Sunday 25 February 2018

বাংলা সংগীত-নৃত্যে বিমূর্ততা


Image result for image of indian contemporary dance
যে সকল গানের বাণী অংশ বাংলা ভাষায় রচিত, সেসকল গানের সাধারণ নাম 'বাংলা গান'এই সংজ্ঞার সূত্রে বাংলা গান যেভাবে আদিকাল থেকে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ক্রমবিকাশের ধারায় বিকশিত হয়েছেএমন কোনো নৃগোষ্ঠী নেই যাদের ভাষা এবং গান নেই। উভয়ই যোগাযোগের মাধ্যম। উভয়ই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির অংশ। সুরের ভাব প্রকাশের ক্ষমতা আছে, ভাষার তো আছেই। তবে মাধ্যম ভিন্ন, প্রকৃতিও ভিন্ন। ভাষার সাথে সঙ্গীতের (গীত-বাদ্য-নৃত্য) সম্পর্ক সহোদরার মতো। নিত্য দিনের বাস্তব জীবনের কাজকর্মের ভিতরে যে কথোপকথন বা বর্ণনা শুনতে পাই বা পাঠ করে অনুভব করি, তার ভিতরে রয়েছে মনোজগতের বাস্তব দশা। আর সেই বাস্তব দশাই যখন কল্পনার আশ্রয়ে সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা ইত্যাদিতে উপস্থাপন করা হয়, তখন তা হয়ে যায় মনোজগতের কল্প-বাস্তব নামক দ্বিতীয় স্তরের বিষয়। সুকুমার শিল্পকলায়, বাস্তব জীবনের বিভিন্ন বাস্তব দশাকে উপস্থাপন করা হয় নান্দনিক উপস্থাপনায়। 
যদি বাংলা গানের ভাষার সন্ধান করতে যাই, তাহলে অবশ্যই ৩টি ভাষাকে জানতে বা উপলব্ধি করতে হবে। এই ভাষা তিনটি হলো বাণী, সুর ও ছন্দ। এ ক্ষেত্রে বাণীপ্রধান গানে, গানের অর্থ জানাটা আবশ্যক, কিন্তু না জানলেও গানের আনন্দ নষ্ট হয়ে যায় না। মূলত এক্ষেত্রে গানের আনন্দটা প্রবহমান ধারায় সঞ্চারিত হয় সুর ও ছন্দের যাদুতে। গানের সুর ও ছন্দের প্রকৃতি না বুঝেই অধিকাংশ মানুষ গান শোনে, এমন কি গেয়েও থাকে। তাতে গানের জাত যায় না। কিন্তু জাতেও উঠে না। জাত শিল্পী হতে গেলে, গানকে সকল অর্থে আত্মস্থ করতে হয়। জাত শ্রোতা হতে গেলেও তাই। তাই জাত শিল্পীর পরিবেশিত গান, জাত শ্রোতার মাধ্যমে জাতের গান হয়ে উঠে
সঙ্গীতের পরিচয়
সঙ্গীত যদি হয় গীত, বাদ্য, নৃত্য হয়। তাহলে অনুভবের মৌলিক ক্ষেত্রের বিচারে সঙ্গীত প্রথমেই দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এর একটি হলো শ্রবণের। এই ধারায় পড়ে গীত ও বাদ্য। দ্বিতীয় ধারাটি হলো দর্শনের। এই ধারায় পড়ে  থাকে নৃত্য। নিশ্চয় এ কথা মানতেই হয় যে, সঙ্গীতের এই দুটি ধারায় যে নান্দনিক অনুভূতির জন্ম দেয়, তা দর্শন এবং শ্রবণের সমন্বয়ে পূর্ণতা লাভ করে। বেতারযন্ত্রে এবং রেকর্ডে গান শোনার আগে গীত ও বাদ্য শ্রবণ ও দর্শনের বিষয় ছিল। কিন্তু দর্শন না করেও গীত-বাদ্য শ্রবণ করা যায়। এই কারণে গীত-বাদ্যের মৌলিক মাধ্যম হলো শ্রবণ-যোগাযোগ।  এই বিচারে গীতবাদ্যের প্রকৃতি বিশ্লেষণের মৌলিক ধাপগুলো হলো-
 
