Monday 7 November 2016

রাজকন্যা হীরামতি


Image result for pencil drawings of kids with grandpa
                                                                     ১
আসরটা আজ বহুদিন পর জমে উঠেছে । এদের পরীক্ষার জ্বালায় মাঝখানে বেশ ক’দিন ঝিম মেরে গিয়েছিল । সকাল বেলায় বারান্দায় অভ্যাস মত বসে আছি । অকস্মাৎ মোবাইলের রিং-টা যতটা না মধুর শোনালো তার থেকেও বেশী ভালো লাগল অপর প্রান্তের রিন্‌রিনে স্বর , “ জ্যাঠু বিকেলে আসব কিন্তু ।”
- “ এস , একা আসবে তো ?”
- “ উঁহু , আমার দুই বন্ধুও আসবে তোমার গল্প শুনতে ” বলেই কটাস করে কেটে দিল ফোনটা ।
ভালোই লাগছিল আবার ভয়ও করেছে । আধুনিক যুগের বাচ্চা ! ওদের মত কথাবার্তা এখনো যে রপ্ত করতে পারি নি ! “ নীল রাজার দেশে ” গল্প ওদের শুনিয়েছিলাম । তারপর ফাঁক পেলেই নানা বাক্যবাণে কাহিল হওয়ার যোগাড় ! অতএব এবার সব সামলে কিছু একটা বলতে হবে । দুপুরে আমার ভাত ঘুমের অভ্যাসটা দিব্যি বজায় রেখেছি ।
গ্রীষ্মের দুপুর দেরীতে শেষ হলেও , নয়নিকা তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে রোদ মাথায় করেই হাজির । এসেই সোজা আমার বেডরুমে । এ সি’টা হাল্কাভাবে গান ধরেছে । আমার সর্বক্ষণের সঙ্গীটি কিছুদিনের জন্য ছুটি নিয়ে বাড়ি গেছে । খুব একটা অসুবিধা না হলেও চটপট ফ্রিজ থেকে তিন গ্লাস ফ্রুট জুস দিলাম ওদের । আমার জন্য লাল চা ।
- “ নাও শুরু কর তো একটা কিছু ।”
- “ ওরে , তোদের পরীক্ষা যে কেন শেষ হয় !” কপট রাগ দেখিয়ে বললাম ।
- “ আচ্ছা সেই রাজকুমারী চলল পথ ঘাট পেরিয়ে জঙ্গলের ভিতর , তারপর কি হল ?” নয়নিকা কি একটা ভেবে বলে উঠল । আমি থোড়াই রেখেছি মনে কোন রাজকুমারী ! তবে বাচ্চাদের এই অপরিসীম স্মৃতিশক্তির কাছে হাড় মানতেই হয় । গলাটা ঝেরে বললাম , “ চৈত্র মাসের শেষ পূর্ণিমার আলোয় রাজকুমারী হীরামতির খুব একটা অসুবিধা হচ্ছিল না পথ চলতে । রাতের আলোয় জঙ্গলের রাস্তাটা খানিকটা পরিস্কার লাগছে...”
