Friday 30 December 2016

সভ্যতার ইতিহাসের সিন্ধু নদ হয়ে বুরজাহোম –এক যাত্রা

Image result for ancient kashmir imageকালের প্রবাহে সৃষ্টি হয় ইতিহাস । ইতিহাসের পাতা থেকে ঘটমান বর্তমান যেন এক প্রবাহমান ধারা , যা চলে আসছে  সৃষ্টি থেকেই । রেখে গেছে ও যাচ্ছে নানা সাক্ষী প্রতিটি ছত্রে । স্রোতস্বিনীর ধারায় চেষ্টা করা হল তার কিঞ্চিৎ অবগাহন করতে । আলোচনায় যেমন তুলে ধরা হবে সিন্ধু সভ্যতা , তেমনি আলোচিত করা হবে প্রাগেইতিহাসিক “ ভূস্বর্গ কাশ্মীর ।”














ভারতবর্ষে প্রথম মানুষের আবির্ভাব হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩ থেকে ২ লক্ষ বছরের মধ্যে দক্ষিণ ভারত এবং সোয়ান উপত্যকা অঞ্চলে ভারতবর্ষের প্রথম আবির্ভাবের প্রমাণ মেলে আদিম মানুষের অস্তিত্ব ছিল প্রায় ৮০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ পর্যন্ত ভারতবর্ষে মধ্যপ্রস্তর যুগের সূচনাকাল প্রায় ৮০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ এবং স্থায়ী ছিল ৪০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ ভারতবর্ষে নব্যপ্রস্তর যুগের সূচনাকাল প্রায় ৪০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ থেকে নব্যপ্রস্তর যুগে মানুষ প্রথমে কুকুরকে পোষ মানায় নব্য প্রস্তর যুগে প্রথম গৃহপালিত পশু ছিল ভেড়া তাম্রপ্রস্তর যুগের সূচনা কাল ছিল আনুমানিক ১৮০০ খ্রিস্টপূঃ থেকে ১০০০ খ্রিস্টপূঃ তাম্রপ্রস্তর যুগের নিদর্শন মেলে কাশ্মীর উপত্যকার গুফরাল নামক স্থানে লৌহযুগের সূচনাকাল হল আনুমানিক ১০০০ খ্রিস্টপূঃ থেকে ৫০০ খ্রিস্টপূঃ উচ্চগাঙ্গেয় সমভূমি , বারাণসী , কোশাম্বী শ্রাবস্তী এবং  উজ্জয়িনীতে লৌহযুগের অস্তিত্বে্র সন্ধান পাওয়া যায় আলোচনার সুবিধার্থে সমগ্র প্রবন্ধটির সূচনা করা হল সুপ্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা থেকে ।
কালের অতলে সিন্ধু ও সিন্ধু নদের উৎস সন্ধানে
ভারতের ধারাবাহিক ইতিহাসে সিন্ধু সভ্যতার যুগকে নানা নামে চিহ্নিত করা হয় । যেমন , আদিম , প্রাগৈতিহাসিক , প্রাগ-বৈদিক ইত্যাদি । মূলত প্রাগৈতিহাসিক যুগের তৃতীয় স্তরে এই যুগের যাত্রারম্ভ । তাম্র যুগেই সিন্ধু সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশ পর্ব ।ধারাবাহিক অস্তিত্বের দিক থেকে ভারতীয় সভ্যতা বিশ্বের সবচেয়ে বেশী বয়সী সভ্যতা যদি আমরা লিখন পদ্ধতি , ধাতুর কাজ , ও অকৃষি ভিত্তিক নাগরিক বসতি স্থাপনকে সভ্যতার ন্যূনতম সংজ্ঞা হিসেবে বিবেচনা করি, তবে সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা হল মেসোপটেমিয়ার সভ্যতা  (খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ সহস্রাব্দ) , এবং প্রায় কাছাকাছি সময়ের মিশরীয় সভ্যতা
খ্রিস্টপূর্ব ৩য় সহস্রাব্দের মধ্যেই সিন্ধুনদের উপত্যকায় এরকম আদি সভ্যতার উন্মেষ ঘটে চীনে তা ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ২য় সহস্রাব্দের সময় কিন্তু মিশরীয় ও মেসোপটেমীয় সভ্যতাগুলি রোমান সাম্রাজ্যের সময়ে বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে এই এলাকাগুলি ইসলামের অধীনে আসে ফলে এলাকাগুলির বর্তমান সভ্যতার সাথে প্রাচীন সুমেরীয় বা মিশরীয় সভ্যতার কোন মিল নেই   অন্যদিকে ভারতীয় সভ্যতা প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত মোটামুটি অবিকৃত রয়ে গেছে

