১
“আরে বাবা বউটা
তো দিব্যি গোছানো , সংসারী ! হঠাৎ হাওয়া হয়ে গেল কটা দিনের মধ্যে !” ড্রয়িং রুমে
বসে কথাগুলো বলছিলেন ভবানীবাবু একমাত্র তার সঙ্গী ফিডোকে । উপায় নেই ! ছয় বছরের এই
পোস্যটি প্রথমদিন থেকেই চুয়াত্তর বছরের
সবুজ বৃদ্ধকে সাথ দিয়ে চলেছে । আজকাল খুব একটা একা লাগে না নিজেকে । আগের
থেকে অনেক বেশী মনে প্রানে তরতাজা হয়ে উঠেছেন , গায়েও আজকাল একটু বল পান । ভাগ্যিস
ছেলে মনে করে ওষুধের হোম ডেলিভারির ব্যবস্থাটা পাকা করে দিয়েছে ! ফিডো বেশ চালাক
চতুর । দুষ্টুমি করলেও ভবানীবাবুর সব কথাই শোনে । বোঝাই যায় মগজে কিছু আছে ,
ফিলিংসটাও চমৎকার । বছরে একবার ছেলে আসলে ওর জন্য যা করবার করে দিয়ে যায় ।
হাতের থেকে
ই-ম্যাগটা সরিয়ে উঠলেন ভবানী বাবু । রাগ বলে বস্তুটিকে অনেককাল বিদেয় করলেও মাঝে
মধ্যে ক্ষোভটা উঁকি মেরে ফোঁস ফোঁস করে এখনও । শালা , এটা এখনও গেল না , নারী
নির্যাতন । এসব ভাবতে ভাবতে নিজের বেডরুমে ঢুকলেন । পরিপাটী করে
সাজানো বিছানা । এত পরিপাটী সহ্য হয় না । যাইহোক , বিছানায় শরীরটাকে এলিয়ে দিতেই
ফিডোও একলাফে পাশেই গুটিসুটি মেরে শুয়ে পরে ।
বয়সের আরেক পরম ধর্মের মত ইনসমনিয়া ঘাড়ে এসে ঠিক বসে পরে । এর উপায় অবিশ্যি
ভবানীবাবু চমৎকার ভাবে বার করেছেন । সন্ধ্যে হলেই দু-এক পেগের সাথে হাল্কা কিছু
খেয়েই বিছানায় টানটান শুয়ে পড়েন । সঙ্গে চলে নানান মজাদার চিন্তার বুনোন । কোন
ফাঁকে টুক করে পাতা দুটো ভারী হয়ে আসে ! ফিডোও আজকাল এই অভ্যাসটা দিব্যি আয়ত্ত্ব
করেছে । তবে ও সতর্ক সর্বদাই ।
আজরাতে বিছানাতে শুয়েও মাথার মধ্যে নানা চিন্তা কিলবিল করে উঠছে । সকালের
খবরটা কেন জানি না মনের মধ্যে উঁকি মেরে যাচ্ছে । একটি সংসারী প্রবাসী মেয়ে হঠাৎ
করে হাওয়া হয়ে যাওয়া নতুন কিছু নয় । নতুনত্ব হল মেয়েটিকে পাহাড়ের খাঁদ থেকে ধাক্কা
মেরে ফেলে দিয়েছে তারই এক পরিচিত । স্থানীয়দের কাছ থেকে সংবাদপত্র যেটা খবর নিয়ে
নিয়েছে , তাতে নাকি এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে মেয়েটি তার স্বামীর সাথেই বেড়াতে গিয়েছিল
। আজকাল পুলিশ এত আধুনিক হওয়া সত্ত্বেও আসামীকে ধরতে পারে নি !