  • সত্তা (entity): মানুষ যত ধরনের বিষয়বস্তুকে পৃথকভাবে শনাক্ত করতে পারে, তা এক বা একাধিক শব্দ দ্বারা প্রকাশ করে। এই প্রকাশযোগ্য শব্দ বা শব্দসমূহের সাধারণ পরিচিতি 'নাম'আবার 'নাম' রয়েছে যে কোন  বিষয়বস্তুকে পদপ্রকরণের বিচারে 'বিশেষ্য' হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
    • বিমূর্ত সত্তা (abstract entity): মানুষ এমন কিছু বিষয় অনুভব করে, যেগুলো কোনো বস্তু নয়। যে সত্তাগুলোর ওজন নেই, দেখা যায় না, স্পর্শ করা যায় না, বস্তু জগতে যাকে কোনো জায়গা ছেড়ে দিতে হয় না। এই জাতীয় বিষয়ের বস্তুগত আকার নেই বলেই এদেরকে বিমূর্ত বলা হয়েছে।
      • যোগাযোগ (communication): যে কোনো প্রক্রিয়া বা মাধ্যমের দ্বারা পরস্পরে ভিতরে সংযোগ তৈরি করে।
        • শ্রবণ যোগাযোগ (auditory communication): যে যোগাযোগ ঘটে ধ্বনি এবং শ্রবণেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে
·         বর্তমান আলোচনার প্রধান বিষয় হল সঙ্গীত বিমূর্ত বা Abstract music সাধারণ সঙ্গীত বা Absolute music হল যে সঙ্গীত কেবলমাত্র শিল্পী তাঁর কণ্ঠে ভাষায় ফুটিয়ে তোলেন অর্থাৎ এই ধরনের সঙ্গীতের সাহায্য নিয়ে কোন নৃত্য বা আলেখ্য হয় না । শিল্পীর কণ্ঠস্বর এবং শ্রোতা সরাসরি যুক্ত থাকে । মূলত এই ধরণের বিমূর্ততা সম্পরকে সম্যক ধারনার সৃষ্টি হয় আনুমানিক আঠেরো শতকে জার্মান রোমান্টিসিজম নিয়ে লেখা কাব্যগাথায় । যেমন – উইলিয়াম হেনরিচ , লুড উয়িকটিকের প্রমুখের লেখায় । তবে ১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দে রিচার্ড ওয়াগনার , বিথভেন প্রমুখ Absolute music শব্দটিকে আক্ষরিক অর্থে প্রয়োগ করেন এখানে উল্লেখযোগ্য হল কোন কোন সমালচকগণ Absolute music বা সাধারণ সঙ্গীত এবং  Abstract music বা বিমূর্ত সঙ্গীতকে অনেকাংশে এক দেখেছেন ।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে গীত আর সংগীত সমার্থক নয়গীত যেন সংগীতের অধীন একটা বিষয়।কিন্তু একদিন তারা একার্থক ছিল। কালক্রমে গীত যেখানে ছিল সেখানেই থেকে গেছে। আর সঙ্গীত শব্দটির অর্থবিস্তৃতি ঘটেছে। এ রকম ঘটা অভূত পূর্ব, অসাধারণ বা অযৌক্তিক কিছু নয়। বরং এর প্রয়োজন আছে। কিন্তু এক্ষেত্রে অর্থ-বিস্তৃতির মূলে কাজ করেছে দুটি বিষয়। সহজ ভাষায় দাঁড়ায় , গীত কেবলমাত্র শিল্পীর কণ্ঠস্বর থেকে নির্গত হয় এবং সঙ্গীত বাদ্যযন্ত্র সহযোগে পরিবেশিত হয়ে থাকে ।

বিমূর্ততা কি ও তার উদ্দেশ্য ?