ভারতীয় উপমহাদেশ পশ্চিমে আফগানিস্তান থেকে পূর্বে বঙ্গোপসাগর এবং উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে ভারতীয় উপদ্বীপের প্রান্তসীমা পর্যন্ত বিস্তৃত রাশিয়াকে বাদ দিয়ে গোটা ইউরোপের আয়তনের সমান এই এলাকার আয়তন আর ভৌগোলিক ,   ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত দিক থেকে এটি ইউরোপের চেয়ে অনেক বেশি বৈচিত্র্যময় বিশ্বের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ লোকের বাস এখানে এই বিশাল এলাকাটি ইতিহাসের খুব কম সময়ের জন্যই একটিমাত্র শাসকের অধীনে ছিল এবং তাও পুরোপুরি নয়
 বর্তমানে এলাকাটি  পাকিস্তান নেপাল , ভারত , ভূটান , বাংলাদেশ , শ্রীলঙ্কা ও  মায়ানমার  রাষ্ট্রগুলিতে বিভক্ত কিন্তু প্রতিটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরেই আঞ্চলিক প্রভেদের পরিমাণ বিপুল তাই ভারতীয় উপমহাদেশের একটি সাধারণ সামগ্রিক ইতিহাস বর্ণনা করা দুরূহ