অনেকেদিন পর রাতের মৌতাত না জমাতে উঠে পড়লেন ভবানীবাবু । ড্রেসিং গাউনটাকে
ভালো করে জড়িয়ে চললেন তার একদম পার্সোনাল স্টাডি রুমে , যেখানে অন্য কারোর তো
দূরের কথা ফিডোরও প্রবেশ নিষিদ্ধ । বহুবছর ধরে ওই ঘড়টাকে নানা সরঞ্জামে ঠেসে
রেখেছেন । নানা সব বৈজ্ঞানিক জিনিষপত্র । আস্ত এক নর কঙ্কাল থেকে শুরু করে বুন্সেন
বার্নার ।
ঘড়ের মধ্যে ঢোকার আগেই অটো স্ক্যানার বিপ্ করে হাল্কা সবজেটে আলো ছড়িয়েই
নিভে গেল । আস্তে আস্তে দরজাটা খুলে যেতেই ভিতরে প্রবেশ করলেন ভবানীবাবু । এটাও তার
আবিষ্কারের মধ্যে অন্যতম । মান্ধাতার আমলের বায়োমেট্রিকের বদলে এটি হাল আমলের নব সংস্করণ ।
আবার যে কেও ইচ্ছা করলেই ঢুকতে পারবে না এই রুমে ।
আজ একটু অন্যরকম হল । প্রতিদিনের মত যেমন ঘড়ে এসেই কোণায় রাখা চেয়ারটাতে
খানিক্ষন বসে কাজ শুরু করতেন । আজ তেমনটি না করে সেলফ্ থেকে একটা কাল্চে মলাট
দেওয়া বই বার করলেন । মলাটের উপর প্রায় রঙ ওঠা নামটা আজও কষ্ট করে অস্তিত্ব রেখে
চলেছে । ‘ WINGS ’ এর মধ্যে চোখ বোলাতে বোলাতে এক জায়গায় এসে থেমে যান তিনি । লেখা আছে
পাখিদের হাড়ের ঘনত্ব 0.3g/cm3
আর মানুষের সেখানে 1.5g/cm3 কিন্তু তার জন্য চাই 20 স্কোয়ার ফিট আর ওজন হতে হবে 170 lb ! লেখাগুলো পরে নিজের মনেই বিড় বিড় করতে করতে দেওয়ালের একপাশে ঝোলান
কঙ্কাল্টার দিকে এগিয়ে গেলেন । পাকা ভ্রূ জোড়া কুঁচকে এলো তার । গভীর ভাবে বুঝবার
চেষ্টা করলেন । টেবিল থেকে লম্বা কাঠের স্কেলটা নিয়ে মাপতে লাগলেন কঙ্কালটার
স্ক্যাপুলা অঞ্চলটাকে । আবার তার স্কেল মাপ নিল হিউমেরাসের অংশটা । নেশটা কোন ফাঁকে তার ছুটে গেছে । চেয়ারে বসেই জটিল এক
গাণিতিক হিসাবের সাথে ফুটে উঠলো অদ্ভুত সব হাড় গোরের ছবি তার খাতায় । দেওয়ালের ঘড়ি
টুক টুক করে এগিয়ে চলেছে । তাকাতেই দেখলেন রাত ৩টে প্রায় ছুঁই ছুঁই । ভোর বেলার ঘুমের এক অমায়িক স্পর্শ আবার ফিরে এসেছে ।
মুখে একটা অজানা হাসির রেশ । সঙ্গে , চোখের কোণায় অজানা এক সন্দেহের ছাপ
স্পট । বেড়িয়ে আসলেন ঘড় থেকে । একেই বলে প্রভু ভক্ত ! দরজার ওপাশে
প্রভু ভক্ত ফিডো পাপোষের উপর গুটিমেরে শুয়ে আছে । ভাগ্যিস এই নিঃসঙ্গ জীবনে অমিত ,
মানে তার ছেলে এই সুন্দর উপহারটি দিয়েছিল ।
পায়ের আওয়াজ শুনে ঘাড়টা তুলে তাকাতেই ভবানীবাবু হাঁসতে হাঁসতে মাথায় হাত
বুলিয়ে বললেন, “ এই মাথাটাই আমাদের মানুষের সবচেয়ে গন্ডগোলের বুঝলি তো ! হেঁয়ালিমার্কা
কথাটা কী বুঝল তা কে জানে কিন্তু ফিডোর চোখে মুখে বেশ একটা বোদ্ধা ভাব ফুটে উঠলো ।
২
মাস কয়েক আগে ভবানীবাবুর বাড়ীতে
যে চুরিটা হয়েছিল তার কিনারা আজও করতে পারে নি পুলিশ । যদিও এই ২০৫০ সালের পুলিশ
অনেকটাই মর্ডান । বিগত চৌত্রিশ বছরে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বিজ্ঞানের জয়যাত্রা । এখন
আর থানা পুলিশের জন্য লাফালাফি করতে হয় না । প্রতিটি ঘড়েই লাগানো রয়েছে মাইক্রো
চিপ্স । যদি কোন বাজে কিছু হয়ে থাকে তাহলে ওই চিপ্সটাই কোড নাম্বার সহ থানায়
মেইল করে দিলেই কাজ শেষ । সবক্ষেত্রে যে সাকসেসফুল হয় তা নয় । যেমনটা হয় নি
ভবানীবাবুর ক্ষেত্রে !