অলৌকিক এর সাথে লৌকিকের সম্পর্কচর্চা থেকে শিল্পের যাত্রা শুরু। পৃথিবীর আদিম মানুষগুলোর ব্যক্তিগত ও সামাজিক আচরণ থেকেই যে শিল্পের উৎপত্তি- তা নিয়ে কোন দ্বিমত নেই। পরবর্তীতে সভ্যতার কালক্রমে চর্চা হতে থাকে শিল্পের ভাবাদর্শ, উদ্দেশ্য ও গন্তব্য। উন্মোচিত হতে থাকে এর স্বরূপ। শিল্প শুধু ব্যক্তি আবেগের অভিব্যক্তি নয় মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয় বা নির্মাণের অনুঘটকও। যে সম্পর্ক এমনই বাংলাদেশের একজন অন্নচাষা আর আফ্রিকার একজন অন্নচাষা কেউ কাউকে না দেখে একে অপরকে অনুভব করে। তারা উভয়েই তো প্রকৃতির মহৎ শিল্পকর্মে নিয়োজিত।  
.
শিল্পকর্ম শিল্পস্রষ্টার ব্যক্তিগত হতে পারে না। তার ভোক্তা হবে সমাজের সকল স্তরের মানুষ। তা না হলে শিল্প তার মাহাত্ম হারিয়ে ফেলবে। সৌন্দর্যহীন হয়ে পড়বে শিল্প। আর শিল্প নিছক বিনোদন কিংবা ব্যক্তিগত অনুভূতি নয় বলে শিল্পের মতাদর্শ, ভাবাদর্শ নিয়ে শিল্পস্রষ্টা ভাবতে বাধ্য হয়। শিল্পী তো শুধু শিল্পী নয়, সে একজন স্রষ্টাও বটে। কারণ শিল্পীর প্রধান দতা হচ্ছে সৃষ্টিশীলতা। যার সাথে আনন্দানুভূতি থাকবে, থাকবে শিল্পস্রষ্টার পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডলের সমূহ দাবী কিংবা আকাক্সা পূরণের সুন্দরতম প্রচেষ্টা। একটি শিল্পকর্ম সমাজের যাবতীয় ভাল, সুন্দর আর সত্যগুলোই প্রকাশ করবে, চিহ্নিত করবে যাবতীয় মন্দগুলো। তখনই শিল্পকর্মটি হবে উৎকৃষ্ট আর উঁচুমানের।  
.
শিল্পচর্চায় শিল্পীরা বিশেষ এক জগতের আশ্রয় নেয়। তাকে যদি বিমূর্ত বলা হয়, তাহলে বিমূর্তের মূর্ত প্রচেষ্টাই শিল্প। সরাসরি মূর্ত একটি শিল্পকর্ম দ্বারা ভোক্তার যে চিন্তার প্রতিফলন কিংবা সামূহিক সমাধান ঘটে তা আরো ব্যাপকতা লাভ করে বিমূর্ততায়। কারণ বিমূর্তর নির্দিষ্ট কোন ভাষা নেই। পৃথিবীর তাবৎ জনগোষ্ঠী যে কোন ভাষায় বিমূর্ত শিল্পের অর্থ উদ্ধার করতে পারে। সেই সাথে যোগাযোগ ঘটে সকল শিল্প ভোক্তার। 
.
বিমূর্ততা এমন এক জগৎ, যা দ্বারা শিল্পী অযাচিতভাবে তার শিল্প সৃষ্টিতে আচ্ছন্ন থাকে। এ জগতের সাথে শিল্পীর দৈহিক যোগাযোগ না ঘটলেও আত্মিক যোগাযোগ তো আছে। যোগাযোগ আছে বলেই সমূহ বিমূর্ত মূর্ত হয়ে উঠে বিমূর্ততায়। শিল্পী তার শিল্পকর্ম সৃষ্টিতে সুখানুভূতি পায় ভিন্ন এই জগতের অস্তিত্বকে লালন করে বলে। .
এই অলৌকিক জগতের সন্ধান করতে গিয়ে তো এক পর্যায়ে শিল্পচর্চার শুরু। ধর্মের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটেছে। যার কারণে শিল্পী ও স্রষ্টা আর শিল্প ও সৃষ্টির মধ্যকার সম্পর্ক নির্ণয় করতে কোন সমস্যায় পড়তে হয় না। স্রষ্টার সৃষ্টি-ভাবনা যেমন মৌলিক, ঠিক একইভাবে শিল্পীর শিল্পভাবনাও। যে ভাবনা কারো খেয়াল-খুশিতে তৈরী হয় না, হয় বিশেষ একটা উদ্দেশ্যে। 
.
