Sunday 18 February 2018

মহাকাব্য থেকে আধুনিক সাহিত্যে বর্ষণ

Image result for image of meghdutam mahakavya


ঋতুবৈচিত্র্যের মাঝে বর্ষাকে আলাদা বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত করা যায়। যুগে যুগে
কবিরা বর্ষাকে বিরহের ঋতু হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বর্ষা এলে
স্বভাবতই মানুষের মনে বিরহ দানা বাঁধতে থাকে। প্রিয়তমার অনুপস্থিতি
ব্যক্তিকে আবেগাপ্লুত করে তোলে। প্রিয়জনের শূন্যতাকে বর্ষা আরো দ্বিগুণ
করে তোলে। আর তাইতো বর্ষাকাল আলাদা এক উপাখ্যানের জন্ম দিয়েছে।
বর্ষা নিয়ে এযাবৎকালে কম সাহিত্য রচিত হয়নি। সাহিত্যের সবগুলো
শাখার মধ্যে কবিতায় বর্ষার অনুষঙ্গ এসেছে অসংখ্যবার। কোনো কোনো
কবির হাতে রচিত হয়েছে পূর্ণাঙ্গ এক কাব্য। যার আদ্যোপান্ত বর্ষায় সিক্ত।
বর্ষাকে নিয়ে লেখা হয়েছে অনেক প্রেম ও বিরহের কবিতা। আর এসব
কারণেই বর্ষাকে বিরহের কাল বলা হয়ে থাকে। প্রেমিকের জীবনে বর্ষা
আসে বিরহ নিয়ে। বাদলের ধারায় বেদনার্ত হয়ে ওঠে মন। ঝরে
বেদনাশ্রু। প্রিয় কিছু হারানোর বেদনা বর্ষা এলেই খুব বেশি মনে পড়ে।
অথই জলের মধ্যে হাবুডুবু খায় প্রেমিকপ্রবর। তাকে যেন বানের জলের
মতো ভাসিয়ে নেয় অজানা গন্তব্যে। তাই তো কবির কাছে বর্ষা মানে ক্ষণে
ক্ষণে বিরহের গান। বলা নেই-কওয়া নেই অমনি শুরু হয়ে গেল অশ্রুর
বর্ষণ। কখনো কখনো মনে হয় চোখ ভরা অভিমান নিয়ে ধেয়ে আসা
কিশোরীর পায়ের নূপুরের রিনিঝিনি আওয়াজ ।

রামায়ণ মহাকাব্যে বর্ষা

কালিদাসের বেশ আগে-অন্তত আঠারোশ থেকে দু’হাজার বছর আগে তো
বটেই বাল্মীকি-রামায়ণে কিন্তু বর্ষা আসে প্রবল সমারোহে। প্রকৃতি ও
রামের বিরহী মন এখানে একাকার হয়ে যায়। কোথাও কিছু কৃত্রিম মনে হয়

না। সত্য অভিজ্ঞতার ও সত্য অনুভবের ছাপ নিশ্চিত অমলিন আজও একই
রকম। রাবণের সীতা-হরণের পর বর্ষাকাল দেখা দেয় এই প্রথম। লক্ষণকে
রাম বলতে থাকেন- দেখ, বর্ষা এসেছে। পাহাড়ের মতো ঘন নীল মেঘে আকাশ
ছাওয়া। সারি সারি মেঘ যেন আকাশে ওঠার সিঁড়ি। কুড়চি ফুলের মালা নিয়ে
গিয়ে সূর্যকে সাজাবার পথ। পৃথিবী ছিল সূর্যতাপে ঘামে পরিক্লিষ্ট। নব
জলধারায় সিক্ত হয়ে যেন শোকসন্তপ্তা সীতার মতো অশ্রুমোচন করছে।
আরো বলেন,
‘নীলেষু নীলা নববারিপূর্ণা মেঘেষু মেঘাঃ প্রতিভান্তি সক্তাঃ ।’
অর্থাৎ ,নববারিপূর্ণ মেঘেরা নীলমেঘে আসক্ত হয়ে নিজেরাও নীল হয়ে
উঠছে। আর, ওই নীল মেঘের কোল থেকে বিদ্যুৎ স্ফুরিত হচ্ছে। যেন ‘
স্ফুরন্তি রাবণস্যাঙ্কে বৈদেহীব তপজ্বিনী।’- রাবণের অঙ্কে ‘ তপস্বিনী ’
বৈদেহীর মতো বলায় গোটা ছবি তদাত্মিক হয়েও বেদনার্ত ব্যক্তি। এমন
আন্তরিক বর্ণনা যেকোনো সাহিত্যেই দুর্লভ।
 ‘ আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে ’- শুনলেই মেঘদূত আষাঢ়ের উল্লেখ
মনে জাগে। কিন্তু এ গানে ছবি অনুসরণ করে রামায়ণে রামের বর্ষা-বর্ণনার।
শুনি, ‘ আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে।’ আরো, ‘ রহিয়া রহিয়া বিপুল মাঠের
পরে নব তৃণদলে বাদলের ছায়া পড়ে।’
রামায়ণে রাম বলছেন,