- “ ওই যাহ ! কারেন্ট গেল এই গরমে ” শ্রোতার দল একসাথেই বলে উঠল । বুঝলাম গল্পের আসরটা ছাদেই সারতে হবে । পশ্চিমে সূর্যটা কিছুক্ষণ আগেই ঢলে পরেছে ।
                                                                           ২
জঙ্গলের গা ঘেঁসেই খাড়া পাহাড় । জ্যোৎস্নার আলোয় চিক্‌চিক্‌ করে উঠছে নদীর জল । অত্যন্ত হাঁপিয়ে রাজকন্যা হীরামতি আঁজলা ভরে জল খেতে শুরু করলেন । একেই অচেনা জঙ্গল , তার উপর মাঝে মধ্যে ভেসে আসছে হিংস্র পশুদের গর্জন । মনে মনে ভাবলেন , ‘ যে করেই হোক একটা মোটা গাছের ডালে রাতটা কাটিয়ে সকালের জন্য অপেক্ষা করতেই হবে । পদ্মের মত নরম পায়ের পাতা থেকে সোনার জুতো যে কখন খুলে গেছে খেয়ালই করেন নি তিনি । কোনমতে উঠে দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত চিপে এগোতে লাগলেন তিনি । কিছুটা দূর যেতেই চাঁদের আলোয় দেখলেন একটা প্রাচীন বটগাছ । অজস্র ঝুড়িতে বেশখানিকটা জায়গা ঘিরে রেখেছে । রাজকুমারী হীরামতি গাছের ডাল ধরে উঠে পড়লেন । একটি ডালে ভাল করে বসতেই চোখ দুটি ক্লান্তিতে ভরে উঠল । বাড়ীর জন্য মনটা তার কেমন করে উঠল । জীবনে প্রথম এ ভাবে বেড়িয়েছেন । উপায়ও নেই ! বৈদ্য রাজ নির্দেশ দিয়েছেন , রাজার কন্যাই একমাত্র শৃঙ্গব পর্বত থেকে শ্বেত পাথর নিয়ে আসলেই রাজার রোগ সারতে পারে । সম্পূর্ণ যাত্রাপথে একাই পার করতে হবে জঙ্গল , পাহাড় , নদী । সাত রাত আটদিনের পথে নানা বিপদের সম্মুখীনও করতে হতে পারে । রাজা কতবার নিষেধ করেছিলেন তাঁর আদরের কন্যাকে । কিন্তু হীরামতি সজল চোখে বলেছিল, “ আমি মেয়ে বলেই তোমার এত ভয় বাবা ! আমি যাবোই ।” এরপর রাজা আর বাধা দেননি । তিনি জানেন তাঁর মেয়ে সৎ ও সাহসী । রানীমা শুধু যাওয়ার আগে মেয়ের হাত ধরে বলেছিলেন , “ হীরা, একটা কথাই মনে রেখো , পথে যাই আসুক না কেন ভয় পেও না ; তুমি সৎ ও সত্যের পথে চললে কেও কিছু করতে পারবে না ।”
                                                                               ৩
রাজকন্যার চোখটা খুলে গেল হঠাৎ-ই ! চোখ মেলতেই তিনি দেখলেন , একি ! তিনি মাটিতে কেন শুয়ে আছেন ! ধীরে ধীরে উঠে বসে সামনের দিকে যেই না তাকালেন , দেখলেন যে বটগাছটির উপর শুয়ে ছিলেন সেটি দুলছে ! ভূমিকম্পের মত সারা অরন্য কাঁপতে শুরু করেছে । খানিক পরেই সারাটা জঙ্গল স্তব্ধ হয়ে গেল আগের মতই । সামনের বটবৃক্ষের একটা মোটা ডাল ঠিক মানুষের হাতের মত রাজকন্যাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে । সাহসে ভর দিয়ে রাজকন্যা এগিয়ে যেই না গেছেন অমনি বটবৃক্ষ মানুষের মত বলে উঠল –
“ হীরামতি রাজার কন্যে ,
রোগ সেরে হবে ঝলমলে-
পথের নিশান দিব বলে ,
কিছু কর আমার জন্যে ।”
প্রথমদিকে ভয় পেয়ে গেলেও নিজের মন শক্ত করে করজোরে রাজকন্যে বলেন ,
“ রাজকন্যা হীরামতি আমি বল কি চাই
সাধ্যমত করে দিব, আশিস কর তাই ।”
বটগাছ হীরামতির কোথায় অত্যন্ত খুশী হয়ে বলল ,
“ বড্ড আমার পেয়েছে তৃষা ,
নদীর জলেই মিটবে এ আশা ।”
মায়া হল রাজকন্যার মনে , সে অচেনা পথ ধরেই আনতে চলল জল । একটু এগোতেই কুলকুল করে জলের আওয়াজ শুনে রাজকন্যা বুঝতে পারলেন সেই নদীটি বয়ে যাচ্ছে । পায়ের তলায় নরম মাটি । সাবধানে পা টিপে টিপে নদীর কাছে গেলেন হীরামতি । হাত তাঁর শূন্য; তবুও পরনের দামী শাড়ীর আঁচল দু’হাত দিয়ে ছিঁড়ে যেই নদীর জলে ভিজাতে
গেলেন , ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা ! নদীতে আচমকা উঠলো শন্‌শন্‌ করে ঢেউ । তাজ্জব ব্যাপার ! নদীতে এমন স্রোত তো ইতিপূর্বে সে কখনও দেখেনি ! রাজকন্যাকে নদীও মানুষের গলায় বলে ওঠে ,
“ হীরামতি হীরামতি ,
কেন তোমার চপল গতি ?”
