Thursday 8 February 2018

এবারে ২০ শে বিষ

Related image ১

কয়েকদিন একনাগাড়ে বৃষ্টির পর আজ ১৯ তারিখ একদম ঝকঝকে নীল
আকাশ । মাঝে পরীক্ষা থাকার জন্য টুটুন আর বেরোতেই পারে নি মামার
সাথে । “ থিম্পু গুহা রহস্য”-এর পর মা আর বেঁকে বসেন নি , তাই এবার
দ্বিতীয়বার মামার সাথে সোজা হ্যাভলকে । খানিক চুপচাপ বসার পর টুটুন
মামার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, “ ধুস , একেবারে নিরামিষ জার্নি ।” মামা
অমলেট খাওয়া থামিয়ে হেসে ওঠে । “ ওমা , তুই আবার আমাদের গোয়েন্দা
কবে থেকে ভাবতে বসলি রে ”, মামা ফুট কাটে ।
এটা ঠিক গতবারের টানটান অভিজ্ঞতা সত্যি ভুলবার নয় । তবে মামা
সেটাকে কাকতালীয় ছাড়া কিছুই ভাবে না । নিজে লেখক মানুষ , মাঝে মধ্যে
অবশ্য নিজেই বলে , “ বুঝলি কিনা টুটুন এমন ঘটনা ঘটলে লেখার খোরাক
আপনি জুটে যায় ।”
কতাবার্তার ফাঁকে ডলফিন গেস্টহাউসের ম্যানেজার একটা ছোট্ট খাম দিয়ে
গেল । মামার মত আমিও অবাক । খাম খুলতেই এক চিলতে কাগজ । মামার
ভ্রূ কোঁচকানো । পড়া শেষে বলে ওঠে , “ কোন বেরসিক কবির কবিতা ।”
লেগপুল করতে কার না ভাল লাগে , মামাকে বললাম , “ এখানেও তোমার ফ্যান
!” হাত থেকে চিলতে কাগজটা নিয়ে যখন আমি পড়লাম খানিকটা থতমত খেয়ে
গেলাম । বাচ্চাদের মত হাতের লেখা , তার উপর আবার ছড়া –

“ ২০ শে দেবে বিষ ।
দিচ্ছি হদিস –

লাইটের তলায় ,
পূর্ণ একে সমাগম হয় ।”

আমার দিকে মামা তাকিয়ে আছে । বুঝলাম আমার মত মামার মাথার উপর
দিয়ে অর্থ বেরিয়ে গেছে ।



তথাগত’দাকে দুপুরের লাঞ্চে মামা কখন বলে রেখেছে জানা ছিল না ।
উত্তরবঙ্গ অভিযানে এই তথাগত রায়ের ভূমিকা ভুলবার নয় । দাদাকে
এখানে দেখেই চমকে উঠলাম । মামা সাদরে অভ্যর্থনা করল । আমি বললাম ,
“ আপনি মানে তুমি এখানে ...!” “ হ্যাঁ , ভাই এক বছর হল পোর্টব্লেয়ারের
সিনিয়র ফরেস্ট রেঞ্জার হয়ে বদলি ।” কথায় কথায় ভারতের ঠিক
দক্ষিণপূর্বে তিনশোর বেশী খন্ড খন্ড দ্বীপ নিয়ে গঠিত আন্দামানের
গল্পে মশগুল হয়ে গেলাম । মজার বিষয় এখানকার অধিকাংশ দ্বীপের
অফিসিয়ালি আবিষ্কর্তা ব্রিটিশরা আর তাই তাদের নামেই দ্বীপের
নামকরণ ।
তথাগত’দা মামাকে বললেন, “ দাদা কাল ভরা পূর্ণিমা । গেস্টহাউসের থেকে
হ্যাভলকের সমুদ্রতীরে রাত কাটান , দারুন অনুভুতি...লাল কাঁকড়া বেরোয়
ভরা জ্যোৎস্নায় ।” কথাটা শুনে আমি দারুন উত্তেজিত হয়ে উঠলাম । মনে
মনে থ্যাংকস জানালাম ।
মামার মুখও উজ্জ্বল । আংশিক লেখক ভাব যেন আস্তে আস্তে জেগে উঠছে
। নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে অস্ফুট গলায় গেয়ে ওঠে –
“ আজি জ্যোৎস্না রাতে...।” গুনগুন করে খানিক গাওয়ার পর তথাগত’দা আর
আমার দিকে ফিরে বলে “ আচ্ছা তোমরা সেই ছেলেবেলার এক থেকে দশের
গুনতিটা জানো ?”