‘বর্ষোদকপ্যায়িতশাদ্বলানি প্রবৃত্তনৃত্যোৎসববর্হিনানি।
বনানি নিবৃষ্ট বলাহকানি পশ্যাপরাহ্নেষ্কধিকং বিভান্তি’।
- প্রচুর বৃষ্টিপাতে শ্যামলভূমি আপ্যায়িত হয়ে তৃণে ছেয়ে গেছে, ময়ূরেরা
নৃত্যে মেতেছে, দেখ, বনানি বৃষ্টির পর অপরাহ্নে আরো শোভাময় হয়েছে।-
বোঝা যায়, দুটো একই গোত্রের। ‘ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে/
জলসিঞ্চিত ক্ষিতিসৌরভ রভসে’- গানটিতে কিন্তু স্মৃতির সুবাস দুদিক
থেকেই আসে। প্রথম স্তবক রামায়ণকে মনে করিয়ে দেয়।


সীতা , ঋতু নির্বাচন ,মেঘ ও কৃষি

সীতা ঋগ্বেদে ধরিত্রীর মূর্তিময়ী সত্বা, শুক্লযজুর্বেদে লাঙ্গল পদ্ধতি,
তৈত্তিরীয়-ব্রাহ্মণে সাবিত্রী, পারস্কর গৃহ্যসূত্রে ইন্দ্ৰপত্নী এবং
রামায়ণে রামপত্নী। অথর্ববেদের কৌশিকসূত্রে (১৪৭ নং) সীতাকে বলা
হয়েছে –

‘পর্জন্যপত্নী হরিণী’। পর্জন্য মেঘাধিপতি ইন্দ্র ।’
শব্দটির অর্থ , শব্দায়মান মেঘ, গর্জন্মেঘ, মেঘশব্দ, মেঘ। ‘হরিণী’
শব্দটি মৃগী অর্থে পাই অর্বাচন বৈদিকে। শব্দটির মূল পুংলিঙ্গরূপ ‘হরিৎ’
ঋগ্বেদে স্ত্রীলিঙ্গরূপেও ব্যবহৃত ছিল বিশেষণ হিসাবে (ঘোড়ার রং)।
প্রজাপতির গল্পের রোহিৎ এই হরিণীর সঙ্গে তুলনীয়। ‘ রোহিৎ’ এবং ‘
লোহিত ’ শব্দদ্বয় সমার্থক। রোহিণী নক্ষত্র লোহিতবর্ণ, হরিৎবর্ণও
বলা যায়। সুতরাং কৌশি কসূত্রে সীতাকে রোহিণী নক্ষত্রযুক্ত করা হয়েছে।
ঋগ্বেদে সীতার স্তুতিকাল বাসন্ত-বিষুবতে। বেদে ইন্দ্রর শ্রেষ্ঠত্ব
স্বীকৃত। ইন্দ্র দ্বাদশাদিত্যের এক আদিত্য। ‘ আদিত্য ’ শব্দটি পুংলিঙ্গ
ও দ্বিবচনান্ত হলে অর্থ হয় অদিতি দেবতার পুনর্বসু নক্ষত্র। সুতরাং
ঋগ্বেদে সীতার সঙ্গে ইন্দ্রর উল্লেখ করে পুনর্বসু নক্ষত্রে বাসন্ত-
বিষুব নির্দেশ করা হয়েছে।
পরবর্তীকালে সূর্যর অয়নচলন হেতু বাসন্ত-বিষুব পশ্চিমদিকের
নক্ষত্রগুলিতে সরে এলে এবং কালক্ৰমে দ্বাদশ রাশি সংশ্লিষ্ট দ্বাদশ
মাসের সূর্যকে দ্বাদশ আদিতে বিভাগ ও নামকরণ করা হলে পূর্বসূত্র
অনুসারে মনে হয়, বাসন্ত-বিষুব কালের সূর্যকে ইন্দ্র নামেই আখ্যাত করা
হয়। এজন্যই হয়ত বৃষরাশিতে জ্যৈষ্ঠমাসে বাসন্ত-বিষুব অনুষ্ঠিত হওয়ার
কালে এই মাসের সূর্যকে ‘ ইন্দ্র ’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। ইন্দ্র
দেবতাগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। সে কারণে যে নক্ষত্র বা যে মাসের শ্রেষ্ঠত্ব
তৎকালীন মানুষের ধ্যানে ছিল সেই নক্ষত্র ও মাসের সঙ্গে ‘ ইন্দ্র ’
নামটি যুক্ত করে নিয়েছিল। লোকমান্য তিলক প্রমাণ দিয়েছেন খ্রীষ্টের
অন্ততঃ চার হাজার বছর আগে মৃগশিরা নক্ষত্রে বাসন্তবিষুব হত। সেকালে