রাজকন্যা বুঝতে পারলেন না বটবৃক্ষ , নদী তাঁর নাম জানল কি করে ! তবে তিনি নিশ্চয় কোন রাক্ষসদের মায়ার জালে পরেছেন ! আস্তে আস্তে চাঁদ পশ্চিমে হেলে পড়ছে । হাল্কা মেঘের আভাস আকাশে । থেকে থেকে দূরে ঈশান কোণে বিদ্যুতের গর্জনহীন আলো । চঞ্চল হয়ে উঠলো হীরামতির মন । বৈদ্য রাজ বলেছিলেন , সাত দিনের মধ্যে ওই শিলা আনতে হবে , নচেৎ রাজা আর সুস্থ হবেন না । আজই শেষরাত । মাথা ঠাণ্ডা রেখে রাজকন্যা নদীর কাছে কাতর স্বরে অনুনয় করলেন ,
“ বটবৃক্ষ ভীষণ তৃষ্ণার্ত, দেহে নাহি বল-
দাও না ভাই , তোমার একটুখানি জল ।”
হীরামতির কথা শুনে নদী পুনরায় বলে ওঠে ,
“ যা চাইবে তা পাবে ভাই-
রাখতে হবে কথা একটি ,
বুকের উপর পাষাণটি-
খুব ব্যথা, সরাও না তাই !”
হীরামতি ভালো করে নদীর দিকে চাইলেন । দেখলেন , নদীর উপর বিশাল একটা পাথর কারা যেন ফেলে দিয়ে গেছে । ফলে, নদী ভাই ভালো করে বইতে পারছে না । এ দেখে রাজকন্যার মন ব্যাথায় ভরে গেল । সুন্দর দু’টি চোখ দিয়ে মুক্তোর মত অশ্রু টপটপ করে গাল বেয়ে ঝরতে লাগল । সময় বেশী নেই বুঝে, কালবিলম্ব না করে সেই বিশাল পাষাণটিকে নরম দুই হাত দিয়ে প্রানপণে ঠ্যালার চেষ্টা করতে লাগলেন । কিন্তু পাষাণ এক বিন্দুও নড়ল না । রাজকন্যা আর কাঁহাতক পারেন ! একেতেই নিজেও দুর্বল , কতদিন ভাল করে খেতেও পারেন নি । তবুও তিনি ছাড়বার পাত্রী নন । কয়েকবার আছাড় খেয়ে পড়লেন ওই ধারালো পাষাণে । কেটে গেল তাঁর কোমল হাত । চুঁইয়ে পড়ল রক্ত । এক সময়ে তিনি দেখেন পাষাণটি একটু যেন নড়ে উঠল ! আবার দিলেন সজোর ধাক্কা । আর অমনি পাষাণও সেই মানুষের মত বলে উঠলো ,
“ হীরামতি , ঋষভ রাজার মেয়ে –
পূব আকাশে সুজ্যি ওঠে , দেখ চেয়ে ।”
সত্যি তো রাতের ঘুম ভেঙে হাল্কা আলো পূর্ব দিকে । এবার রাজকন্যা মনে মনে কেঁদে ফেললেন । তবে কি বাবা আর কোনদিন সুস্থ হবেন না ! আধ হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে ভাবলেন আবার, ‘ নদী ভাই , বটবৃক্ষের অনুরোধ তো রাখতেই হবে ! এরা সবাই তো প্রকৃতির অঙ্গ । মনকে স্থির করে রাজকন্যা পাষাণের দিকে তাকিয়ে বললেন ,
“ নদী ভাইয়ের ভীষণ ব্যাথা
বটবৃক্ষ চায় যে জল –
খানিক সরে, রাখ আমার কথা ,
করো না আমায় বিফল !”
