Thursday 8 February 2018

পাখী বুড়ো

Related image ১

ক্ষীরপুর নাম প্রথম শুনলাম আমার এক বন্ধু স্থানীয় ভাইয়ের কাছে । নামটার
মধ্যেই এক মনকাড়া মিষ্টি গন্ধের সুবাস । এক সকালে রওনা দিলাম সেই ম্যাপের
বাইরে গ্রামে । এসে দেখি উল্টো । সাদা ক্ষীর নেই তবে চারিদিকে সবুজের সমারোহ আর
সাথে হরেক পাখপাখালির কলরব । পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে এমন জিনিস বর্তমানে বিরল ।
উঠলাম অশতিপর গোকুল সামন্তের বাড়ী । প্রথমে ভেবেছিলাম বৃদ্ধ নরম মনের কিন্তু
যখন চশমার ফাঁক দিয়ে আমাকে আচ্ছা করে জরিপ করতে শুরু করলেন তখন ভ্রমটা
ভাঙল । শেষে আমার সকল প্রশ্নের উত্তরে আপাত সন্তুষ্ট হয়ে বিরস মুখে থাকার
জায়গা দেখিয়ে বৃদ্ধ হাঁটা লাগালেন । আমি লেখক মানুষ , এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন
বহুবার হয়েছি ।


ভোরবেলায় ওঠা আমার বহুকালের অভ্যাস । ফুরফুরে হাওয়ায় হাঁটতে বেরবো ঠিক
তখনই গোকুল বুড়ো এক কাপ চা নিয়ে হাজির । ঠোঁটের কোণায় হাল্কা হাসির রেশ ।
বললেন , “ কিছু মনে করবেন না কালকের জন্য । আজকাল মানুষ আর চিনতে পারি না ।”
বুঝলাম , মানুষের মনে অনেক কথা জমাট পাথরের মত চাপা থাকে । ফিরতে বেশ বেলা
হল । গতকাল বাড়ীটাকে ভাল করে দেখা হয় নি ভাল করে । সকালের আলোতে দেখলাম
আমি যে ঘড়ে আছি তার ঠিক বাঁ পাশে কাঁচা গলি চলে গেছে । একটু এগোতেই কানে এল
পাখীর চিচিরমিচির শব্দ । যা দেখলাম তাতে হতভম্ব । বুড়োর কাঁধে , পিঠে নানা পাখি
বসে আছে । একটাও সুস্থ না । কারো পায়ে কাপড়ের পট্টি , কারো ডানা ভাঙা । গোকুল
সামন্ত পরম স্নেহে হাতে ধরে ছাতুর গুলি খাওয়াচ্ছে । ওদের সাথে বাচ্চাদের মত কথা
বলছে । আমি কাকে দেখছি ! কোথায় সেই খিটখিটে মানুষটা ! এগিয়ে গেলাম হাসিমুখে ।
ফল হল উল্টো । যাচ্ছেতাই ভাবে চীৎকার করে আমাকে প্রায় মারতে আসে আর কী!
কোনমতে বেরিয়ে এসে ভাবলাম আর নয় ! কাল থেকে অনেক অপমান সয়েছি ।


পরদিন সকাল হতেই ষ্টেশনের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম । ছোট্ট করে “আসি” বলতেই
বুড়োকে দেখলাম অবাক চোখে আমার দিকে চেয়ে আছে । রাস্তার পাশে চায়ের দোকান ।
গলা ভেজাবো বলে বসলাম । পাশের এক ছোকরা গোছের ছেলে আমার দিকে চেয়ে প্রশ্ন
করল , “ দাদাকে নতুন দেখছি ।” মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করলাম । ছেলেটি আবার
বলল , “ কোথায় গেছিলেন ?” উত্তরে গোকুল সামন্তের কথা বলতেই ছেলেটি অবাক
গলায় বলল , “ ও আপনিও পাখী বুড়োর মত ?” কথাটার মানে বুঝতে না পারলাম না বুঝে
ছেলেটি আবার বলল , “ আপনার হাতে সময় আছে , যাবেন আমার সাথে ?”
নীরবেই এগিয়ে গেলাম বেশ খানিকটা । গ্রামটার উত্তর দিকে গাছে ঘেরা বিশাল জলাশয়
। মাঝে একটা সবুজ অংশ । টলটল করছে জল । ছেলেটি এবার বলল , “ কিছু বছর আগে
এমনটা ছিল না । দীঘিটা প্রায় বেদখল হয়ে গেছিল , ফ্ল্যাট হবে বলে । এবার শীতকালে
এসে দেখবেন কত পাখী এসেছে ।”
আমি জিজ্ঞাসা করলাম , “ কেন আগে আসত না ?” “ আসত , তবে পিকনিক করতে এসে
কত লোক পাখী মারতো । আমাদের গোকুল বুড়োর সাথে ওইসব লোকদের কম ঝামেলা
হয় নি ” ছেলেটি হাল্কা স্বরে উত্তর দিল ।
খানিক দম নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে , “ বুড়োর মাথাটা গেছে । আর যাবে নাই বা
কেন বলুন ? প্রমোটারের গুণ্ডা একদিন গোকুল বুড়োর মাথায় মারল রড দিয়ে । তবে
গোকুল সামন্ত ছাড়বার পাত্র নয় , নিজের জমি জায়গা বিক্রি করে মামলা লড়ে দিঘীর
জমি বাঁচায় ।”
আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলাম । ছেলেটি হেঁসে বলে , “ দাদা , বুড়ো দিব্যি আছে । মাঝে
মধ্যে খেপে যায় ঠিকই কিন্তু মাথাটা গেলেও প্রকৃতির কাছে আমাদের থেকে অনেক
সুস্থ । ওনার মত পাগল আছে বলেই প্রকৃতি সাথে আমরাও বেঁচে আছি ।”
গোকুল সামন্তের কাছে আমি আর যাই নি । ট্রেনে যেতে যেতে দেখলাম একদল পাখী
ডানা মেলে উড়ছে । হয়তো বুড়োর সন্ধানে বেরিয়েছে ।।

No comments:

Post a Comment

আত্মারা যখন অন্য গ্রহে

১ রা তটা এখন বেশ গভীর । টুক করে শব্দ হতেই কান সজাগ হয়ে উঠলো অ্যাটলাসের । মাথার মধ্যে টিঁ টিঁ কী বেশ ক্যাল্কুলেশন করেই এগিয়ে গেল দরজার ...