চান্দ্র-অগ্রহায়ণ মাসে সূর্যর জ্যেষ্ঠ নক্ষত্রে অবস্থান কালে শারদবিষুব
হতে বৎসর গণনার রীতি ছিল।
এখানে লক্ষণীয় যে এই সময় শারদ-বিষুব অর্থাৎ শরৎকাল প্রাধান্য লাভ
করেছে। বর্ষার পর শরৎ ঋতুতে কৃষিকর্মের ফলাফল স্পষ্ট হয়। অতীতের
সীতার ধ্যানধারণার সঙ্গে এবার কৃষিকাজ জড়িয়ে গিয়েছে। হয়ত ইন্দ্রের
শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার কারণে এবং নভঃমণ্ডলের বৃহত্তম নক্ষত্র জ্যেষ্ঠার
গুরুত্ব মেনে নিয়ে জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রেরও নামকরণ হয়েছিল ইন্দ্র।

কালিদাস ও মেঘ-বর্ষা

বর্ষা নিয়ে মহাকবি কালিদাস রচনা করেছেন বিখ্যাত মহাকাব্য 'মেঘদূত'।
মেঘকে সেখানে যক্ষের বন্ধু বলা হয়েছে। যক্ষ তার প্রিয়ার কাছে মেঘকে
দূত করে খবর পাঠাতেন। কী করে মেঘ কবির কল্পনায় হয়ে উঠছে
বিরহির বার্তাবাহক প্রাণবন্ত-জীবন্ত দূত! কল্পনায় মেঘ-কে ইন্দ্রিয়ানুভব
প্রদান করে মেঘের স্তুতি করে যক্ষ বলছে, 'ওগো মেঘ, আমি জানি তুমি
পুষ্কর এবং আবর্তক মেঘের বংশে জন্মগ্রহণ করেছ, তুমি ইন্দ্রের প্রধান
সহচর, তুমি তোমার ইচ্ছানুযায়ী রূপগ্রহণ করতে পারো ! অদৃষ্টবশে
আমার প্রিয়া আজ দূরবর্তী, তাই তোমার কাছে আমি প্রার্থী হয়ে এসেছি;
গুণবান ব্যক্তির কাছে প্রার্থনা যদি ব্যর্থ হয় তবে তাও ভালো- অধম
ব্যক্তির কাছে প্রার্থনা সফল হলেও তা বরণীয় হতে পারে না।' কর্তব্যে
অবহেলার দায়ে এক বছরের জন্য নির্বাসিত যক্ষ মেঘকে অনুরোধ করেছে
তার প্রিয়ার কাছে খবরটুকু পৌঁছে দিতে। মেঘদূতের ৪২ নম্বর শ্লোকে বলা

হয়েছে-

' ত্বনি্নষ্যন্দোচ্ছ্বসিতবসুধাগন্ধসংপর্করম্যঃ ,

স্রোতোরন্ধ্রধ্বনিতসুভগং দন্তিভিঃ পীযমানঃ , নীচৈর্বাস্যত্যুপজিগমিষোর্দেবপূর্বং

গিরিং তে

শীতো বাযুঃ পরিণমযিতা কাননোদুম্বরাণাম্ ।'

এর অর্থ , তোমার প্রথম বর্ষণে ভেজা মাটির সুবাস পেয়ে নিদাঘের জ্বালা
জুড়াতে আসিবে শীতল পবন ধেয়ে,ছোঁয়া লেগে তার পরিণত হবে কাননে
উদুম্বর, সজল বাতাস টানিবে সরবে গজেরা শুন্ডধর ! দেব-গিরিগামী
তোমারে ব্যজন করিবে হে সমীরণে, নিঃশেষ কোরো ভাণ্ডার সেথা অবিরত
বরিষণে।