প্রধান দু’টি বিষয়, প্রথমত
ফিডোর মত রোবো ওয়াচ ডগ থাকতেও চুরি ! আর দ্বিতীয়ত , চোর ঢুকলই বা কেমন ভাবে ওই
সাধন ঘড়ে ! শুধু তাই নয় চোর একটি পুরনো ডায়েরী ছাড়া আর কিছুই ছুঁয়েও দেখে নি ।
ডায়েরীটা বহুকাল আগের যখন ভবানীবাবু কলেজ লাইফে নানা খামখেয়ালিতে হিজিবিজি লিখে
ভরিয়ে তুলতেন !
সকাল ন’টা নাগাদ ডোর বেলের
আওয়াজ হতেই ভবানীবাবু দরজাটা খুললেন ।
-
“ এসো ইনস্পেক্টর
রায় , কিছু নতুন তথ্য !” একগাল হেঁসে জিজ্ঞাসা করলেন ভবানীবাবু । করমর্দন সেরে রায়বাবু
মাথার টুপিটা খুলে রেখে বললেন, “ স্যার বিষয়টা বড্ড গোলমেলে ঠেকছে ! সব মিলে গিয়েও
সব ধোঁয়ার মত হারিয়ে যাচ্ছে !”
-
“ ফ্রন্টাল লোবে
জোর দাও হে , তোমরা ইয়াং ছেলে , এসব কেস এখনও সমাধান করতে পারছ না এটাই অবাক ”
খানিকটা হাঁসি মিশ্রিত বিরক্তিতে কথাটা বললেন ভবানীবাবু ।
খানিক চুপ থেকে ইনস্পেক্টর রায়
প্যন্টের পকেট থেকে ডিজিটাল রে-পেন বার করলেন । সামনের কাঁচের টেবিলের উপর পেনটার
নব টিপে ভবানীবাবুকে বললেন , “ স্যার হেভ এ লুক ।”
একটা হাল্কা নীলচে আলো ফুটে ওঠে
টেবিলে । কিছু কোড ওয়ার্ড রান করে এক জায়গায় দাঁড়ায় । নির্দিষ্ট একটা ফাইলের কাছে
আসতেই গ্রিন আলো জ্বলতে থাকে ।
রায় বললেন এবার , “ স্যার আই
হোপ আপনি বুঝতেই পারছেন, ফাইলটা আমাদের এভিড্যান্স কপি ।”
ভবানীবাবু অবাক হয়ে ঘাড় নাড়িয়ে
বলে উঠলেন , “ হুম , তা বুঝলাম এবং দেখলাম কপিতে ভেসে আসছে যে লেখা তাতে বলা আছে
সেই মেয়েটির দেহাংশ উদ্ধার হয়েছে !”
গলা ঝেড়ে রায় সাহেব পুনরায় বলেন
, “ এতে আরও লেখা আছে , যা পাওয়া গেছে তার ইনস্ট্যান্ট ডি এন এ টেস্ট হয়েছে ...।”
হাতের ইশারায় ভবানীবাবু রায়কে
থামিয়ে জিজ্ঞাসা করেন , “ ডু ইউ সাস্পেক্ট মাই সান...?”
ঘড়ের পরিবেশটা থমথমে হয়ে যায় ।
কিছু বছর হল নিয়মানুসারে ডি এন এ ম্যারেজ রেজিস্ট্রি চালু হয়েছে । বিয়ের পর স্বামী
স্ত্রী ডি এন এর স্যাম্পেলের ইউনিক কপি রাখা বাধ্যতামূলক । যার এক কপি থাকে লোকাল
পুলিস ষ্টেশনে । এর সুবিধা খুন বা অন্যান্য আইনি তদন্তের সুবিধা হয় । তাছাড়াও এটি
বেশ আধুনিকও ।
রায় কিছুক্ষণ পর বলেন , “ স্যার
, বডি অফ দ্যাট ওম্যান ওয়াস ইওর...”
ভবানীবাবু ঝাঁঝিয়ে উঠে বলেন , “
তোমরা কথা বলেছ আমার ছেলের সাথে ?”