সিন্ধু সভ্যতার মানুষেরা অনেক বিশাল ,  সুপরিকল্পিত নগরী নির্মাণ করেছিল ,  এবং এগুলির আংশিক পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়েছে , কিন্তু এদের সভ্যতার লিখিত নিদর্শনগুলিতে ,  যেমন -  কাদামাটির চাঙড় কিংবা শীলমোহর  ইত্যাদিতে যে লেখা আছে ,  যেগুলির পাঠোদ্ধার করা এখনও পুরোপুরি সম্ভব হয়নি তারমধ্যে শীলমোহর সম্পর্কে Prehistoric India by Stuart Piggott ( 1950 ) , পৃষ্ঠা নং ২৭০-২৭১-এ যা লিপিবদ্ধ করেছেন তা হল নিম্নরূপ –
“One Seal has presented a dancing scene. One man is beating a drum and others are dancing to the tune. On one seal from Harappa a man is playing on a drum before tiger. On another, a woman is dancing. In one case, a male figure has a drum hung round his neck.”
Image result for copper dancing girl[ চিত্র – ১]
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য মহেঞ্জোদারোতে নৃত্য ভঙ্গিমায় যে মূর্তিটি পাওয়া গেছে তা ব্রোঞ্জ নির্মিত এবং সেটি একটি ৪.২৫ ইঞ্চির নারী মূর্তি [ চিত্র -১ ] ; ডঃ জিমারের মতে মূর্তিটিতে তামার অংশও আছে । আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে তাম্র যুগেই সিন্ধু সভ্যতার উন্মেষ । মূর্তিটিকে বলা হয় – “ Copper dancing girl অন্যদিকে , হরপ্পার বৃহৎ শস্য ভাণ্ডারের ভগ্নাবশেষ থেকে আরেকটি নৃত্যরত মূর্তিও পাওয়া গেছে । মূর্তিটি ধূসর রঙের পাথর দিয়ে তৈরী , উচ্চতা ৩.১ ইঞ্চি [ চিত্র -২ ] । ডঃ জিমার মূর্তিটিকে উল্লেখ করেছেন – “ Gray stone Torso of dancer ” বলে ।
Image result for Gray stone Torso of dancer[চিত্র-২]
  সিন্ধু সভ্যতার বাসিন্দাদের ব্যাপারে আজ পর্যন্ত অসংখ্য মতামত এসেছে , সভ্যতাটি আবিষ্কারের পর তাৎক্ষনিক ভাবে কিছু পশ্চিমা পণ্ডিত ( হুইজেল প্রমুখ ) দাবী করেন সভ্যতাটি বর্তমান দক্ষিন ভারতীয় দ্রাবিড়দের যাদের বহিরাগত আর্যরা পরাজিত করে সভ্যতাটি ধ্বংস করে দেয় এই তত্ত্ব দীর্ঘদিন প্রাধান্য পায় কিন্তু গত বিশ বছর যাবত পরিচালিত তাবৎ পর্যবেক্ষনে তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হয়েছে বর্তমান বিশেষজ্ঞদের ধারণা , এই প্রাচীন সভ্যতাটি আর্য , দ্রাবিড় ( অস্ট্রালয়েড ) , মঙ্গোল এমনকি সুমেরীয়দেরও মিলিত সৃস্টি তাছাড়া কোন বাইরের আক্রমণের প্রমাণও পাওয়া যায়নি ( প্রাপ্ত ত্রিশটির মত মৃতদেহের কঙ্কাল সিন্ধু সভ্যতার বিলুপ্ত হবারও বহুপরের সময়কার যাকে শুরুতে গণহত্যার প্রমান বলা হয়েছিল )            আবহাওয়া পরিবর্তন , সরস্বতী নদীর শুকিয়ে যাওয়া , ভুমিকম্প প্রভৃতি মিশ্র কারণে সভ্যতা পরিত্যক্ত হয় উদ্ধারকৃত দ্রব্যের মধ্যে স্বস্তিকা মাতৃমূর্তি যথাক্রমে আর্য দ্রাবিড়দের উপস্থিতির প্রমাণ