বৈষ্ণব পদাবলী ও বরিষণ

মেঘদূত ছাড়াও বৈষ্ণব পদাবলীতেও বিরহের সঙ্গে বর্ষার একটি নিবিড়
সম্পর্ক স্থাপন করেছেন পদকর্তারা। পদাবলী সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ মহাজন
বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস আর বিহারীলালের কবিতায়
বর্ষা এসেছে একাধিকবার। তাদের বিরহের কবিতায় ও গানে বর্ষা ও বিরহ
একাকার হয়ে গেছে। যা নতুনরূপ নিয়েছে মধ্যযুগের বাংলা কবিতা ও
গানে। সে সময়ে বর্ষাই যেন প্রিয়জনের আরাধনার উৎকৃষ্ট সময়। ভাবনার
নিরবচ্ছিন্ন উপলক্ষ হয়ে উঠেছিল।
বর্ষা সব সময়ই আমাদের কাছে অতি আদরণীয় অতিথি। কাব্য সাহিত্যে
ঋতু বর্ণনায় বর্ষাই অধিকাংশ স্থান দখল করে আছে। তাকে নিয়ে আমাদের
হাসি-কান্না অনেক দিনের। সহস্রাধিক বছর আগেকার আদি কবি বাল্মীকির
কাছে আমরা বর্ষার অপরূপ বর্ণনা দেখতে পাই। চিত্রকূট পর্বতে যখন বর্ষা
নেমে এসেছে তখন সমস্ত বনভূমি মেঘচ্ছায়াচ্ছন্ন অন্ধকারে আবৃত হয়ে
গেছে, আর অবিরত বর্ষণ চলছে চারদিকে। আদি কবির কাব্যে বর্ষার এই
চিত্রটি অক্ষয় হয়ে আছে বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যেও ।
কবি বিদ্যাপতি ও অন্যান্য এবং তাঁদের রচনায় বৃষ্টি

আমরা যদি পদাবলী সাহিত্যে বর্ষার পদগুলো আস্মাদন করি প্রথমেই
মিথিলার কবি বিদ্যাপতির বর্ষা বিরহের শ্রেষ্ঠ পদটি আস্মাদন করতে হয় –

‘এ সখি হামারি দুঃখের নাহি ওর ।
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর ।’

অর্থাৎ ,সখি আমার দুঃখের কোন শেষ নেই। এ ভরা বাদল, ভাদ্র মাস।
আমার মন্দির ( গৃহ ) শূন্য। চারদিকে মেঘ গর্জন করছে, ভুবন ভরে
বর্ষণ হচ্ছে, শত শত বজ্র পতিত হচ্ছে, ব্যঙ এবং ডাহুক ডাকছে। হৃদয়ে
কাম দারুণ কিন্তু আমার কৃষ্ণ প্রবাসে। পদাবলী সাহিত্যে বিদ্যাপতি যদিও
বাঙালি নন বা বাংলায় কোন পদ রচনা করেন নি; তবুও তিনি বাঙালির
শ্রদ্ধেয় কবি।
বর্ষার রূপটি আমরা ‘জয়দেবের’ বর্ষা বর্ণনায় দেখি। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে
বর্ষার বিচিত্র অনুভূতির জগৎটি সর্বপ্রথম দেখতে পাই বৈষ্ণব পদকর্তাগণের
পদাবলী সাহিত্যে। বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস প্রমূখ কবি
বর্ষা বিরহ ও বর্ষা অভিসারের অনেক পদ রচনা করেছেন। তাঁদের কাব্যে
বর্ষার সাথে প্রেম ও বিরহ শব্দ দু’টি ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে।

বাংলা ভাষায় বৈষ্ণব পদাবলীর আদি রচয়িতা কবি হলেন চণ্ডীদাস। তিনি
যুগ যুগ ধরে বাঙালির হৃদয়কে অসীম মাধুর্যে পূর্ণ করে তুলেছেন। তাঁর
বর্ষা অভিসার পদে লক্ষ্য করা যায়-

‘এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা
কেমনে আইল বাটে।
আঙ্গিনার মাঝে বঁধুয়া ভিজিছে
দেখিয়া পরান ফাটে ।।’

ভাব ভাষা ছন্দের চিত্ররূপ অলংকার বেদনা আর ব্যাকুলতা চণ্ডীদাসের বর্ষা
বিরহের পদের মূল সুর বলে বিশ্ব মানব হৃদয় এতে খুব সহজেই সাড়া
দেয়।

চণ্ডীদাসের পর জ্ঞানদাসের অভিসারের পদের দিকে দৃষ্টি দিলেও বর্ষা
ঋতুর প্রভাব পরিলক্ষিত হয় –

