পূর্বের অভিক্ত বাংলাদেশে তথা বিভক্ত বাংলার
অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু বর্তমানের কলকাতা শহর । এর প্রতিটি অলিতে-গলিতে লুকিয়ে আছে
নানা কথা –উপকথা । রাতের আঁধারে বর্তমানে বেঁচে থাকা কয়েকটি প্রাচীন অট্টালিকা
যৌবন হারিয়ে যেন শোনাতে চায় তার শত বছর আগেকার ইতিকথা । অথবা এশিয়াটিক সোসাইটি বা
কলকাতা ন্যাশনাল লাইব্রেরীর দুষ্প্রাপ্য লালচে পেপার-পুঁথি জড়ার চাদর ঠেলে ধীর লয়ে
আজও প্রাণদীপ্ত ভাবে গল্প করে সেই সুতানটি , কলকাতা , গোবিন্দপুরের প্রাচীন কাহিনী
। বর্তমান প্রবন্ধে তার বিশালতার থেকে সামান্য এক গণ্ডূষ লেখনী দেওয়ার প্রচেষ্টা
করছি মাত্র ।
নানা মজাদার কাহিনীর সাথে সাথে যে বিস্তৃত ইতিহাস
রয়েছে তা এক দিকে যেমন রোমাঞ্চকর অন্যদিকে ঐতিহাসিক মূল্যও অপরিসীম ।
‘ কালপেঁচার নকশা ’, ‘ কলকাতা কালচার ’, ‘ টাউন
কলিকাতার কড়চা ’ ইত্যাদি পুস্তকে নাগরিক জীবনের চিত্রায়ন ভালভাবে থাকলেও বা
পড়াশুনা করলেও মনে হয় মহাসমুদ্রে তা বিন্দুসম ।
‘ ডিহি কলিকাতার ’ পরিধি ছিল তখন খুবই সামান্য
বর্তমানের তুলনায় । উত্তরে বর্তমান মহাত্মা গান্ধী রোড , দক্ষিণে ধর্মতলা স্ট্রীট
থেকে গঙ্গার তীর পর্যন্ত এই ছিল তার সীমারেখা । ১৬৯০ সালে জোব চার্নক সুতানুটিতে
তৃতীয়বার হল্ট করে বানিজ্য
কুঠি স্থাপন করেছিলেন বলেই আধুনিক কলকাতার
বানিজ্য-সাহিত্য স্বরূপটি দেখতে পাই ।
যদিও চার্নক সাহেব প্রথম ব্যবসায়ী নন যে তিনিই প্রথম
কলকাতায় বানিজ্য পত্তন করেছিলেন । সপ্তদশ শতাব্দীর সূচনায় সম্ভবত গঙ্গা বা
ভাগীরথীর পশ্চিম তীরের হুগলির সপ্তগ্রাম অঞ্চল থেকে বাঙালী শেঠ–বসাক–তন্তুবনিক
প্রভৃতিরা বানিজ্যের পত্তন করেছিলেন । আমরা অনেকেই হয়ত জানি না যে , সেন্ট জন
গীর্জার সীমানায় চার্নকের সু-প্রাচীন সমাধিস্থল রয়েছে , সেটি কিন্তু সবচেয়ে
প্রাচীন নয় । বরং অনুসন্ধান করে দেখা গেছে কলকাতার আর্মেনিয়াম নাজারেথ গীর্জার
প্রাঙ্গনে , রেজাবীবে নামে জনৈকা আর্মেনিয়াম মহিলার সমাধিস্থল বিদ্যমান ; যার
ফলকের সন গণনা করলে ইংরাজি সন মতে হবে ১৬৩০ । রেজাবীবে ছিলেন দানবীর সুকিয়ার
স্ত্রী । আর্মেনিয়ান সুকিয়াদের নামেই কলকাতার বর্তমানের সুকিয়া স্ট্রিট ।
আলোচ্য প্রবন্ধটির মূল অংশে যাওয়ার আগে কলকাতার
ইতিহাসের আংশিক উল্লেখকে চারটি পর্যায়ে চিঠি ও স্মৃতি কথায় বিভক্ত করা যায় ।
সেগুলি হল –
১) উইলিয়াম হিকির স্মৃতিকথা ( ১৭৭৭ – ১৮০৮
সন )
২) এলিজা ফে-র পত্রাবলী ( ১৭৮০ – ৮২ সন ) ; প্রথম
চিঠি এলিজা প্রেরণ করেন তাঁর এক জনৈক ইংরেজ বন্ধুকে ২২ মে , ১৭৮০ সালে কলকাতা থেকে