সঙ্গীতে ( মিউসিকে ) বিমূর্ততার ব্যবহার -
দর্শনেন্দ্রিয়র প্রাধান্যের বাইরে গিয়ে সঙ্গীত যে বিমূর্ত স্বরমূর্তি নির্মাণ করে, সুর ও শ্রুতির যে মোহন জগত রচনা করে, যে ঐন্দ্রজালিক অভিক্ষেপ ফেলে শ্রোতার হৃদয়ে, তা-ই সঙ্গীতকে আলাদা করে অন্যান্য শিল্পমাধ্যম ,বিনোদন ও সাংস্কৃতিক উপাদান থেকে। ইতিহাসের সাথে নিজেকে যুক্ত করবার, অনুভুতির পাটাতনে মানুষে মানুষে ঐক্যসুত্র গড়বার  ও সমাজের অপরের সাথে মিলবার সচেতন বা অবচেতন প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রনয়ন ও প্রকাশের যে আদিম তাগিদ তা থেকেই কাব্যের বা সঙ্গীতের উদ্ভব। আড়াই হাজার বছর আগে এরিস্টটলের মুখ থেকেও আমরা শুনেছি সুর ও ছন্দের প্রতি মানুষের সহজাত আকর্ষণের কথা
 সঙ্গীত মনকে  আন্দোলিত করে এবং মনের প্রবল ভাবকে উত্তোলিত করে। তাই আমরা বলি, আত্মার সাথে ভারসাম্যপুর্ণ সঙ্গীতের সম্পর্ক আল্লার এটি গুপ্তভেদ।  কতক সঙ্গীত দ্বারা প্রফুল্লতা সৃষ্টি হয় এবং কতক সঙ্গীত দ্বারা বিষাদ ফুটে উঠে।  কোন কোন সঙ্গীতে হাসির উদ্রেক হয়। কতক সঙ্গীতের প্রভাবে মানুষের হাত, পা,মস্তক আন্দোলিত হয় । এরূপ ধারনা করা ঠিক নয় যে,এটা বাক্যের অর্থ হৃদয়ঙ্গম করার কারনে হয় ,তারের ঝংকারেও এরূপ হয়ে থাকে।কচি শিশুর মধ্যেও এ বিষয়টি পাওয়া যায়। যখনই তাকে সুললিত স্বরে ঘুম পাড়ানী গান শুনানো হয়,তখনই সে কান্না ছেড়ে চুপ হয়ে যায় এবং সুরধবনি শুনতে থাকে ।অথচ সে কোন অর্থ বোঝে না। 
নৃত্যে বিমূর্ততার প্রয়োগ সংক্ষিপ্ত আলোচনা -
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে , ভারতীয় ষড়ঙ্গ বা নন্দনতত্ত্ব (এটাকে বৈদিক নন্দনতত্ত্ব বলাই যৌক্তিক) শিল্পের যে সীমানা বর্ণনা করে সেখানে চিত্রকলা, সাহিত্য, নাটক, সঙ্গীত, ক্রীড়া ইত্যাদি ১৮ রাজ্য নিয়ে শিল্প রাষ্ট্র। এবারে আমরা আলোচনা করি নৃত্যে এই বিমূর্ত (abstract) ভাবের ব্যবহার তথা নৃত্যে বিমূর্ততা বলতে কি বোঝায় ।
ভারতীয় মার্গীয় নৃত্যের একটি নিজস্ব ভাষা আছে, যেটা আমাদের পরিচিত বাচিক যোগাযোগের ভাষার মতই নিয়মে বাঁধা। একেকটি শব্দের মত একেকটি মুদ্রার কিছু মানে রয়েছে। আর এই মুদ্রাগুলির অন্তত মৌলিক একসেট মুদ্রার অর্থ বেশ চিত্রানুগ। যেমন হরিণের মুদ্রায় তিনটি আঙুল জুড়ে হরিণের সরু মুখটি আর দুপাশে দুটি আঙুল দিয়ে কান উঠে আছে, সাপের মুদ্রায় ছোবল ইত্যাদি । অপরপক্ষে ভারতীয় কনটেম্পরারি নাচের এক্সপ্রেশনে নানা রস উঠে আসে, কিন্তু ভালো গুণ মানসম্পন্ন হাস্যরসের কিছু অভাব কিছুক্ষেত্রে থাকেএর একটা কারণ হতে পারে, যে ভারতের মার্গীয় নৃত্যশাখার সুগভীর শিকড়ের তুলনায় এই বিষয়টা সবে বিস্তৃত বা স্বীকৃতি পেতে শুরু করেছে। কনটেম্পরারি নাচ বলতে যদি শারীরিক বিমূর্ততা বুঝি, ক্লাসিকাল নাচের কাহিনিধর্মিতার তুলনায়, তাহলে সেই বিমূর্ততার রসটি অনেকাংশে ভাব গাম্ভীর্য্যের
ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যেও বিমূর্ততা শিল্পী মননে সুন্দর ভাবে দর্শকের চোখে মূর্ত হয়ে ওঠে । এ প্রসঙ্গে নৃত্য গুরু বিরজু মহারাজ মনে করেন যে , নাচকে বলা হয় আত্মার স্বচ্ছন্দ আন্দোলন। শাস্ত্রীয় নৃত্যের ভাষা সেখানে কোনো বাধা তৈরি করে না বিরজু মহারাজ উদাহরণ দিয়ে দেখান, কত্থকের ভাষাতেই তিনি কীভাবে দপ্তরে বন্দী একটি ফাইলের কাহিনি বলেন, কীভাবে জীবন দেন একটি লৌহখণ্ডকে। তাঁর কথায়, বিমূর্ততায় তিনি যেকোনো কিছুই বলতে পারেন। ভাষা সেখানে কোনো বাধা নয়।
বাংলা নাটকে নৃত্য-সঙ্গীত সমন্বয়ে বিমূর্ততা একটি অতি সংক্ষিপ্ত আলোচনা
পূর্বের সকল আলোচনা থেকে এটা আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে , বিমূর্ততা এবং সেই পরিমন্ডল দর্শক-পাঠককুলের কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রধান দায়িত্ব মূলত নির্ভর করে শিল্পীর প্রয়োগ রীতির মাধ্যমে । যেমন এই পরিচ্ছেদে আমরা বাংলা নাটকে একসাথে সঙ্গীত ও নৃত্য রবীন্দ্রনাথের “রাজা” নাটক অবলম্বনে প্রখ্যাত নাট্য ব্যক্তিত্ব শম্ভু মিত্র আধুনিক ভাবে বিমূর্ততা তথা রূপকের মাধ্যমে প্রয়োগ করেছিলেন তা জেনে নেব । মূল নাটকে যাবার আগে শম্ভু মিত্রের এ ব্যাখ্যাটি খুঁটিয়ে শুনলে হয়ত বোঝা যাবে, রাজা কে এই  এখন, আশি দশকের শেষদিকে শ্রীমিত্র কীভাবে দেখতে চান। অন্ধকারের উপলব্ধি রবীন্দ্র রচনায় ছড়িয়ে আছে গভীর বুনটে। রাজা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ৪৯ বছরে পা দিয়ে, তাঁর আশি বছর ব্যাপ্ত জীবনের মধ্যপর্বে। এই নাটকের বিমূর্ত অন্ধকারের তাৎপর্য উপলব্ধি করা যায় আগে-পরের নানা অধ্যায়ে অন্ধকার সম্পর্কে তাঁর ভাবনার বিবর্তনে।
অন্যদিক থেকে বিচার করলে কেউ একে বিংশ শতাব্দিরই শেষ পর্বে আমাদের দেশের দলিলচিত্র হিশেবে দেখতে পারেন। দেশজুড়ে যেন অভিনীত হচ্ছে রাজা-রই সাব-প্লট, যেখানে সুবর্ণ-কাঞ্চী-কোশল-অবন্তী রাজাদের মত ভন্ডরাজে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে আমাদেরই জীবনের একটা তল। সুবর্ণকে রাজা বানিয়ে কাঞ্চী-কোশল-অবন্তীরাজরা যখন বলেছিল, ‘তোমাকেই আমরা এখানকার রাজা করে দিচ্ছি- পরিহাসটা শেষ করেই যাওয়া যাক’, যখন বলেছিল, ‘তোমার সাধ্যের উপর ভরসা নেই , আমাদের বুদ্ধি মত চলতে হবে,’ তখন সেই সাব-প্লট, আমাদের এখনকার বাস্তবতার রণনে সমৃদ্ধ হয়ে, যেন অনেক বেশি অর্থময়। 