‘ মেঘ যামিনী অতি ঘন আন্ধিয়ার ।
ঐছে সময়ে ধনি করু অভিসার ।।
বরিখত ঝর ঝর খরতর মেহ।
পাওল সুবদনী সংকেত গেহ ।।’

মেঘময় অন্ধকার রাত। এখন অভিসারের সময় হয়েছে।খরতর মেঘ ঝর
ঝর করে বর্ষণ করছে। উভয়েই পূর্ব নিদৃষ্ট ঘরে গেল। বৈষ্ণব কবিদের
নায়ক-নায়িকা বর্ষার রাতে অভিসারে বের হন। আকাশে মেঘ উঠলেই
তাদের সঙ্গ লিপসা বর্ধিত হয়।
অনুরূপ ভাব গোবিন্দ দাসের অভিসারে পংক্তিতেও দেখা যায়-

‘অম্বরে ডম্বর ভরু নব মেহ।
বাহিরে তিমির না হেরি নিজ দেহ ।।’

নব মেঘের দল আকাশ ভরে আছে। বাইরের অন্ধকারে নিজের দেহ পর্যন্ত
দেখা যায় না। এ দেখে নিজের অন্তরে কামনার বাসনা ও মিলনের তীব্র
ব্যাকুলতা জেগে উঠল। মেঘ দেখে কেবল বিরহীজন নয়, জগতের সমস্ত
সুখী লোকও আনমনা হয়ে পড়ে। তার মনের গভীরে বেদনার বোধ জাগে
ও মন হয়ে যায় বিকল। পদকর্তাদের বর্ষার এ পদগুলোতে কি যে এক
আত্মীক প্রণয়াকাক্সক্ষার জ্বালা, মিলনের গভীর উল্লাস ও বিরহের মর্মস্পশী
ফুটে উঠেছে তা কেবল বর্ষার জন্যই সম্ভব হয়েছে। বর্ষার সাথে প্রেম ও
বিরহের একটি অবিচ্ছেদ্য বন্ধন স্থাপিত হয়ে আছে।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে বাদল

বড়ু চণ্ডীদাসের 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্যে কৃষ্ণের জন্য রাধার বিরহের যন্ত্রণা
বেড়ে যায় এই বর্ষা এলেই। কৃষ্ণের বিরহে ব্যাকুল হয়ে প্রেমিকা রাধা তার
সহযোগী বড়াইকে বলেছে-

'আষাঢ় শ্রাবণ মাসে মেঘ

বরিষে যেহ্ন
ঝর এ নয়নের পানি।
আল বড়ায়ি

সংপুটে প্রণাম করি দুইলো সখিজনে
কেহো নান্দ কাহবনঞিকে আনী।'

এমনও দেখা গেছে, বর্ষায় অভিসারে যাওয়ার পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে রাধা
নিজের ঘরের মধ্যে জল ছিটিয়ে কর্দমাক্ত করে কাঁটা পুঁতে রেখে রাতের
অন্ধকারে তার ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে প্রিয় কৃষ্ণের সান্নিধ্য লাভের সাধনা
করতেন। যাতে বর্ষায় প্রিয় কৃষ্ণের অভিসারে যেতে পথের কাঁটা তার বাঁধা
হয়ে না দাঁড়ায়। পিচ্ছিল পথ যেন অনায়াসেই হেঁটে যেতে পারে।

ফুল্লরার বারোমাসের একমাস

বর্ষার অন্য একটি রূপ দেখতে পাই মধ্য যুগে ষোড়শ শতাব্দীতে এক
বাস্তবধর্মী জীবনবাদি কবি ‘কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী’র কাছে। তিনি
তাঁর কালকেতু উপাখ্যানে ফুল্লরার বারমাসি দুঃখ বর্ণনা করতে গিয়ে বর্ষার
বহিরঙ্গ বর্ণনায় ফুল্লরার দুঃখকে তীব্রতর রূপে প্রকাশ করেছেন -

‘ আষাঢ়ে পুরিল মহি নব মেধে জল।
বড় বড় গৃহস্থের টুউয়ে সম্বল।।
মাংসের পসরা লয়্যা বুলি ঘরে ঘরে।
কিছু খুদ-কুড়া মিলে উদর না পুরে।।
শ্রাবণে বরিষ মেঘ দিবস রজনী।
সিতাসিত দুই পক্ষ একই না জানি।।
আচ্ছাদন নাহি অঙ্গে পড়ে মাংস জল।
কত মাছি খায় অঙ্গে করমের ফল ।।’