  যাইহোক , সভ্যতা ধ্বংস হলেও এর ধারাবাহিকতায় বর্তমান ভারতীয় সভ্যতার ভিত স্থাপিত হয় গ্রীক মহাবীর আলেকজান্ডার যখন ৩২৬ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে ভারত আক্রমণ করেন, তার আগেই ভারতে বিভিন্ন আঞ্চলিক রাজ্যের উৎপত্তি ঘটে আলেকজান্ডার চলে গেলে মৌর্য রাজবংশের অধীনে এই উত্তর ভারতীয় রাজ্যগুলি একত্রিত হয়ে মৌর্য সাম্রাজ্য গঠন করে  ( ৩২২-১৮০ খ্রিপূ ) এরপর কুশানরা উত্তর থেকে আক্রমণ করে এবং ১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কুশান সাম্রাজ্য গঠন করে খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে স্থানীয় গুপ্তরাজ বংশ ক্ষমতায় আসে এবং মৌর্যদের হারানো সাম্রাজ্যের প্রায় পুরোটাই পুনরুদ্ধার করে   
 গুপ্তরা ৩য় শতক থেকে ৫ম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত উত্তরভারত শাসন করে এইসময় দক্ষিণভারতে বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী রাজ্যের মধ্যে বিভক্ত ছিল গুপ্তদের পর হর্ষবর্ধন সামান্য সময়ের জন্য উত্তরভারত শাসন করেন ( ৬ষ্ট শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ) এরপর আবার গোটা ভারত বিভিন্ন ক্ষুদ্র রাজ্যের এক জটিল সহাবস্থানমূলক ব্যবস্থায় ফেরত যায় তবে এই সমস্ত রাজনৈতিক উত্থান-পতনের মাঝেও ভারতীয় সভ্যতার মূল উপাদানগুলি অবিচ্ছিন্ন ভাবে খ্রিস্টপূর্ব ৩য় সহস্রাব্দ থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত সঞ্চারিত হয়ে এসেছে
সিন্ধু সভ্যতার যে সমস্ত নগরীর সন্ধান পাওয়া গেছে
প্রাচীন এই সভ্যতায় বেশ কয়েকটি নগরীর সন্ধান পাওয়া গেছে , যার সূত্র ধরেই আমরা তুলে আনব “ বুরজাহোম ”-কে ( বর্তমান কাশ্মীরের আঁতুড়ঘর )[ চিত্র -৩ ] । প্রাচীন সেই নগরগুলির তালিকায় আছে রাজস্থানের কালিবাঙ্গান , পাকিস্থানের হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো
Image result for image of burzahom[চিত্র -৩]
এই তিনটি নগরী এবং আরো প্রায় দু’শো ছোট-বড় শহরের এক বিশাল নগর সভ্যতাযার পূর্বে ঊর্ধ্বগঙ্গা এবং দক্ষিণে বর্তমান মুম্বাই শহর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল সিন্ধু সভ্যতা আকারে ছিল সমসাময়িক প্রাচীন সভ্যতাগুলির মধ্যে সর্ববৃহৎ
সিন্ধু নদের আগমন
 সিন্ধু এবং এর উপনদী ও শাখানদী ছিল এই সভ্যতার প্রাণ সিন্ধু নদ হিমালয় পর্বতমালায় উৎপত্তি লাভ করে পাঞ্জাবের নিম্নভূমি ও উত্তর রাজস্থানের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সিন্ধু মরুভূমির মধ্য দিয়ে আধুনিক করাচি শহরের কাছে গিয়ে আরবসাগরে পড়েছে
গোটা সিন্ধু অববাহিকাই শুষ্ক অঞ্চল , বিশেষত এর দক্ষিণ  অর্থাৎ, মরুভূমিই বলা চলে তাই , কৃষি কাজ ছিল জলের সেচের উপর নির্ভরশীল বার্ষিক বন্যার কারণে জলের অভাব মিলত ও উর্বর পলির সঞ্চয় হত কিন্তু বছরের বেশির ভাগ সময় গরম ও শুষ্ক ছিল বলে মিশর ও সুমেরের মত এখানেও সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটে নদনদী গুলি সস্তায় ও সহজে বিভিন্ন কৃষি দ্রব্য পরিবহনের কাজেও লাগানো হত
সিন্ধু নদ প্রণালীতে প্রধান নদীগুলি ( তাদের দৈর্ঘ্য ক্রমানুযায়ী )