 এই নাটকে শম্ভু মিত্র-র এক ভাষ্যের পরই সমবেত গান মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে তাতাথৈথৈ, তাতাথৈথৈ, তাতাথৈথৈ।যে নৃত্যময় অনির্বচনীয়কে, বিমূর্তকে নিজের ভেতর উপলব্ধি করতে চায় সুদর্শনা, তার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে যা বেজে চলে মৃদঙ্গের মত, সেই নিনাদ তো এক অর্থে আমাদের বেঁচে থাকারই ধ্বনি, যে ধ্বনির ছন্দে আমরা যুক্ত হই ইতিহাসে, শব্দে, প্রকাশের বিহ্বলতায়, রোমাঞ্চে। মায়াকোভস্কি একেই বলেছেন ইতিহাসের ধ্বনিমালা‘gradually from this rumbling one begins to squeeze out single words.’
পরিশেষে লিখতে হয় যে , ভাষার কাজ যত না প্রকাশ করা তার চেয়ে অনেক বেশি হল আড়াল করা। এ ভাষা নৃত্যের অর্থাৎ নৃত্য একটি  ভাষা, তার মধ্যে শরীর ভঙ্গির ভেদ বিচার করে, এক একটা ধরণ নির্ণয় করে আমরা তার নানা রকম নাম দিয়েছি। বাক ও লেখ্য, মানে যাদের আমরা সাধারণত ভাষা বলে বুঝে থাকি, তাদের সঙ্গে নাচের একটা মূলগত তফাত আছে। ভাষার প্রকাশিতব্য সীমাবদ্ধ। আমরা মুখে ধ্বনি তৈরি করি, সে ধ্বনিকে এক একটা সংকেতে চিহ্নিত করি, পরস্পরের মধ্যে সেই সংকেতের গ্রহণযোগ্যতা স্বীকার করি, তার পর গিয়ে তৈরি হয় অর্থ। আর সেই অর্থের গুণেই ধ্বনি শব্দ হয়ে ওঠে। লেখার ক্ষেত্রেও কালির আঁচড়ে কয়েকটা সংকেতকে এভাবে চিহ্নিত করে নিতে হয় আমাদের। কিন্তু এই সব সংকেত বা শব্দ অর্থনিরপেক্ষ ভাবে বক্তা বা রচয়িতার উপস্থিতির দ্যোতক হয়ে উঠতে পারে কি? নাচ কিন্তু পারে। এক্ষেত্রে আমি মুদ্রার মাধ্যমে কোনও একটি ভাব প্রকাশের কথা বলছি না। সেটাও ওই মুখের বা লেখার ভাষারই সামিল, নর্তক ও দর্শকের মধ্যে একটা বোঝাপড়া দাবি করে তা। কিন্তু না, নাচের মূল ভাষাটি হল উপস্থিতির। যে নর্তক শরীরকে আমরা দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে তার মাধ্যমে ছন্দ ও ভঙ্গিকে ধরে রাখার একটা বিমূর্ত প্রক্রিয়া, যা পূর্বনির্দিষ্ট বোঝাপড়া ছাড়াই পৌঁছে দিতে পারে অর্থ, দ্যোতনা ।


No comments:

Post a Comment

আত্মারা যখন অন্য গ্রহে

১ রা তটা এখন বেশ গভীর । টুক করে শব্দ হতেই কান সজাগ হয়ে উঠলো অ্যাটলাসের । মাথার মধ্যে টিঁ টিঁ কী বেশ ক্যাল্কুলেশন করেই এগিয়ে গেল দরজার ...