে বেশ খানিকটা দাগ
ফেলে গেছিলো । মারণ রোগের ওই দগদগে যন্ত্রণা , ভাবলেও শিউরে ওঠে !
-
“
হ্যাঁ রে আমাকে তোর ভাল লাগেনা , না !” মোহিনী দেবী নাতিকে প্রশ্ন করেন ।
-
“
এই নিয়ে কতবার এক কথা বলবে বলত ” সোমের উত্তরে চুপ করে যান ঠাকুমা । এই একজনেরই
কাছে তিনি সর্বদাই নত মস্তক ।
এখন এটা বিকাশের
সংসার । বিকাশ এখন পুরোপুরি বাড়ীর কর্তা । সোম, সেও আর সেই ছোট্টটি নেই । বৌমা
কিন্তু আগের মতোই রয়ে গেছে । একদম ঘরোয়া মেয়ে । মোহিনী দেবীর ঝাঁজও গেছে কমে ।
অবশ্য আমরা যেটাকে ঝাঁজ ভাবি তা কিন্তু নয় ! জীবনের রেলে সংগ্রাম নামক ইঞ্জিনটা
চলতে চলতে ক্লান্ত হলে যে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে , এ যেন তারই প্রতিবিম্ভ ।
আমাদের গল্পটা কিন্তু মোহিনী দেবী ও তার
সংসারের ইতিহাসকে শুধুমাত্র কেন্দ্র করে নয় । জীবন নাট্যে এমন কিছু দিক আছে যার
গভীরে যাওয়ার আগে গোড়াটা দেখে নেওয়া দরকার । তবে সব কিছু না হলেও যতটা পারা যায়
দেখলেও এমন অনেক কিছু আছে যার অর্থ তাৎক্ষণিক ভাবে হয়তো দেওয়া সম্ভব নয় ।
মোহিনী দেবীর
মানসিক বিকার আগের থেকে অনেকটাই কমে গেছে । বহু বছর আর সেই রোগের সম্মুখীন হতে হয়
নি । আসলে মানুষের জীবনে সঙ্গী বড় দরকার । যা তার ছিলই না । নির্বান্ধব পূরীতে সেই
বাংলাদেশের এক উদ্বাস্তু জীবনের সংগ্রাম !
৪
-
“
স্যার কী বুঝছেন , হসপিটালে কী ভর্তি করবো ?” ডাঃ নন্দীকে বিকাশ প্রশ্নটা করেন ।
-
“
কোন লাভ নেই ,ওনার যা বয়স, খুব একটা ...বুঝতেই পারছেন ।” ডাক্তারের উত্তরে শুধু বিকাশ নয় ঘড়ের
সকলেই বুঝে যান এখন কী করণীয় ।
আজ বহু বছর পর মোহিনী দেবীর ভাই কলকাতা থেকে
এসেছেন । একমাত্র ইনিই দীর্ঘ প্রবাস জীবনে ছেঁড়া সুতোটাকে কোন রকমে ধরে রেখেছেন ।
তাই দিদির আকস্মিক না হলেও হঠাৎ কোমাতে চলে যাওয়ার খবর পেয়ে না এসে পারেন নি ।
-
“
মামা তোমারও কী তাই মত !” বিকাশ কিছুটা গম্ভীর মুখে প্রশ্নটা করে ।
-
“
দেখো, যা ভাল বোঝ !” একটু চুপ থেকে আবার বলেন , “ তবে বিছানায় না রাখাই ভাল, নীচে
যদি কোন ভাবে পরে যায় ...”
মামার কথা্টাকেই
যুক্তিসঙ্গত মনে হল । খাটের থেকে মেঝে পরিস্কার করে মোহিনী দেবীর নতুন স্থান হল ।
বিষয়টাকে সোম মেনে নিতে পারে নি । বার বার করে মনে হচ্ছিল ,যে মানুষটা প্রায় তার
জীবনের অর্ধেকেরও বেশী সময় নানা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কাটিয়ে গোটা পরিবারকে দাঁড়
করিয়ে গেল আর তার শেষ অবস্থায় এই হাল ! নীচে ! কেন হাসপাতাল নিয়ে যেতে কী ক্ষতি
ছিল ! হতে পারে ডাক্তারদের আর কিছু করার নেই , তবুও ।
বিকাশের সঙ্গে
প্রায় কথা বন্ধ রাখে সোম । একটা চাপা ক্ষোভ । হয়ত সোমের সেই বয়স বা বুদ্ধিটা আসে
নি । হাসপাতালে রাখলে এই সব রুগীর যত্ন
নতুন করে করা যায় না । বরং ঘড়ের বেশী চোখে চোখে রাখা যায় ।
ঘড়ের মধ্যে ধীরে
ধীরে বাতাস চাপা একটা বাজে গন্ধে বদ্ধ হয়ে আসে । সোম বাবাকে বলেই ফেলে , “ যা করার
আমি করব , আমি পরিস্কার করে দেব ঠাকুমাকে ।”
বিকাশবাবু
বাস্তববাদী মানুষ । ছেলেকে সাবধান করে দিলেন , “ নাকে কাপড় বেঁধে পরিস্কার কর আর
হয়ে গেলে ভাল করে হাত ধোবে ।”