সিন্ধু -  ,২০০ কিলোমিটার ( ,০০০ মাইল )
চন্দ্রভাগা – ৯৬০ কিলোমিটার ( ৬০০ মাইল )
বিতস্তা বা ঝিলম – ৮১৩ কিলোমিটার ( ৫০৫ মাইল )
রবি – ৭২০ কিলোমিটার ( ৪৫০ মাইল )
শতদ্রু – ৫২৯ কিলোমিটার ( ৩২৯ মাইল )
বিপাশা বা বিয়াস – ৪৬০ কিলোমিটার ( ২৯০ মাইল )
সিন্ধু থেকে হিন্দু থেকে হিন্দুস্থান
লৌহযুগীয় ভারতের ঐতিহাসিক বৈদিক ধর্মে এই ধর্মের  শিকড় নিবদ্ধ হিন্দুধর্মকে বিশ্বের  " প্রাচীনতম জীবিত ধর্ম বিশ্বাস " মতবাদ আখ্যা দেওয়া হয়
অনেকের মতে হিন্দু শব্দটি আর্যদেরকে  আফগানিস্তানের বাসিন্দা বা আফগানেরা দিয়েছে তারা সিন্দু নদের তীরবর্তী সনাতন ধর্মের সাধু-সন্ন্যাসীদেরকে উচ্চারণগত ভাবে “ হিন্দু ” বলত আর এইভাবেই হিন্দু নামটি এসেছে ভারতবর্ষকে “ হিন্দুস্থান ” এবং ভারতবর্ষে যারা বসবাস করেন তাদের “ হিন্দুস্থানী” বলা হয়ে থাকে পুরবের মতই ।
কিন্তু , সিন্দু থেকে হিন্দু - এই  তথ্যটি ঐতিহাসিক ভাবে সত্যতা কিন্তু নিশ্চিত করে না তার যুক্তি অবশ্য দেখিয়েছেন নানা গবেষক ও পণ্ডিতেরা ।