এবং অন্তিম তথা অষ্টম পত্রটি প্রেরণ করেন ২৭ মার্চ ১৭৮২ সনে কলকাতা পোষ্ট অফিস
থেকে ।
৩) ফ্যানি পার্কস্ - এর ভ্রমণ বৃত্তান্ত
( ১৮২২ – ২৮ সন )
৪) ভিক্টর জ্যাকমোঁ-এর চিঠি ( ১৮২৯ – ৩০
সন ) , জ্যাকমোঁ ১৮২৯ সালে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে কলকাতায়
আসেন এবং ১৮৩০ সালের ২৬ আগস্ট চীন-ভারত সীমান্ত থেকে যে চিঠি তাঁর পিতৃদেবকে
প্রেরণ করেছিলেন সেখানে কলকাতা শহরের বর্ননা দিয়েছিলেন । যদিও তাঁর সম্ভবত প্রথম
চিঠি ১৮২৯ , ১ সেপ্টেম্বর Victor De Tracy – নামক এক বন্ধুকে ।
উল্লেখিত চারটি পর্যায়ের
উল্লেখ করা হল কারণ , এর উপর মূলত ভিত্তি করেই আমরা পরবর্তী মূল পর্বের উপর
আলোকপাত করতে পারব । প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য ‘ কলকাতা কালচার ’ তিনটি পর্যায়ের মধ্য
দিয়ে এসেছে –
আর্য + প্রাক্-আর্য = হিন্দু
মুসলমান + প্রাক্ মুসলমান = মুসলমান বা হিন্দু
ইংরেজ + প্রাক্ ইংরেজ বা হিন্দু-মুসলমান = অ্যাংলো বা ফিরিঙ্গী । ( গবেষক – রাজনারায়ণ বসু )
এই তিনটি ভাগের মিশ্রণেই গড়ে
উঠেছে ‘ কলকাতা কালচার ’ । ‘ কালচার ’-এর মধ্যে সংবাদপত্র , সাময়িক পত্র , গেজেট ,
চিঠি , বিজ্ঞাপন ইত্যাদি পরে । আমার এই প্রবন্ধে প্রচেষ্টা করলাম “ তিন কালচার ”
মিশ্রিত অনন্য সম্ভারের মধ্যে সম্পাদকীয় উপাখ্যান ও বিজ্ঞাপনের দৃষ্টান্তের উপর
সামান্য আলোকপাত করবার ।
·
সংবাদপত্র-সাময়িকপত্র-গেজেটে
সম্পাদক ও তাদের তৎকালীন ভূমিকা -
বর্তমানে নানা পত্র-পত্রিকা ,
সংবাদপত্র প্রভৃতিতে “ সম্পাদকীয় ” অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । তবে এখানে সাম্প্রতিক
কালের “ এডিটোরিয়াল ” বা “ লীডার ” প্রসঙ্গ নয় বরং সংবাদপত্রের জন্মকালীন
সম্পাদকীয় আলোচ্য । ইংরেজরাই সাংবাদিকতার জগতে আমাদের দীক্ষা দিয়েছে একথা
স্বীকার্য । তবে এটা ঠিক ইংরেজ সাংবাদিকদের সংযম ও শালীনতাবোধ ছিল না সে সময়ে ।
সংবাদপত্রের রূপ ছিল দর্পনের মতই স্বচ্ছ । তাই লোকানোর কোন কিছুই থাকতো না । ‘
সংবাদ দর্পন ’ হয়ে উঠেছিল ‘ সমাচার দর্পন ’ ।
হিকি সাহেব ১৭৮০ সালে প্রথম
সংবাদপত্র প্রকাশ করেন ‘ বেঙ্গল গেজেট ’ নামে এবং তাঁর সম্পাদকীয় ধারের ফল স্বরূপ
স্বজাতির দ্বারাই তা অচিরেই কবরে নিক্ষেপ হয় ।
কদর্য ভাষায় তিনি আক্রমণ
চালিয়েছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংসের স্ত্রীর উপর তাঁর লেখনীতে সম্পাদকীয় কলামে । ফলে
সরকারী আদেশে তা বন্ধ হতে বেশী সময় নেয় নি । লেডি হেস্টিংস তখনকার কলকাতার ফ্যাশান