কথাগুলোর মধ্যে
কোন ভুল নেই । কারণ, মোহিনী দেবী এখন শুধু মাত্রই জীবিত মৃত । তিনি জানেনও না
মৃত্যু তাকে কবে নিয়ে যাবে ! অথচ তার উপস্থিতি এখন সকলের কাছে বিষাক্ত বাতাসের মত
।
নিজের মায়ের
রক্তের ভাই , ছেলে , নাতী পরিজন সবাই খুবই কাছের । কিন্তু কতটা এবং কতক্ষনের এর
সঠিক পরিমাপ যেমন কঠিন তেমনি এর অঙ্কও মেলানো বেজায় জটিল ।
-
“
সোম হাতের গ্লাভস ভালো করে পরে নিবি আর অয়েন্টমেন্টটা ভালো করে লাগিয়ে দে চারপাশে
” সোমের মা বলে উঠলেন ।
সত্যিই
পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে যাচ্ছে । বেড সোর শুরু হয়ে গেছে । গায়ের চামরা বিছানার
সাথে লেগে থাকে । সরাতে গেলেই
ছাল থেকে যায় বিছানায় । আর সঙ্গে সঙ্গে লাল দগদগে ঘা । তাতেও কোন বিকার নেই মোহিনী
দেবীর ।
ভালোবাসার মানুষগুলো নিয়ম করে পাশের ঘরে বসে
খবর দিয়ে চলে যায় । সোম বোঝে এর নিষ্কৃতি নেই । তার ঠাকুমা এখন সকলের কাছে শুধু
মাত্রই বোঝা হতে শুরু করে দিয়েছেন । কেমন করে যেন এসব হয়ে গেল ! হঠাৎ করেই এক দিন
সকালে এই অবস্থা হয় । কেউ ভাবতেই পারে নি তার শেষ পরিনতি এমন ভাবে হবে ।
৫
সব কাজ শেষ করে
গাড়ীতে ফেরার পথে সোমের চোখ সুদূরে চলে যায় । বিকাশবাবু মায়ের সৎকার নিষ্ঠা ভাবেই
সম্পন্ন করেছেন । সত্য বলতে কী কোন ত্রুটিই তিনি রাখেননি মায়ের । শুধু সোমের জীবনে
একটা বড় প্রশ্ন থেকে গেল, সে যে কাজটা করেছে তা ঠিক, না, ভুল !
সেদিন ভোরের
দিকে বিকাশবাবুকে সোম বলে , “ অনেকক্ষণ জেগেছ একটু শুয়ে নাও, আমি থাকি কিছুক্ষণ ”
কোন উত্তর না দিয়ে বিকাশবাবু ধীর পায়ে অন্য ঘরে চলে যান । সোমের মা সারাদিন
অন্যান্য কাজের পর কিছুক্ষণ আগেই শুতে গেছেন । এই ভাবেই চলছিল মোহিনী দেবীর শেষ
পাঁচটা দিন ।
বাবা চলে যেতেই
আলতো ভাবে দরজায় ছিটকেনি লাগিয়ে দেয় । ফিরে আসে প্রায় কঙ্কালসার ঠাকুমার কাছে ।
দুর্গন্ধটা এখন নাকের অনেকটাই অভ্যাস হয়ে গেছে ।
-
“
আমি তোমাকে সত্যি ভালোবাসি গো , আমি তোমাকে দেব মুক্তি ” হাত দুটো এগিয়ে যায় সোমের
।
খানিক পর অনুভব
করে গলার মধ্যে যে ঘর ঘর শব্দটা মোহিনী দেবীর অস্তিত্বকে জানান দিচ্ছিল তা থেমে
গেছে চিরতরের জন্য । সোম বাইরে বেরিয়ে আসে । রান্নাঘরে গিয়ে এক কাপ কফি বানাতে
বানাতে দেখে শীতের ভোর রাতে একটি মাত্র অতসীফুল পাপড়ি মেলে আছে , মোহিনী দেবীর
হাতে পোঁতা শেষ গাছ ।
বিকাশ বাবু জেগে
উঠে আসতেই সোম আস্তে করে বলে, “ ঠাকুমা আর নেই ।” মানসিক দিক দিয়ে তৈরিই ছিলেন সকলেই । সকাল হতে ডাক্তার তার পুরনো রুগীটিকে নিয়ম মাফিক দূর থেকেই থেকে ডেথ
সার্টিফিকেট দিয়ে দেন । শুধু এই সময়টাই সোমের কেমন যেন একটা ভয় করে উঠেছিলো ।
কিন্তু তার ঠাকুমা শেষ হয়েও রেখে
গেলেন বেশ কিছু কথা ।
মোহিনী দেবীর নিথর দেহ যেন এক আর গভীর ঘুমে নতুন দেশে পাড়ি দিয়েছে ।
ইতিহাস জানে আজ
মোহিনী দেবী ‘ মারা ’ গেছেন । সোমের কাছে আজও প্রশ্ন এটা কী সে ঠিক করেছে ! এটা কী
হত্যা, না, মুক্তি ! আজও সে খুঁজে বেড়ায় এর জবাব , হয়ত পাবে উত্তর । হয়ত কেন !
নবপ্রজন্ম , আগামী সময় দেবে এর উত্তর এই কালের যাত্রায় ।।
No comments:
Post a Comment