এইবার একচিলতে হাসি দেখা গেল
রায়ের মুখে । সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে বললেন , “ ওটাই তো স্যার !
আশ্চর্যের ব্যাপার তার হদিসও মিলছে না !”
যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার
বলে ওঠেন , “ ডু হেল্প আস স্যার ইফ নিডেড ।”
ঘড় থেকে বেড়িয়ে যেতেই অটো লক্
হয়ে গেল দরজাটা ।
৩
অসময়ে আবার সেই ঘরে ঢুকলেন ।
বড্ড ভাবিয়ে তুলেছে কয়েকটা বিষয় ! ডায়েরীর পাতা কটিতে ছিল আজ থেকে দুশো বছর আগেকার
এক গবেষকের কিছু তথ্য ; মানুষের ডানা গজানোর কিছু বায়লোজিকাল ক্যালকুলেশনস্ । আর
তার সাথে ভবানীবাবুর নিজের থিসিস “ থিওরি অফ ওয়াটার ট্রান্সফরমেসন ইন ক্লোন ।”
এগুলিই উধাও ! সব যেন তালগোল
পাকিয়ে যেতে থাকে ! তবে একটা বিষয় খেয়াল করলে ভবানীবাবুর মনে পরছে , যেদিন চুরি
হয়েছিল সেদিন এই ঘরে শুকনো দাগ দেখতে পেরেছিলেন । জল অ্যাসিডিক , শুকিয়ে যাওয়ার পর
ছাপ থাকাটাই স্বাভাবিক ধর্ম । কিন্তু কে এসেছিলো ! অমিত কি ! সে কি করে আসবে !
অমিত আর রেশ্মি দুজনেই কাজ করে আর্মির রিসার্চ ইন্সটিউশনে ! তাও কাজের সুত্রে
অধিকাংশ সময় বিদেশে কাটিয়ে দেয় !
দেখতে দেখতে সময় চলে যায় ।
সন্ধ্যে সাতটা । রিষ্ট ওয়াচটা সাইলেন্স মোডে , তাই বিঙ্ক করতে থাকে । ছোট্ট
ডায়েলের মধ্যে অমিতের মুখটা ভেসে আসে । অবাক হয়ে ভবানীবাবু বিন্দুর মত সুইচটা টিপে
দিতেই কথা শুনতে পান । কিছু কথা শোনেন ।
-
“ কী রে ! আমি জানি
তুই কী করেছিস !” একটু দৃঢ় গলায় ভবানীবাবু বলেন ।
-
“ বাবা , আমরা ঠিক
আছি ! কিন্তু দুটো ভুলের জন্য আমরা সমস্যায় আছি ” অমিতের স্বর ভেসে আসে ।
-
“ বুঝেছি , ফোন
করিস না ” বলেই নব ঘুড়িয়ে ডিসকানেক্ট করে দেন ভবানীবাবু ।
পু্রোটা না হলেও একটা হাল্কা
কুয়াশার চাদর সরতে থাকে । ঘুমের ওষুধের ফল আজ কাজে দিচ্ছে না । বার বার একটাই কথা
মনে হচ্ছে , ছেলের ভুলটা কী ! ভবানীবাবু নিজেও কাজ করেছেন সেনার গবেষণা কেন্দ্রে
বহুদিন । একটু পরেই হাল্কা ঝিমুনি ভাব আসে । হাল্কা ভাবে ভেসে ওঠে , আজ থেকে বহু
বছর আগে মানুষ আবিষ্কার করে ফেলেছিল , রি-ডিজাইন্ড ডিঅক্সিবোন নিউক্লিক আস্যিড । ইচ্ছা অনুসারে
আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ । ভাল কতটা হয়েছে জানা নেই , তবে হয়তো খারাপের
সংখ্যাই বেশী । এমন আবিষ্কার যুগ যুগ ধরে চলে আসছে । বেঠিকের পরিমাণও বেড়েছে ।
কখন ঘুমিয়ে পরেছেন এসব ভাবতে
ভাবতে তা নিজেও জানেন না ভবানীবাবু । ঘুমটা ভাঙল ফিডোর টানাটানিতে । উঠে বসে
হতভম্ভ হতেই বুঝলেন দেওয়ালে ঝোলানো ওয়াপিতে ভেসে আসছে বার বার নোটিফিকেশনস্ !