আমি ইংরাজি মিডিয়ামের । তথাগত’দা হেসে বললেন “ না জানার কি আছে
দাদা । ওই তো একে চন্দ্র , দুয়ে পক্ষ...।” মামা পুরোটা শুনলেই না , তার
আগেই বলে উঠল , “ সুনামির পর আমি এখানে এসেছিলাম । স্থানীয়
ক্ষয়ক্ষতি তো হয়েছিলই তারসাথে নষ্ট হয়েছিল সমুদ্র তলদেশ ।”
তথাগত’দা মাথা নেড়ে সম্মতি জানান । আমি নিশ্চুপ । মামা এসব বলতে শুরু
করলো কেন কে জানে ! একবুক নিঃশ্বাস নিয়ে আবার বলে , “ বুঝলে তথাগত
মানুষের লোভের উপর কত আর নিষেধাজ্ঞা চাপাবে , যত চাপানো হবে ততই
বাড়বে ...।”
বেলা চারটে নাগাদ সরকারী বোটে করে পোর্টব্লেয়ারের দিকে রওনা দিলেন
দাদা । যাওয়ার আগে মামা তথাগত’দাকে বললেন, “ রাতে একবার তোমায়
ফোন করব , কথা আছে আর পারলে কাল-পরশু একটু ফ্রি থাকার চেষ্টা কর
।”
মামার মতিগতি দেখে কেন জানি না মনে হল কিছু একটা ঘটতে চলেছে । রাতের
খাওয়া সেরে দুজনা সামনের খোলা ব্যালকোনিতে দাঁড়ালাম । অদূরে ঢেউয়ের
মাথায় ফসফরাস চিকচিক করছে । রাতের অন্ধকার ঠেলে বহুদূর থেকে
জাহাজের ভোঁ সাইরেন । মামা আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো , “ বলত
, রাতে জাহাজের পথ দেখায় কে ?”
“ লাইট হাউস ।”



এখানে মিশ্র সংস্কৃতি , মিশ্র ভাষা । তার ইতিহাসও আছে । মামার যেহেতু
লেখার স্বভাব তাই রাতের দিকে দুধ ছাড়া চা খায় । এক মাত্র বেয়ারা , নাম
প্রভু , পূর্বপুরুষ বাংলাদেশী । তাকে ডেকে মামা চা দিতে বলল । ছেলেটি বেশ
মিশুকে । নানা গল্প শুরু করল মামা । ছেলেটি মামাকে বলল , “ ছ্যার বিশ টহা
আছে ?” বিশ টহা মানে কুড়ি টাকা । মামা চোখ গোল করে বলল, “ তা আছে ।”

“ দ্যান ।” আমি ওদের দিকে তাকিয়ে থাকলাম । ছেলেটি লাল কুড়ি টাকা হাতে
নিয়ে বলল , “ ছ্যার টহাটার উল্টা দিহে দ্যাখেন ।” দেখলাম, কিছু জঙ্গল
আর ...। মামা ছোঁ মেরে ভাল করে দেখেই উৎফুল্ল হয়ে ছেলেটির পিঠ চাপড়ে
বলে উঠলো “সাবাস” । মোবাইলের বোতাম টিপে ফোন করে কি যেন বেশ বলল
তথাগত’দাকে ।
সেই রাতে অনেকক্ষণ হা করে তাকিয়ে থাকলাম মামার দিকে । মামা শুধু বলল
, “ টুটুন প্রবাল চোর বুঝলি...।” ব্যাস আর হাজারও খুঁচিয়ে মামার ঝুলি থেকে
বিশেষ কিছু বার করতে পারলাম না ।