ও ‘ এটিকেট্ কর্ত্রী ’ ছিলেন । তিনি কলকাতায় বসেই চিঠিপত্রের মাধ্যমে
লন্ডন-প্যারিসের ফ্যাশনের খবর রাখতেন । একবার তিনি বয়সত্তোর্ণী হওয়ার পরেও এমন
পোশাক পরেছিলেন যা দেখে অন্যান্য ইংরেজ রমনীকুল হতভম্ভ হয়ে যায় । মিসেস ফে ভীষণ
চটে গিয়ে বললেন , ওটা ‘ infantile simplicity ’ না , উল্টে ওটি ‘ her hole dress being at variance without present mode ’ । এমন নানা মজাদার
ঘটনাকে নিয়ে হিকি সম্পাদক সাহেব মা-বোনের স্ত্রী জাতির কথা ভুলে লিখেছিলেন তাঁর সম্পাদকীয়তে ।
আসলে তখন বর্তমান কালের মত
রাজনীতি ছিল না , পার্লামেনেটের অধিবেশনও
বসত না । সামান্য নগরজীবনে যা ঘটত সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়রা তাই লিখতেন ।
সংবাদপত্র তথা সম্পাদকীয় অসংযমের মাত্রাকে ১৭৯৯
সালে ওয়েলেসলি প্রথম প্রেস আইন জারী করে সংবাদপত্রের স্বাধীন মতামতে হস্তক্ষেপ
করেন । কোন কিছু সেক্রেটারিকে না জানিয়ে ছাপা চলবে না , অন্যথায় সম্পাদকের ইউরোপে
নির্বাসন অবধারিত ।
১৭৮৪ সালে ‘ ক্যালকাটা গেজেট
’ প্রকাশিত হয় । সেই সময় ‘ সম্পাদকীয় কলাম ’-এ যা প্রকাশিত হত তা বোধহয় বর্তমানের
সম্পাদক মহোদয়গণ লিখতেও সাহস করবেন না , লজ্জা বোধ করবেন । শুনলে অবাক করার মত তখন
সম্পাদকীয়তে কবিতা ও চুটকি ছাপা হত ।
নানা ভাষার কবিতার সম্ভারের
সাথে ইংরেজি , সংস্কৃত , ফরাসী কবিতাও স্থান পেত । যদিও এই সবের অরেজানালিটি নিয়ে যথেষ্ট সংশয় থাকতো । তবুও তৎকালীন সম্পাদকরা ওসবের ধার ধারতেন না । তাদের কাছে
বিষয়বস্তু বলতে ‘ ফিলিংস্ ’ই ছিল প্রধান । কেউ যদি নকলটাই ‘ অকৃত্রিম ফিলিংস্ ’
নিয়ে লিখতেন তবে তাই পেত স্থান । তা সামান্য লেখা হোক , অখ্যাত লেখা হোক অথবা চুরি
করা হোক । যেমন কেউ শুধুমাত্র লিখেছিলেন –
“ To the Editor of the
Gazette,
Sir,
By inserting the accompanying in your paper you will oblige.
A Well-wisher.”
সম্পাদক কিন্তু এই সামান্য
হৃদয়াবেগকে বাতিলের ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করতেন না । হৃদয় দিয়ে হৃদয়ের কথা ছাপানোর
জন্য উদ্যমী হয়ে প্রকাশ করতেন । আজকাল এমন উদার সম্পাদক আস্তবিকই দুর্লভ সম্পদ !
প্রেমের কবিতাও স্থান পেত ।
শেষে আরেকটি উধাহরণ দিয়ে এই
অধ্যায়টি শেষ করি ।
জনৈক এক রমনী স্বামী নির্বাচন
করে বিবাহ করতে ব্যর্থ হয়ে প্রায় বার্ধ্যকে উপনিত হয়ে যান । এই নিয়ে ঠাট্টা করে এক
ইংরেজ কবি একটি সুন্দর কবিতা লিখেছিলেন –
“ Pale
faded stuffs, by time grown faint
Will brighten up through art;
A Britain gives their faces paint
For sale at Indian mart.”