ওয়াপি আধুনিক যুগের ল্যাপটপের নব সংস্করণ । নো কেবিল , নো ইন্টারনেট কানেকসন ।
চাঁদের পনেরো দিনের আলোতেই রিচার্জ হয়ে যায় । সৌরশক্তি ব্যাক ডেটেড ।
ভাল করে চোখ বোলাতেই তিনি
দেখলেন , ছেলে অজানা কোন এক দ্বীপ থেকে ম্যাসেজ করেছে ।
‘ ফিরলে ধরে নেবে মেরে ফেলার
জন্য ’
‘ স্টিল অ্যালাইভ ।’
ভবানীবাবু রিমোটে লিখলেন , ‘ ডোন্ট
ওয়ারী , কাম সুন , উইল ম্যানেজ ।’
আজ আর কিছুতেই ঘুম হল না
ভবানীবাবুর , গেলেন না তার স্টাডি রুমে ।
সকাল হতেই যোগাযোগ করলেন
ইনস্পেক্টর রায়ের সাথে । সকাল দশটা । ঘরে সোফাতে বসেছিলেন ইন্সপেক্টর রায় । একটু
বাদেই প্রবেশ করেন ভবানীবাবু । নিজে সামনের মোটা গদির চেয়ারে বসে এক ভাবে তাকিয়ে
থাকলেন রায়ের দিকে । ঘরের নিস্তব্ধটা ভেঙে ইনস্পেক্টর বললেন , “ স্যার আই নো ইউ
অ্যান্ড আই অ্যাম ফ্যান অফ ইউর ওয়ার্কস, দেশের জন্য আপনি কী না করেছেন ভবানীবাবু ওর
মুখের দিকে আবার তাকালেন । তারপর বললেন , “ চুরিটা আমি জানি কে করেছে ! পরে এর
কারণও বুঝতে পেরেছি আর আমি এও জানি অমিত , মানে আমার ছেলে কোন খুন করে নি ।”
অনেকক্ষণ এক নাগাড়ে বলার পর
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়েন তিনি । পরিবেশটা আবার গম্ভীর হয়ে যায় । ইনস্পেক্টর রায় আচমকা
বলেন , “ কবে ফিরবে অমিত !”
এ কথা শুনে কিছুটা হলেও অবাক হন
ভবানীবাবু । মুচকি হেসে রায় বলেন , “ স্যার, অমিত আমার স্কুল ফ্রেন্ড । ও আমার
সাথে আগেই সব বিষয়ে কথা বলে কিন্তু একটা জিনিস বলে নি কী করতে চলেছে ।”
-
“ আজ হয়ত আসবে ।”
সামান্য উত্তর দিয়ে চুপ করে যান ।
৪
সন্ধ্যে হয়েছে । আজ মেডিকেল লিভ
নিয়েছে ইনস্পেক্টর । হাল্কা আলোয় তিনজন ড্রয়িং রুমে বসে আছেন । রেশ্মী নিস্তব্ধতা
ভেঙে বলে ওঠে , “ আসলে সব ঠিকঠাক হয়ে যেত কিন্তু অমিতের সামান্য দুটো ভুলে আমাদের
গবেষণা খারাপ হয়ে যায় ।”
-
“ কী ভুল !” ছোট্ট
করে জানতে চায় রায় ।
-
“ মানুষের মাথা
অন্যদের তুলনায় ভারী আর দ্বিতীয়টা হল আমাদের ক্লোনে রেজিস্ট্রেশন চিপ ভুল করে
লাগিয়ে দেয় আর তৃতীয়টা হল...”