কথা মত সকাল দশটার মধ্যে হ্যাভলক ছাড়লাম । প্রভু হাতে হাতে আমাদের
কিছু জিনিষ তথাগত’দার সরকারী বোটে তুলে দিল । নীল জলরাশি চিরে এগিয়ে
চলল তীব্র গতিতে । বাঁ পাশে ক্রমশ বিন্দুতে পরিনত হতে লাগল নেল-
হ্যাভলক আইল্যান্ড । বেশখানিক্ষণ পর দাদা মামাকে কাজের হিসাব দিয়ে
বললেন, “ দাদা যা বলেছিলেন সবই রেডি । ইন্সপেক্টর শ্রীনিবাসন লোকজন
নিয়ে টুরিস্ট হিসাবে থাকবেন ।” মন দিয়ে শুনল বটে কিন্তু মামা চুপচাপ ।
ঠিক এই সময়ে আমাদের বোটের ডান পাশ দিয়ে আরেকটি বোট গর্জন করতে
করতে বেরিয়ে গেল । অদ্ভুত চিন্তাহীন গলায় মামা বলল, “ অবাক হওয়ার
কিছু নেই ,নেল আইল্যান্ডেরও হতে পারে ।” কিন্তু তথাগত’দার কপালে ভাঁজ
পরলো ।
পোর্টব্লেয়ারে এসে মামা একবারই আমাকে শুধু বলল, “ টুটুন ছড়াটা আর
যেমনই হোক , বুদ্ধির বুঝলি আর হ্যাঁ শোন পারলে বাজার থেকে একটা চিলি
স্প্রে কিনিস কাজে লাগবে ।” মুখে প্রশ্নের ছাপ উঠতেই মামা ঠোঁটে আঙুল
দিয়ে চুপ থাকতে ঈশারা করল ।



রস আইল্যান্ডকে ডান পাশে রেখে উত্তর-পশ্চিম দিকে আমাদের বোট প্রায়
মাঝ সমুদ্রে দাঁড়িয়ে পড়ল । সিঁড়ি বেয়ে আমরা নামলাম একটা স্থানীয়
নৌকায় । শ্রীনিবাসন আর তার লোকজন অন্য একটিতে ।
সূর্য কিছুক্ষণ আগেই ডুবে গেছে । স্থানীয় একটা দুটো বাসিন্দার ঘরে
টিমটিমে আলো । ম্যাপ বার করে মামা আর আমরা পূর্ব নির্দেশ মত
এগোলাম দ্বীপটার ঠিক উত্তরপূর্ব দিকে লাইটের হাউসের দিকে ।
অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে থাকলাম । এখানেও মশাদের হাত থেকে নিস্তার নেই
। আকাশে ভরা পূর্ণিমা । কিন্তু অনেকক্ষণ বসে থেকেও লাভ হল না ।
সুতরাং খানিকটা নিরাশ হয়ে ফিরতে শুরু করলাম । তথাগত’দা আর আমরা
কিছুটা এগিয়ে যাই । মামা ধীর পায়ে এগোচ্ছে । হাল্কা আলোয় বুঝলাম মামার
মনে ঝড় ।
-“ হ্যান্ডস আপ মিঃ লেখক , বহত হুয়া এখন মরতে হবে ” , গলাটা শুনেই
পিছন ফিরে তাকালাম । একি ! এ যে চ্যাং ! ভেম্পু গুহায় জ্বালিয়েছিল ! আমরা
এগিয়ে আসতেই দাত খিঁচিয়ে বলে উঠল, “ গো ব্যাক , আই উইল কিল হিম ।”
দেখি মামার মাথায় ঠাণ্ডা পিস্তল ঠেকানো । মামা আমাদের পিছনে থাকাতেই
কোন ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আগের অভিযানের প্রতিশোধ নিতে
এসেছে । মাথাটা গুলিয়ে উঠল । আমার হাতটা অলক্ষ্যে জিনসের পকেটে রাখা
স্প্রেতে ঠেকল । মামা নির্বিকার । আশ্চর্য মানুষ । মামা শুধু বলে উঠল
শান্ত গলায় , “ চ্যাং ইউ আর ডুইং রঙ এগেন ।” সকলের চোখের আড়ালে
আমি একটু একটু করে এগোতে লাগলাম উত্তরবঙ্গের সেই কুখ্যাত চিত্র
চোরের দিকে । আলোআঁধারিতে কাছে এসেই চ্যাং-এর মুখে সোজা লঙ্কা
স্প্রে । “ বাপস” বলে মুখ ঢেকে বসে পড়তেই বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পরে
শ্রীনিবাসন আর তার দলবল । আকস্মিক সমুদ্রতীর থেকে সোরগোল ভেসে
এল । মামা সহ আমরা ছুটে গেলাম জলের দিকে । চারিদিকে ফ্লাড লাইটের