কালকেতু উপাখ্যানে বর্ষা এসেছে উপার্জনের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে। স্বভাবতই
গ্রামাঞ্চলে বর্ষা এলে কাজকর্ম কমে যায়। চারিদিকে অথৈ জল থাকায়

উপার্জনের তেমন কোনো পথ থাকে না। ফলে গ্রামের পুরুষেরা অলস সময়
কাটায়। নারীরা ঘরের মধ্যে বসে টুকটাক হস্তশিল্পের কাজ করে। তাদের
জন্য বরং বছরের অন্যান্য মাসে উপার্জিত শস্যই তখন তাদের ক্ষুধা
নিবারণে সহায়ক হয়ে ওঠে।

মাইকেল ও বৃষ্টি

মধ্যযুগের কাব্যে বর্ষার ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়- এ কথা
অনস্বীকার্য। তবে মধ্যযুগের ধর্মাশ্রিত কাব্যচর্চার পরে আধুনিক যুগে
এসে কবিদের কবিতায় মানবতার সুরের সাথে সাথে তাল মেলাতে বর্ষার
প্রসঙ্গও এসেছে সমানতালে। আধুনিক যুগের অন্যতম কবি মাইকেল
মধুসূদন দত্ত তাঁর 'বর্ষাকাল' কবিতায় বর্ষার রূপকল্প বর্ণনা করেছেন-

'গভীর গর্জন করে সদা জলধর
উথলিল নদ-নদী ধরণীর উপর
রমণী রমন লয়ে
সুখে কেলি করে
দানবাদি দেব বক্ষ সুখিত অন্দরে।'
মেঘের গর্জনে নদ-নদী উথাল-পাথাল হয়ে ওঠে। সাথে সাথে বর্ষার মিষ্টি
মধুর আবহাওয়া বা হালকা শীতল পরিবেশ নর-নারীর মনে কাম বাসনা জাগ্রত
করতে সহায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়। কর্মহীন অলস সময় তখন তারা মেতে
ওঠে জৈবিক চাহিদা নিবৃত্তের উৎসবে। মেঘের গর্জনের সাথে সাথে নারী
বক্ষে উন্মাতাল ঢেউ ওঠে। যা আছড়ে পড়ে পুরুষের সুবিশাল বক্ষে।
রবীন্দ্রনাথের গানে,রচনায় বর্ষা-মঙ্গল
আধুনিক কবিদের মধ্যে বর্ষার নিয়ে সবচেয়ে বেশি কবিতা লিখেছেন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিশু রবীন্দ্রনাথের প্রথম অনুভবের কবিতা ‘জল পড়ে
পাতা নড়ে’।  তারপর এই বিশ্ব-বিশ্রুত প্রতিভার অনেক মায়াবি অধ্যায় জুরে

পাওয়া যায় বর্ষার অপরূপ কবিতা। তাঁর সৃষ্টির পরতে পরতে বর্ষার ছোঁয়া।
প্রত্যেক ঋতুকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কিছু না কিছু সৃষ্টিকর্ম রয়েছে কিন্তু
বর্ষাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি। সাহিত্যের যে শাখাতেই তাঁর ছোঁয়া আছে
সেখানেই বর্ষার রূপায়ণ। এ ক্ষেত্রে আমরা তাঁকে বর্ষার বরপুত্র হিসেবে
ধরতে পারি।

‘এসছে বরষা, এসেছে নবীন বরষা
গগন ভরিয়া এসেছে ভুবন ভরসা ।’

বর্ষা যেন কবির কাছে এক বহু কাঙ্ক্ষিত বার্তা নিয়ে এসেছে। এই নবীনা
বর্ষা তাঁর কাছে জীবন্ত তরণী। আষাঢ়ে নব আনন্দ, উৎসব নব।অতি
গম্ভীর অতি গম্ভীর অম্বরে ডম্বরু বাজে।আষাঢ়ে মেঘের গর্জন, বিদুতের
নৃত্য, ঝর ঝর রস ধারা সত্যই এক অনুভবের ব্যাপার। রবি কবির বর্ষার
মূল সুর মূলত মেঘদূত পদাবলীর মতো বিরহেরই বাণী। রবীন্দ্র কাব্য
সাহিত্যে মেঘদূতের প্রভাব সীমাহীন। তাঁর মানসীর ‘মেঘদূত’  ও ‘পত্র’
কবিতা, কল্পনার ‘স্বপ্ন’ ও ‘বর্ষামঙ্গল’ কবিতা, সোনার তরীর ‘বর্ষা
যাপন’ ক্ষণিকার ‘সেকাল’ সমস্তই কালিদাস দ্বারা গভীরভাবে
প্রভাবান্বিত। তাই এগুলো দুঃখের অন্তঃস্থলে সুখের বাস। এ কবিতাগুলো
পাঠ মাত্র পাঠক হৃদয়ে এক ধরনের স্পন্দন জেগে ওঠে।
এমন দিনে তারে বলা যায়,
এমন ঘন ঘোর বরিষায়।
এমন মেঘ দিনে বাদল ঝর ঝরে—