-
“ সিরিয়াসলি আমি
কিছু বুঝতে পারছি না তোদের কথার মানে ” রায় সাহেব অমিত আর রেশ্মির দিকে তাকিয়ে
কথাটা বলে ফেলেন । ঠিক সেই সময় একটা খাতা হাতে নিয়ে ঘরে ঢোকেন ভবানীবাবু । তিনি এবার বলে ওঠেন , “ আমি তোমাকে বিষয়টা
বলছি । কিন্তু যা বলব , তা যেন বাইরে প্রকাশ না পায় , আফটার অল এটা গোপন গবেষণা ।”
ইনস্পেক্টর রায় মাথা নাড়িয়ে সম্মতি প্রকাশ করতে
ভবানীবাবু ছেলে আর বৌমার মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে বলেন , “ ব্যাপারটা জটিল ও দীর্ঘ
, মন দিয়ে না বোঝার চেষ্টা না করলে সবই মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যাবে ।”
অমিতের হাল্কা হাসি ফুটে উঠতেই ইনস্পেক্টর বলে
ওঠেন “ চিন্তা নেই যতটা পারি বোঝার চেষ্টা করব ।”
গলায় আত্ম বিশ্বাসের সুর শুনে ভবানীবাবু যা বললেন তার সহজ উপসংহার হল অতি
দুরুহ এক অভীষ্টের ব্যাপার । অমিত আর রেশ্মী দুজনেই নিজেদের ক্লোন তৈরী করেছিল ।
এটা এমন কিছু নতুন নয় ।
অমিতদের উদ্দেশ্য বা নতুনত্ব
ছিল মানুষের বা যে কোন প্রানীর ক্লো্নের সেলে জলের মাত্রা বাড়িয়ে তুলে তরল করে
তোলা । এ সব বিজ্ঞানের সুবিধার জন্য । বিশেষ করে যুদ্ধের কাজে সাহায্য করবে । শত্রুর
ঘাঁটিতে সেই ক্লোন ঢুকে অবস্থা অনুসারে নিজের দেহের হাজার গুন তাপমাত্রা বাড়িয়ে
তরল হয়ে যাবে । আর যে কোন জায়গায় বিনা বাধায় অনায়াসে যেতে পারবে । কোন লেজার রে
এফেক্ট ফেলবে না বা ধরাও পরবে না ।
মানুষের দেহে সাধারনত সত্তর
শতাংশ জল থাকে । কিন্তু ওরা ওদের ক্লোনে প্রয়োজনে ঘরে বসেই রিমোটের মাধ্যমে এই
জলের মাত্রা বাড়িয়ে তুলতে পারত । অমিত মন দিয়ে শুনছিল । মাঝ পথে
বাবাকে থামিয়ে বলে , “ দ্যাখ , হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের মিশেলে যে জল তৈরী হয় । এখানে আমরা আরেকটু মডিফাই করি
।”
রায় জানতে চান , “ কেমন করে ?”
অমিত হেসে বলে , “ মডার্ন ক্লোন একপ্রকার
রি-ডিজান্ড রোবট বলতে পারিস ! তাপমাত্রা হাজার গুন বাড়িয়ে দিলে জল আবার ভেঙে দুটো
গ্যাসে পরিণত হয়ে যায় । এই ক্ষেত্রে আমার বা রেশ্মীর ক্লোন এমন ভাবে তৈরী করা
হয়েছিল যাতে , সেটিকে জলের মত তরল ও গ্যাস দুটোতেই রূপান্তর করা যেতে পারত ।
রায় মাথা চুলকাতে চুলকাতে ভবানীবাবুর করুন মুখে
তাকিয়ে বললেন , “ স্যার কিছুটা বুঝতে পারছি বাকীটা ...”
ভবানীবাবু হো হো করে হেসে বললেন , “ জটিল করে ভেব
না । খুব সাধারন । জল যেখানেই ফাঁক পাবে সেখানেই ঢুকতে পারে কেমন কিনা !”
মাথা ঝাঁকিয়ে রায় সম্মতি জানান । ভবানীবাবু আবার বলেন , “ এবার ওই জল নির্দিষ্ট জায়গায় ঢুকে তথ্য সংগ্রহ বা বাকী কাজ সেরে ব্যাক
করবে , এই তো হল ব্যাপার । আর এ সব হবে কন্ট্রোলারের সাহায্যে ।”
কপালে চোখ তুলে রায় “ মাই গড !” বলে বসে পরেন ।
রেশ্মী অনেকক্ষণ ধরে উসখুস করছিল । এবারে থাকতে না
পেরে বলে ওঠে , “ এই গবেষণার দ্বিতীয় পর্যায় হল উড়তে পারা । মানুষের এই ইচ্ছা
অনেকদিনের । তাও হয়েছিল ।”
রায়ের আবার বিষম খাওয়ার পালা । রেশ্মী হাল্কা হেসে
বলে , “ শোন অনেক বছর আগে , সাল্ক ইনস্টিটিউট ফর বায়োলজিক্যাল স্টাডিজ –এর অধ্যাপক
স্টুয়ার্ট ইবসন ইঁদুরের ব্রেনে লেজার রে পাঠিয়ে ব্রেনকে চালনা করার পদ্ধতি তৈরী
করেন । আমরা চেয়েছিলাম অন্য । ব্রেনের ওয়েট কমাতে । যাতে নকল হিউমেরাস আর তার সাথে
রাডিয়া আনলা জুড়ে আরও দুটো হাত ডানার জন্য তৈরী করতে পারা যায় ।”
অমিত ঢোক গিলে বলে , “ তাতে কী হবে !”