আলো । মাছকে যেমন জল থেকে তোলে ঠিক তেমনই গোটা চারেক লোককে
জল থেকে তুলছে নেভির লোকজন । কাজ শেষ । সবকটাকে পিছ মোরা করে
তোলা হল পুলিশের নৌকায় । যাওয়ার আগে চ্যাং গোঙাতে গোঙাতে বলে গেল ,
“ আই উইল সি ইউ...।”



হ্যাভলকের সকাল । মিষ্টি হাওয়া । পুলিশ আঙ্কেল , দাদা আর আমি ঘিরে
ধরেছি মামাকে । প্রভু চা নিয়ে এসেছে । মামা প্রভুর দিকে সস্নেহে তাকিয়ে
বলল, “ তোমাগো জন্যেই দ্বীপটা বাঁচল ।” আমরা তাকিয়ে আছি ফ্যালফ্যাল
করে । মামা হেসে বলল , “ প্রথমে আমিও বুঝিনি । আসলে ধাঁধাঁটায় ‘বিষ’
কিছু না , জাস্ট সতর্কতা । গত পড়শু তথাগত যখন বলল ২০ তারিখ পূর্ণিমা
আর প্রভু ওই কুড়ি টাকার নোটের কথা বলতেই ধীরে ধীরে জট খুলল ।”
আমি জানতে চাইলাম “ কেমন করে ?”
“ আরে , অনেকেই জানেন না কোরাল আইল্যান্ডের স্থানীয় নাম বিশ
আইল্যান্ড । লাইট হল লাইট হাউস আর একে কি হয় ?” বলে মামা ভ্রূ
নাচালো ।
তথাগত’দা বলে উঠল, “ একে চন্দ্র । পূর্ণ এক মানে পূর্ণিমা । অর্থাৎ
পূর্ণিমার রাতে লাইট হাউসে জমায়েত হবে আর বিশ আইল্যান্ড থেকে
কোরাল চুরি করবে ।”
“ ব্র্যাভো ” বলে উল্লসিত হল মামা ।
শ্রীনিবাসন বললেন “ কিন্তু কে আর কেন আপনাকে জানালো চিরকুট দিয়ে ?”
উত্তরে মামা প্রভুর দিকে তাকিয়ে বললেন , “ প্রভু কিছু কইবা , তোমাগো
হাতের ট্যারাব্যাকা উল্কি কী কয়?”

প্রভু হাউমাউ করে কেঁদে উঠল । মামা অর পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, “ অর কিছু
দোষ নেই । আমরা এখানে আসার আগেই চ্যাং এখানে আসে আর আমাকে
দেখতে পেয়েই জাগে বাঁদরামি বুদ্ধি । ওই প্রভুকে দিয়ে ছড়াটা লেখায় , জানায়
আমাকে খোলা চ্যালেঞ্জ । ভাবতে পারে নি ধরা পরে যাবে তোমাদের কিছু
কিছু কথায় ।” কথা যেন ফুরাতে চায় না । আমি জিজ্ঞাসা করলাম , “ কিন্তু
বাকী লোকগুলো ধরা পড়ল কীভাবে ?”
“ ওটার কৃতিত্ব পুরোটাই যাবে শ্রী আর তথাগতর উপর । আমার কথা মত
ওই প্রবাল চুরি ঠেকাতে নেভিকেও জানিয়ে ফাঁদ পেতে রেখেছিল জলে ।”
এখন রাত । মামা আমার পাশে দাঁড়িয়ে । বলল , “ আগের বারের মত এবারও
তোর জন্যই বেঁচে গেলাম রে ।” “ মামা একটা কথা বলব ?”
“ বল ।” “ ওই বোটটা কাদের ছিল ?” মামা নীরবে আমার দিকে তাকিয়ে বলল ,
“ চ্যাং –এর সঙ্গীদের , আমরা আসছি কিনা কনফার্ম করার জন্য ।” আমি
আর এরপর কথা বলি নি । ভরা পূর্ণিমায় প্রকৃতির কোলে কথা বলতে
থাকলাম আর আমার ভবঘুরে মামার উদ্দ্যেশে মনে মনে বললাম “ ইউ আর
গ্রেট ।।”
Image result for pencil sketch of  full moon in island

No comments:

Post a Comment

আত্মারা যখন অন্য গ্রহে

১ রা তটা এখন বেশ গভীর । টুক করে শব্দ হতেই কান সজাগ হয়ে উঠলো অ্যাটলাসের । মাথার মধ্যে টিঁ টিঁ কী বেশ ক্যাল্কুলেশন করেই এগিয়ে গেল দরজার ...