হিন্দু শব্দটি উৎসারিত হয়েছে সংস্কৃত সিন্ধু শব্দটি থেকে সিন্ধু ভারতীয়  উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের একটি ঐতিহাসিক নদীর নাম ঋগ্বেদে সিন্ধু নদের স্তুতি করা হয়েছে পরবর্তী কালের আরবি সাহিত্যেও আল-হিন্দ শব্দটির মাধ্যমে সিন্ধু নদ অববাহিকায় বসবাসকারী  জনগোষ্ঠীকে বোঝানো হয়েছে প্রকৃতপক্ষে ৭১২ খৃষ্টাব্দে যখন মুহাম্মদ-বিন-কাসিম সিন্ধু প্রদেশ জয় করেন  তখন থেকে তাদের মধ্যে সিন্ধুর স্থলে হিন্দ শব্দটির ব্যাপক প্রচলন ঘটে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ভারতের   নামের সমার্থক শব্দ হিসেবে হিন্দুস্তান বা হিন্দুস্থান শব্দটির  উৎপত্তি হয় এই শব্দের আক্ষরিক অর্থ  " হিন্দুদের দেশ "
সনাতনধর্ম (যামূলতবেদভিত্তিক)-এর অভিমত
ঐতিহাসিক বিচারে অন্ততঃ পাঁচ হাজার খৃষ্টপূর্বাব্দে এই শব্দের উৎপত্তি । তবে হিন্দু শব্দটির সূত্রপাত হলো খৃষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকের পারসিক আক্রমণ থেকে পারস্যরাজ সাইরাজ বা কাইরাজ  ( আনুমানিক খৃষ্ট পূর্ব ৫৫৮-৫৩০ )  ও দরায়ুস বা ডেরিয়াস  ( আনুঃ খৃঃপূর্ব ৫৫২-৪৮৬ ) ভারত আক্রমণের জন্য সিন্ধু নদের তীর পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন তখন সিন্ধু নদ ও তার সাত অববাহিকার জন্য এই অঞ্চলের নাম ছিল সপ্তসিন্ধু পারসিকদের বর্ণমালায়  ‘ ’ না থাকায় এর সঠিক উচ্চারণ করতে পারত নাফলে তারা উচ্চারণ করে বলত হপ্ত-হিন্দু

পরবর্তীকালে সনাতন ধর্মপালনকারী আর্যরা হিন্দুধর্ম বলতে কিছুমাত্র দ্বিধা করেন নি
বুরজাহোম ( আধুনিক কাশ্মীরের আঁতুড়ঘর )
বুরজাহোম প্রত্নক্ষেত্র  হল  ভারতের  জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের  শ্রীনগর জেলায়  অবস্থিত একটি প্রত্নক্ষেত্র পুরাতাত্ত্বিক খননকার্যের মাধ্যমে এখানে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দ থেকে ১০০০ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ের চারটি প্রাগৈতিহাসিক সংস্কৃতির স্তর পাওয়া গিয়েছে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায় দুটি নব্যপ্রস্তরযুগীয়  স্তর ;  তৃতীয়পর্যায়টি  ( বড়ো পাথরে তৈরি  মেনহির  ও চাকা নির্মিত লাল মৃৎপাত্রের ) মধ্য-প্রস্তরযুগীয়স্তর ;  এবং চতুর্থ পর্যায়টি আদি ঐতিহাসিকযুগীয়  ( উত্তর-মধ্যপ্রস্তরযুগীয় ) স্তর 
এই প্রত্নক্ষেত্রটি  কাশ্মীরের প্রাগৈতিহাসিক মানববসতির প্রমাণ বহন করছে এই অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত সব রকমের প্রত্যক্ষ প্রমাণ ( এর মধ্যে প্রাচীন উদ্ভিদ ও প্রাণী-জগৎ সংক্রান্ত অনুসন্ধানও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ) নিয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধানের পর প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানব বসতির চারটি স্তর নির্দিষ্ট করা সম্ভব হয়েছে