অথবা,

সঘন গহন রাত্রি, ঝরিছে শ্রাবণ ধারা-
অন্ধ বিভাবরি সঙ্গপরশ হারা।।

হৃদয়ের গহনে যে দরজা, জমাট বদ্ধ যে স্তব্ধ ব্যথা তা একমাত্র
রবীন্দ্রনাথের বর্ষার কবিতায় বন্ধ দরজা ঠেলে দিয়ে মুক্ত বিহঙ্গের মত
ডানা মেলে আকাশে উড়ে চলে-

মন মোর মেঘের সঙ্গী
উড়ে চলে দিগ দিগন্ত পানে
নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণবর্ষণ
সঙ্গীতে রিমিঝিম রিমিঝিম রিমিঝিম।।

কবিগুরুর বর্ষার কবিতাগুলোতে বর্ষা আমাদের অনুভূতি জগতের এক
প্রতীক্ষিত বাসনা ।  তার আগমনে কত কিছুর আয়োজন-
এসো শ্যামল সুন্দর,

আনো তব তাপ হরা তৃষা হরা সঙ্গসুধা।

অথবা,

এসো হে হৃদয় ভরা,
এসো হে এসো পিপাসা হরা
এসো হে আঁখি শীতল করা,
ঘনায়ে এসো মনে।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর বর্ষার কবিতাগুলোতে এমন একটি জগৎ নির্মাণ করেছেন
যে জগৎ চির শ্যামল, চির মধুর ও বেদনা রহিত। ‘বর্ষামঙ্গল’ কবিতায়
নবযৌবনা বর্ষার যে বর্ণনা আমরা পাই তা বাস্তব বিবেচনায় অপ্রাকৃত
হলেও আকর্ষণীয়। কেউ শঙ্খ বাজাচ্ছে, বধূরা হূলুধ্বনী দিচ্ছে, কুঞ্জকুটিরে
রমণী ভাবাকুল নয়নে বসে আছে, কেউ ভূর্জপাতায় মনের কথা লিখছে আবার
কেউ অঙ্গ প্রসাধন করছে –
‘ কোথা তোরা অয়ি তরুণী পথিক ললনা’ আনো মৃদঙ্গ, মুরজ মুরলী
মধুরা বাজাও শঙ্খ, হুলুরব করো বধূরা এসছে বরষা ওগো নব-অনুরাগিনী
ওগো প্রিয় সুখ ভাগিনী ! বর্ষার এ-সব কবিতায় প্রকৃতি বর্ণনা ও প্রকৃতির
রূপ চিত্রণে তিনি নৈপুন্যের সাথে ও অবর্ণনীয় মাধুর্যের সাথে আমাদের
পরিচয় করিয়ে দেন।বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান। অথবা-

ওই মালতী লতা দোলে
পিয়ালতরুর কোলে পূব-হাওয়াতে।

বর্ষাতো আমাদের জন্য প্রকৃতির আশীর্বাদ । এ ঋতু না থাকলে বাংলায়
সবুজের সমাহার হতো না। প্রকৃতি নতুন পাতার সতেজ নবীন প্রাণ নিয়ে নেচে
ওঠতে পারতো না। এই মমতাময়ী বর্ষাই কদম, যুথী, মালতী, কেয়া বকুলের
সম্ভারে প্রকৃতিকে রূপরাণী করে তোলে। বর্ষাই কবি মনকে ভাবিয়ে তোলে,
ছন্দ দেয়, দোলা লাগায়, তাকে যথার্থ কবি করে তোলে। মোর ভাবনারে কি
হাওয়ায় মাতালো,দোলে মন দোলে অকারণ হরষে হৃদয় গগনে সজলঘন নবীন
মেঘে রসের ধারা বরষে।

রবীন্দ্রনাথের কবিতায় বর্ষার দুই রূপ

রবীন্দ্র কবিতাতে বর্ষার দু’টি রূপ পাওয়া যায়। একটি যেমন বৃষ্টির ঝর ঝর
চঞ্চল রূপ ও বিরহের বাণী । অপরটি হলো অসিম সাহস বা শক্তির। এ-শক্তি
যেন নির্ভীক মনের ভয়হীন কামনা। তাইতো তিনি ঝড়ের রাতেও তার
অভিসারিকাকে খুঁজে পান-
ওরে ঝড় নেমে আয়,