পাষাণ সব শুনে বলে ,
“ সরব আমি বরাবর
যদি দাও ঠিক উত্তর”
পাষাণের কথায় নীরব হয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ হীরামতি । তিনি বললেন একটু পরে,
“ শুধাও মোরে প্রশ্ন একটি
সৎ আমি , জবাব দেব খাঁটি ।”
পাষাণ তখন সন্তুষ্ট হয়ে প্রশ্ন করলো ,
“ সবাই বলে আমি পাষাণ -
সত্যই কি নেই মোর পরাণ !”
রাজকন্যা একটু চিন্তা না করে বিনম্রভাবে জবাব দিলেন ,
“ মাতা ধরিত্রীর স্নেহের সন্তান –
হতে পার তুমি কোঠর পাষাণ ,
আছো বলেই আছি মোরা বেঁচে –
মহান প্রান তোমার , কষ্ট নাও যেচে ।”
কথাগুলো মন থেকে এক নিঃশ্বাসে চোখ বন্ধ করে হাত জোড় করে তিনি বলে গেলেন । মনে মনে ভাবতে লাগলেন , ‘ এবার যদি পাষাণ দাদা উপকার করে ।’
                                                                           ৪
সময় কেটে যাচ্ছে । রাজকন্যা ধীরে ধীরে চোখের পাতা মেললেন । ও মা একী !! সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে চারিদিক । সামনেই সুবিশাল পালঙ্কে রাজা শুয়ে আছেন। অনেকদিন পর তাঁর মুখে প্রশান্তির হাঁসি । পাশেই রানীমা ,বৈদ্য রাজ , মন্ত্রীগণ। বিস্ময়ে রাজকন্যা চেয়ে থাকলেন । বৈদ্য রাজ বললেন , “ ধন্যি তুমি । আজ ভোরেই তুমি সেই শৃঙ্গব পর্বতের শ্বেত পাথর এনেছ । তাই তো রাজা মশাই একেবারে আগের মত ভালো হয়ে উঠেছেন ।” হীরামতির মুখের রা কারেন না । কি করে হল এমন ! ঘোর কাটিয়ে বাবাকে তিনি আনন্দে জড়িয়ে ধরলেন । তারপর এক ছুটে গেলেন নিজের কক্ষে । আবার আশ্চর্য হলেন , সব ক্ষত, ব্যথা তাঁর উধাও ! দুহাত দিয়ে খুলে দিলেন অনেকদিন পর তাঁর ঘড়ের প্রশস্ত জানালা । হু হু করে বইতে লাগল শীতল স্নিগ্ধ বাতাস । জানালার পাশেই ফুটে আছে মাধবীলতা আর তার নরম ডালে ছোট্ট দু’টি নীল হলুদ পাখি
নিজেদের মধ্যে খুশীতে গান গাইছে গুণ গুণ করে –
“ হীরামতি রাজকন্যা ধন্যি মেয়ে ,
ভাবে সে, সকল জড়-জীব নিয়ে ।
বটবৃক্ষ-নদী- পাষাণ নিলে তার পরীক্ষা ,
সবে যদি পেত হীরের মত শিক্ষা ।
বাতাস ভায়ের কাঁধে চেপে এলেন তিনি ফিরে
 নামের মতই হীরার কন্যে আর ক’জন হয়রে !”
ফুরফুরে হাওয়ায় সারা শরীর জুড়িয়ে গেল । আকাশে চাঁদটা গোল হয়ে উঠেছে । এ আলো নির্মল ।
নয়নিকা বলল , “ জ্যাঠু , রাজকন্যার মত মন আমাদেরও থাকা উচিৎ ।”
হেঁসে বললাম , “ তা তো ঠিকই ; দেখছই প্রকৃতিকে ধ্বংস করলে কেমন গ্লোবাল ওয়ার্মিং হয় !”
নয়নিকা আর তার দুই বন্ধু একসাথে বলে উঠল , “ ঠিক কথা , আমাদের সকলকেই
একসাথে গাছ , নদী , পাহাড় প্রকৃতিকে বাঁচাতেই হবে ।।”
Image result for pencil drawings of nature

No comments:

Post a Comment

আত্মারা যখন অন্য গ্রহে

১ রা তটা এখন বেশ গভীর । টুক করে শব্দ হতেই কান সজাগ হয়ে উঠলো অ্যাটলাসের । মাথার মধ্যে টিঁ টিঁ কী বেশ ক্যাল্কুলেশন করেই এগিয়ে গেল দরজার ...