বুরজাহোম প্রত্নক্ষেত্রে খনন কার্য চালিয়ে জানা গিয়েছে যে , নব্যপ্রস্তরযুগে এই অঞ্চলের মানুষ মাটির তলায় গর্ত তৈরি করে বা মাটির উপর ছাউনি-জাতীয় আবাসস্থল নির্মাণ করে বাস করত । মধ্যপ্রস্তর যুগের মানুষ বাসকরত মাটির তৈরি বাড়িতে   এই অঞ্চলে প্রচুর হাড় ও পাথরের তৈরি যন্ত্রপাতিও পাওয়া গিয়েছে এর থেকে অনুমান করা হয় যে , সেই সময়কার মানুষ শিকার ও কৃষিকার্যের মাধ্যমে খাদ্য সংগ্রহ করত
বুরজাহোম প্রত্নক্ষেত্র থেকে যে প্রত্ন-সামগ্রীগুলি উদ্ধার করা হয়েছে, তার শিল্পকলা , স্থাপত্য , শৈলী এবং সামাজিক রীতি-নীতি ও আচার-অনুষ্ঠান সংক্রান্তদিকগুলি নিয়ে গবেষণার পর অনুমান করা হয় যে , বুরজাহোমের প্রাগৈতিহাসিক মানুষদের সঙ্গে  মধ্য-এশিয়া , দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া  এবং  গাঙ্গেয় সমভূমি   ভারতীয় উপদ্বীপের  মানুষদের যোগাযোগ ছিল এখান থেকে আবিষ্কৃত মৃৎপাত্র ও অন্যান্য শিল্প সামগ্রীর উপর খোদিত চিত্রকলায় এই অঞ্চলের শিল্প ,  স্থাপত্যশৈলী , ভাষা এবং রীতিনীতি ও আচার-অনুষ্ঠান সংক্রান্ত দিকগুলির মধ্যে স্থানীয় ও বৈদেশিক প্রভাবের সংমিশ্রণ লক্ষিত হয়
ঠিক কোথায় অবস্থিত এই বুরজাহোমের প্রত্নক্ষেত্র ?
কারাকোরাম   পিরপাঞ্জাল পর্বতমালার  মধ্যবর্তী  কাশ্মীর উপত্যকায়  বুরজাহোম গ্রামে এই প্রত্নক্ষেত্রটি আবিষ্কৃত হয়েছে গ্রামটি নাসিম-শালিমার রোডের ধারে  শ্রীনগর  থেকে ১৬ কিলোমিটার  ( . মাইল ) দূরে অবস্থিত সমুদ্র-পৃষ্ঠ থেকে এই প্রত্নক্ষেত্রটির উচ্চতা ১,৮০০ মিটার ( ,৯০০ ফুট )
 ভারতের যে ক’টি নব্যপ্রস্তরযুগীয় প্রত্নক্ষেত্র খনন-কার্যের মাধ্যমে আবিষ্কৃত হয়েছে , তারমধ্যে বুরজাহোম প্রত্নক্ষেত্রটিই ভারতের সর্বাধিক উত্তরে অবস্থিত এই প্রত্নক্ষেত্রটি একটি প্রাচীন  প্লেইস্টোসিন  হ্রদ শয্যার উপর  ঝিলমনদীর  প্লাবন সমভূমির  একটি উচ্চধাপে অবস্থিত ডাললেক বুরজাহোম থেকে ২ কিলোমিটার  ( . মাইল ) দূরে অবস্থিত এখান থেকে ডাললেকের একটি বড়ো অংশ দৃশ্যমান হয়  কাশ্মীরি ভাষায় বুরজাহোম কথাটির অর্থ  ভূর্জ নামে একপ্রকার গাছ এইগাছ  হিমালয়ের ৩,০০০ থেকে ৪,২০০মিটার  ( ,৮০০ থেকে ১৩,৮০০ ফুট ) উচ্চতায় জন্মায় বুরজাহোম প্রত্নক্ষেত্রের প্রাচীন জনবসতির আবাসস্থলগুলির ছাদ এই গাছ দিয়ে তৈরি হত এরথেকেই বোঝা যায় , প্রাগৈতিহাসিক নব্যপ্রস্তরযুগেও এইগাছের অস্তিত্ব ছিল
খনন কাজের সময়
১৯৩৬ সালে বুরজাহোম প্রত্নক্ষেত্রে খুব স্বল্প পরিসরে খনন কার্য চালানো হয়েছিল সেই খনন কার্য পরিচালনা করেছিল হেলমুটডেটেরা    টমাস টমসন পিটারসনের নেতৃত্বাধীন ইয়েল-কেমব্রিজ এক্সপেডিশন এরপর ১৯৬০ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে  ভারতীয় পুরাতত্ত্বসর্বেক্ষণের  ফ্রন্টিয়ার সার্কেল এই প্রত্নক্ষেত্রে বৃহৎ পরিসরে অনুসন্ধান চালায় এই অনুসন্ধানের নেতৃত্ব দেন টি. এন. খাজাঞ্চিও তাঁর সহযোগীরা
   এখানকার প্রত্নক্ষেত্রেই কাশ্মীরের প্রথম বহুস্তর বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক প্রত্ন-সামগ্রীর ভাণ্ডার আবিষ্কৃত হয়েছে ১৯৪৪ সালে ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণের তৎকালীন ডিরেক্টর-জেনারেল  মর্টিমার হুইলার  প্রথম অন্যান্য প্রত্নক্ষেত্রে ভৌগোলিক মডেলের ভিত্তিতে স্তর বিশিষ্ট পুরাতাত্ত্বিক খননকার্য চালানো শুরু করেছিলেন একই মডেলে বুরজাহোম প্রত্নক্ষেত্রটির নামকরণ করা হয়েছিল  নর্দার্ননিও লিথিক কালচার ” বা উত্তর নব্যপ্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতি এই প্রত্নক্ষেত্র থেকে প্রাপ্ত হাড় ও পাথরের তৈরি যন্ত্রপাতি ও আচার-অনুষ্ঠান সংক্রান্ত প্রত্ন সামগ্রীগুলির উপস্থিতি বিবেচনা করেই এই নামকরণ করা হয়েছিল
      বুরজাহোমে নব্যপ্রস্তরযুগীয় মানুষের যে নর-করোটির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে , তা  সিন্ধু-সভ্যতার  হরপ্পায়  প্রাপ্ত নর-করোটির অনুরূপ কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন  বৈদিক আর্য  সভ্যতা কাশ্মীর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল কিন্তু , বুরজাহোমে পুরাতাত্ত্বিক খনন-কার্য চালিয়ে যে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে , তা থেকে  ‘ কাশ্মীরে আর্য উপস্থিতি ’-র তত্ত্ব প্রমাণিত হয় না
১৯৫৮ সালের প্রাচীন স্মারক ও প্রত্নক্ষেত্র আইন  ( ২০১০ সালে সংশোধিত )  অনুসারে ,  বুরজাহোম প্রত্নক্ষেত্র ও তার মধ্যবর্তী স্থানগুলির ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণের দায়িত্ব ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ ও রাজ্য পুরাতত্ত্ব বিভাগের হাতে ন্যস্ত
২০১৪ সালের ১৫ এপ্রিল বুরজাহোম প্রত্নক্ষেত্রের নাম  ইউনেস্কো  বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলির  সাময়িক তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয় এটি এখনও বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে অনুমোদিত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে
আবিষ্কারসম্পাদনা