আয়রে আমার শুকনো পাতার ডালে
এই বরষার নব শ্যামের গানে।।
যা উদাসীন, যা প্রাণহীন, যা আনন্দহারা।

অথবা ,
বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা আষাঢ় তোমার মালা তোমার শ্যামল শোভার বিদুতেরই
জ্বালা ।তোমার মন্ত্রবলে পাষাণ গলে ফসল ফলে-অমিত শক্তি নিয়ে কবি
এখানে বর্ষাকে আহ্বান জানাচ্ছেন। পাঠক হৃদয়ের যন্ত্রণাকে মুছে নিয়ে
যান তার সৃষ্টির বিচিত্র কৌশলে ও সমৃদ্ধতম হৃদয়ের মধুর সম্ভাষণে।
মমতাময়ী এই ঋতু কবিকে প্রিয়ার মত – মায়ের মতই ভালোবেসে বা স্নেহে
তার নীল আঁচল বিছিয়ে দিয়েছে। আর কবি তাঁর সবুজ শ্যামল রূপে অবগাহন
করেছেন কখনও বা বিরহে- আনন্দে অথবা শক্তির আবেশে। তিনি বার বার
এই বর্ষার মোহিনী জলে স্নান করে লাভ করেন অমৃত আত্মীক স্বর্গ। ধুয়ে
মুছে ফেলেন সমস্ত পৃথিবীর জরাজীর্ণ আর পুরাতনের অভিশাপ। কাব্য পাঠক
সমাজকে নিয়ে হয়ে ওঠেন এক পবিত্র শুদ্ধতম চির নতুন।
নজরুলের চোখে বারিধারা

কবিগুরুর পরেই বর্ষা বন্দনার জন্য বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে
স্মরণ করা যায়। তাঁর কবিতায়ও বর্ষা ধরা দিয়েছে বিভিন্ন প্রতীকী
ব্যঞ্জনায়। বর্ষার মেঘ তাঁর বিরহ-বেদনাকে আরো বেশি উসকে দিয়েছে।

কবির 'বাদল-দিনে' কবিতায় বলা হয়েছে-
'ব্যাকুল বন-রাজি শ্বসিছে ক্ষণে ক্ষণে,

সজনি! মন আজি গুমরে মনে মনে।

বিদরে হিয়া মম
বিদেশে প্রিয়তম ।’

যার প্রিয়জন দূরে, বর্ষা তাকে আরো বেশি পীড়া দেয়। একাকিত্ব অনুভূত হয়
মনের মাঝে। ব্যাকুল মন কেবলি প্রিয়জনের স্পর্শ কামনা করে।
কিংবা 'বাদল-রাতে পাখি' কবিতায় নজরুল বলছেন-

'বাদল-রাতের পাখি।
কবে পোহায়েছে বাদলের রাত,
তবে কেন থাকি থাকি
কাঁদিছ আজিও 'বউ কথা কও'
শেফালি বনে একা...’

তিনি তাঁর কবিতার মাধ্যমে বাদল রাতের পাখিকে বন্ধু ভেবে বিরহের সাথে
নিজের বিরহ একাকার করতে চেয়েছেন। তিনি বর্ষাকে ভেবেছেন তাঁর দুঃখ-যাতনার সাথী। সে কারণেই 'বর্ষাবিদায়' কবিতায় তাঁর যতো আকুতি-
'যেথা যাও তব মুখর পায়ের বরষা নূপুর খুলি
চলিতে চলিতে চমকে ওঠ না কবরী ওঠে না দুলি
যেথা রবে তুমি ধেয়ান মগ্ন তাপসিদী ও চপল
তোমায় আশায় কাঁদিবে ধরায়, তেমনি ফটিক জল।।'

তথ্যসূত্র –
রবীন্দ্রজীবনকথা, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) - রফিকুল ইসলাম

বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড, সুকুমার সেন
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস , অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
Electronic Journal of Vedic Studies (New Delhi)

No comments:

Post a Comment

আত্মারা যখন অন্য গ্রহে

১ রা তটা এখন বেশ গভীর । টুক করে শব্দ হতেই কান সজাগ হয়ে উঠলো অ্যাটলাসের । মাথার মধ্যে টিঁ টিঁ কী বেশ ক্যাল্কুলেশন করেই এগিয়ে গেল দরজার ...