কলকাতার ইংরেজ সমাজে তৎকালীন
প্রেমের বাজার ও বিবাহের বাজারের অবস্থা মনে রাখলে ওই পত্রিকার ‘ পোয়েটস্ কর্নার
’ ও সম্পাদকীয় কলামে কবিতা ছাপানোতে সামাজিক অবস্থা ভাল করে বোঝা যায় ।
·
সমসাময়িক কালে কলকাতার বিজ্ঞাপনের জগত –
সমাজের নানা চিত্র নানা ভাবে প্রকাশিত হয় । ‘ বিজ্ঞাপন ’ হল তেমন এক
সামাজিক আয়না যার মাধ্যমে সেই সময়কার সমাজ জীবন বিশ্লেষণ করা যায় যদি সেগুলি ভাল
করে পড়া হয় । ‘ কর্মখালী ’, ‘ কর্মপ্রার্থী ’ , ‘ পাত্র-পাত্রী ’ প্রভৃতি বিজ্ঞাপন
বর্তমান কালের মত সেই সময়ের কলকাতার সংবাদ ও সাময়িক পত্রে ঠাই পেত ।
সংবাদের
আত্মগোপন করা কথা ‘ বিজ্ঞাপণ ’-এর দুয়ারে প্রকাশ্যে আসে পূর্ণ রূপে । সেকাল বলতে
এখানে অস্টাদশ শতাব্দীর শেষে ও উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার বাংলার কথা বলা হচ্ছে ।
কয়েকটি বিজ্ঞাপনের উদাহরণ দেওয়া হল [ এগুলি প্রধানত ‘
ক্যালকাটা গেজেট ’ পত্রিকা থেকে নেওয়া ] ।
১৮৭৪ সাল , কলকাতা – “ একজন মহিলার
জন্য পরিচারিকা চাই । পরিচারিকার ইংরেজিতে কথাবার্তা বলতে জানা চাই এবং কোনো
ইউরোপিয়ানের কন্যা , অথচ এদেশী স্ত্রীলোক হলেই ভাল হয় । টিরেটা বাজারের কাছে মি. দা সুজার কাছে খোঁজ করুণ ।”
১৮০১ সাল
শ্রীরামপুর , জনৈক শেরিফ আব্রাহাম – “ সর্ব সাধারণের
অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে আমার স্ত্রী , শ্রীমতি হরর্পসীমি শেরিন , চুঁচড়োর
আর্মেনিয়ান মুল্লুকসেটের কন্যা , গত ৪ ডিসেম্বর ১৮০০ সন , আমার বাড়ি থেকে অকারনে ,
কিছু না বলে-কয়ে চম্পট দিয়েছে । সুতরাং শ্রীমতি যদি কারও কাছ থেকে টাকা-পয়সা ধার
নেয় তার জন্য আমি দায়ী হব না ।”
১৭৮৭ সাল মেসার্স
ডেভিডসন অ্যান্ড কোং-এর বিজ্ঞাপন – “ এন্টালিতে কাপড় ধোলাইয়ের ব্যাবসা খুলেছেন । স্বচ্ছন্দে
তাদের কাছে কাপড় কাচানো যেতে পারে । কাপড় কাচার ‘ রেট ’ হচ্ছে –
পুরুষ বা
মহিলা – প্রতি মাসে ৬ টাকা
কিশোর ( ৭ –
১২ বছর ) – প্রতি মাসে ৪ টাকা
বালক ( ১ – ৬
বছর ) – প্রতি মাসে ২ টাকা
ভৃত্য –
প্রতিমাসে ১ টাকা ।
৩০ অক্টোবর ১৭৮৮
সাল , হেয়ার ড্রেসার লা’ফ্লোর সম্প্রতি প্যারিস থেকে কলকাতায় এসে বিজ্ঞাপন –
মহিলাদের
কেশবিন্যাস – ৪ টাকা
পুরুষদের
কেশবিন্যাস – ৪ টাকা
চুল ছাঁটাই
কেশবিন্যাস – ৬ টাকা
“ যারা মাসিক হিসেবে তার সঙ্গে বন্দোবস্ত করতে চান তারা
আলাদা দেখা করুন – কর্নেল পিটার মারীর বাড়ির পাশের লেনে ৭৩ নম্বর ।”
সম্পূর্ণ
প্রবন্ধটির শেষের পর্যায়ে ঐতিহাসিক – সমাজ বিজ্ঞানী সীটন-কার সাহেবের বক্তব্যটি
উল্লেখযোগ্য, সাহেব বলেছেন বিজ্ঞাপন হল – “ the most
interesting of the whole . It throws light on the minutest details of the inner
and domestic life of the English Community of Calcutta and the Bengal
Presidency.”
No comments:
Post a Comment