আঁতুড়ঘর থেকে আধুনিক কাশ্মীরের আর কী কী জানা যায়
১৯৬০ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ১১ বছরের অনুসন্ধানের ফলে এই প্রত্নক্ষেত্রে চারটি অবিচ্ছিন্ন জীবিকা কেন্দ্রিক পর্যায়ের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে এই চারটি পর্যায় হল:-
নব্যপ্রস্তরযুগীয় প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায় : প্রথম পর্যায়টির নাম অ্যাসিরামিক বা মৃৎশিল্পবিহীন এবং দ্বিতীয় পর্যায়টির নাম সিরামিক বা মৃৎশিল্প সংক্রান্ত
মধ্যপ্রস্তরযুগীয় তৃতীয় পর্যায় :
এই পর্যায়ের মানুষ পাহাড় থেকে কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে বড়ো বড়ো পাথর বয়ে এনে বৃহদাকার  মেনহির  প্রস্তুত করে স্থাপন করেছিল
আদি ঐতিহাসিক যুগীয় চতুর্থ পর্যায় :
এই পর্যায়টি এই প্রত্নক্ষেত্রে আবিষ্কৃত শেষ পর্যায় বুরজাহোমের মৃৎ-শিল্পে এই অঞ্চলের শিকার ভিত্তিক সংস্কৃতির প্রতিফলন দেখা যায় এই শিল্পকলা চীনা নব্যপ্রস্তরযুগীয় মৃৎ-শিল্পের থেকে অনেকাংশেই পৃথক  এই অঞ্চলের মানুষের অর্থনীতি ছিল শিকার ও সঞ্চয় ভিত্তিক কৃষিকাজ এই সময় সদ্য শুরু হয়েছিল
 বুরজাহোমের মৃৎ-পাত্রগুলি অধুনা পাকিস্থানের  সোয়াট উপত্যকায়  প্রাপ্ত মৃৎ-পাত্রগুলির অনুরূপ বিশেষত উভয় অঞ্চলের পাত্রের আকার ও কালোমাটির অঙ্গসজ্জাগুলি অনেকটা একই রকমের বুরজাহোমের মৃতদেহ সমাধিস্থ করার প্রথা ও নির্মিত যন্ত্রপাতি গুলির সঙ্গে উত্তর চীনের নব্যপ্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতির সাদৃশ্য লক্ষিত হয়
করদ রাজ্যের জন্ম -
বর্তমানের জম্মু ও কাশ্মীরের ( পূর্বের নাম করদ রাজ্য) জন্ম হয়েছিল ১৮৪৬ সালে প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধের পর  হেনরিলরেন্স-এর পরামর্শে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির  লর্ড হার্ডিঞ্জ  কাশ্মীর উপত্যকাকে তাঁদের মূলভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করেন ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধের সময় ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বিশাল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় সেই ক্ষয়ক্ষতি পুনরুদ্ধার করতে অমৃতসর চুক্তি অনুসারে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরকে জম্মুর  দোগড়া  শাসকদের কাছে বিক্রি করা হয় তখন থেকে শুরু করে অর্থাৎ ১৮৪৬ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত জম্মু ও কাশ্মীর মহারাজা দ্বারা শাসিত একটি দেশীয় রাজ্য ছিল
চুক্তি অনুসারে এই রাজ্যের বিস্তার ছিল সিন্ধু নদের পশ্চিমদিক থেকে রাভি নদীর পূর্বদিক পর্যন্ত এবং আয়তন ছিল প্রায় ৮০৯০০ বর্গমাইল  ( ২১০০০০ বর্গকিমি )   পরবর্তীকালে  হুনযা , নাগার  এবং  গিলগিট এই রাজ্যের সাথে সংযুক্ত হয়
দেশ বিভাজনের সময় তৎকালীন মহারাজা হরিসিং ভারত বা পাকিস্থান কারোর সাথেই যুক্ত না হয়ে স্বাধীনভাবে থাকতে চেয়েছিলেন তাঁর স্বপ্ন ছিল  ,  ভারত এবং পাকিস্থান উভয়েই তাঁর রাজ্যকে  সুইজারল্যান্ড-এর মত একটি স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেবে
     প্রবন্ধের একদম অন্তিম পর্যায়ে সিন্ধু নদ দিয়ে আলোচনা শেষ করা যাক ভূস্বর্গ ও সিন্ধুর যাত্রা । বিভক্ত কাশ্মীরে মাত্র কিছু শতাংশ এই উপত্যকা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ।

সিন্ধুনদ তিব্বতের মানস সরোবর  হ্রদের নিকট  কৈলাশের  উত্তর ঢাল থেকে উৎপত্তি হয় যদিও নদীর অধিকাংশ গতিপথ প্রতিবেশী  পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত । দক্ষিণ এশিয়ার পাঞ্জাবের নামের উৎস এই উপনদীসমূহ ; নামপাঞ্চ ( " পাঁচ " )  থেকে প্রাপ্ত এবং অব-হল'  ( " জল " ) , অতএব শব্দসংযোগ করে হলপাঞ্জাব ) যার অর্থ " পঞ্চনদীরদেশ "

No comments:

Post a Comment

আত্মারা যখন অন্য গ্রহে

১ রা তটা এখন বেশ গভীর । টুক করে শব্দ হতেই কান সজাগ হয়ে উঠলো অ্যাটলাসের । মাথার মধ্যে টিঁ টিঁ কী বেশ ক্যাল্কুলেশন করেই এগিয়ে গেল দরজার ...