ভবানীবাবু ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে বলেন , “
তাতে মানুষ উড়তে পারবে । ওরা ব্রেনের ওয়েট কমায় ঠিকই কিন্তু ভুলে গেছিল , শুধু ওজন
মাথার কমালেই চলে না । হিউমেন বোনকে অনেকটাই ফাঁপা হতে হবে পাখীদের মত । যা ওরা
করে নি আর ওদের তৈরী ক্লোন একটু উড়েই ধরাশায়ী । গবেষণার বারোটা বাজল !”
অমিতের দিকে তাকিয়ে ইনস্পেক্টর রায় জিজ্ঞাসা করেন
, “ এর সাথে কী তোর প্রথম গবেষণার যোগ আছে ?”
অমিত একটু চুপ করে বলে , “ আলবত আছে । ক্লোন নিরাপদ
দুরত্ব পর্যন্ত উড়ে গিয়ে নিজের চেহারার পরিবর্তন ঘটিয়ে কাজ সারতে পারতো ।”
রাত বেশ হয়ে গেছে । রেশ্মী ডাইনিং রুমে খাওয়ার
পরিবেশন করে নিজেও খেতে বসেছে । খাওয়ারের কাঁটাটা নাড়তে চাড়তে ইনস্পেক্টর রায় হঠাৎ
বলে ওঠেন , “ স্যার এটা ২০৫০ সাল , বিজ্ঞান অনেক দূর এগিয়েছে কিন্তু আজও প্রকৃতিকে
জয় করতে পারে নি !”
ভবানীবাবু মুখটা রুমাল দিয়ে মুছতে মুছতে বলেন , “
যেদিন সেটা হয়ে যাবে সেদিন আমরা সবাই শেষ হয়ে যাব !”
রায় একটু ভ্রূ কুঁচকে বলেন , “ আচ্ছা স্যার আপনি
কী প্রথম থেকেই এগুলো জানতেন !”
মাথার উপর লাইট ঝুলছে । প্রত্যেকের মুখ হাল্কা
আলোয় খানিক দেখা যাচ্ছে ।
ভবানীবাবু বলেন , “ পুরোটা আমি অমিতের কাছ থেকে
শুনি কিন্তু একটা বিষয়ে কিছুকাল আগে থেকেই পরিস্কার ছিলাম । আমার ডায়েরীর পাতা
হারানোর পিছনে কে আছে !”
রায় বলে ওঠেন , “ আপনি জানতেন ! তাহলে তদন্ত কেন
করতে দিয়েছিলেন ?”
ভবানীবাবু বলেন , “ সেটা বলতে পারো প্রাথমিক ভাবে
আমি নিজেও ধাঁধায় পরেছিলাম কিন্তু পরে বুঝতে পারি । কিন্তু মাঝ পথে তদন্ত বন্ধ
করলে সন্দেহ হত সবার , তাই...।”
রায় উঠে দাঁড়িয়ে বলেন , “ শেষ প্রশ্ন ! কী করে
বুঝলেন ?”
সবার দিকে তাকিয়ে ভবানীবাবু বলেন , “ আমি বুঝতে
পাই সেই জলের ছাপ থেকেই ! ল্যাবে টেস্ট করি । ডি এন এ তে অমিতের ক্রোমোজোম পাই ।
আর তারপরে বুঝি এটা অমিতের নতুন সৃষ্টি । তবে জলে রূপান্তরের বিষয়টা তোমাদের সাথে
কথা বলতে বলতে পুরো পরিস্কার হয়ে গেল ।”
ইনস্পেক্টর রায় আরও বেশ খানিক্ষন বসে আড্ডা দিয়ে
চলে যেতে যেতে বললেন , “ আবার কী শুরু করবি নাকি !”
অমিত আর রেশ্মী
হাঁসতে হাঁসতে জবাব দেয় , “ এখন না নেক্সট ইয়ার ২০৫১ ।”
No comments:
Post a Comment