রাত হতে না হতেই জটলা পাকানো ধোঁয়াটে অন্ধকারে একে একে জড়ো হতে শুরু করেছে ।
বুড়ো অশ্বথ গাছ আর তেঁতুল গাছের ঝাঁকড়া পাতা-ডালপালার মাঝে চিক্মিক্ করে উঠছে
নানা মাপের ভূতদের চোখ । পাশেই পচা এঁদো পানা পুকুর থেকে ভুর ভুর করে উঠছে মিষ্টি
সুবাস ।
পদা মানে আমাদের পদ্মলোচন পুণ্ডরীকাক্ষ এর হোতা । বাবার
টাকায় খায় আর বগল বাজিয়ে অদ্ভুতুড়ে কান্ড করে বসে । পদার বাপ বহুকষ্টে অং বং করে
কিছু মন্ত্র আওড়ে গ্রামের কয়েক বাড়ির পুজো সারে । যা পায় তা দিয়ে তা দিয়ে বাপ
ব্যাটায় টেনে টুনে চলে যায় । পদার মা কয়েক বছর গত হয়েছে । মা মারা যাওয়ার পর থেকেই
পদা সাপের দশ পা দেখতে শুরু করে ।
সব দিন যে ভাল যায় তা নয় । মাঝে মধ্যেই সাবু
খেয়ে রাত কাটাতে হয় । বিশাল শখ করে দাদু ইয়া বড় নাম রেখেছিল । কিন্তু ওটাই কাল হয়
! পদা নিজেকেই নিয়ে পেটে গামছা বেঁধে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে । যা হওয়ার না তাই
করতে পাগলামীর অন্ত রাখে না । এই তো সেদিন ভীষ্মলোচন ছেলেকে কান ধরে কয়েকবার নাড়া
দিয়ে বলে , “ ধম্মের ষাঁড়ও তোর থেকে কাজের ! আর তুই কাজের মাথা খেয়ে কি সব পরীক্ষা
নিরীক্ষা করছিস !”
পদা তার মহৎ গুণের উপর ভরসা রেখে বাপের কথাকে ফুঁ মেরে
উড়িয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বলে , “ দেখ কথায় কথায় আমার কানে খড়কের মত সুড়সুড়ি দিও না ,
সফল হলেই বুঝতে পারবে ।”
এ হেন বুকে দম মারা উক্তি শুনে ভীষ্মলোচন আর সেখানে
দাঁড়ায় নি । হন হন করে ধুতি গুটিয়ে যেতে যেতে একবার পিছন ফিরে ছেলের দিকে তাকিয়ে
বলে , “ রোসো , আমি ফিরে আসি তারপর তোমার বজ্জাতি বার করছি !”
২
গায়ে কাঁটা দেওয়া শিমুল গাছের পাশেই পশ্চিমের প্রায়
অন্ধকার ঘর । বিগত কয়েকমাস এটাই পদার সাধন কক্ষ । এই ঘরেই মাস কয়েক পূর্বে
সিদ্ধিলাভ করে পদ্মলোচন । সেই কালো রাতে সবে মাত্র খান সাতেক পুরোন গামছার মত
পাতলা রুটি আর কুমড়োর ঘ্যাঁট খেয়ে বেজার মুখে বিছানায় শরীরটা ঠিক এলিয়েছে ,
অমনি...।
-
“ পদা রে ওঠ বাপ । চেয়ে দেখ তোর বেহ্ম মামা এসেছে ” খনখনে ভারী গলায় কে বেশ
ডাক দেয় । এক ধাক্কাতেই পদার প্রায় বুজে আসা চোখ খুলে যায় । পিটপিট করে ঘরের দিকে
তাকাতেই হঠাৎ-ই চমকে ওঠে । ভাল করে তাকাতেই দেখে দাঁত ভাঙা এক ব্রহ্মদৈত্য ফ্যাল
ফ্যাল করে চেয়ে হাসছে ।
- “ ভাগ্নে তোর সাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে দেখা দিলুম
কিন্তু ! তোকে এক কাজ করে দিতে হবে !” হাঁসতে হাঁসতে ব্রহ্মদৈত্য বলে ।
ভুতের সাথে দেখা করার , তাদের বিবাহ কেন্দ্র খোলার বহুদিনের
সাধ ছিল পদার । তার মনের মধ্যে ঘুরঘুর করত একটাই কথা , “ আহা মরেও কি বেচারারা বিয়ে , প্রেম করতে
পারবে না ! না হয় ওই জীবনে অনেক সাধ ছিল কিন্তু পূরণ হওয়ার আগেই মায়া ত্যাগ করতে
হয়েছে ! তাই ভূত বিবাহ নিকেতন খোলার দরকার !” যা ভাবা তাই কাজ । অনেক কষ্টে শিষ্টে
লুকিয়ে চুড়িয়ে ভূতের সঙ্গে যোগাযোগ করে । তার ঘরের পাশেই শিমূল গাছেই পোড়া তামাকের
গন্ধ পেয়ে পরিচয় হয়েছিল শিবভক্ত ভূতদের পরম পূজনীয় ব্রহ্মদৈত্যের সাথে । কিন্তু আজ
তার সাথে চাক্ষুস আলাপ হয় ।
_ “ কি কাজ বল মামা ” গদগদ স্বরে পদা জিজ্ঞাসা করতেই
ব্রহ্মদৈত্য আচমকা লজ্জা পেয়ে মোলাম সুরে বলে ওঠে , - “ তোদের যে কাঁঠাল গাছ আছে
না ওখানে...”
-
“ আরে কি হয়েছে ওখানে !”
-
“ প্রেমে পরেছি , বিয়ে করব , তোর মামিকে ঘরে তুলব , সাহায্য চাই...” এক
নাগারে গরগর করে অতবড় ভুতটা লজ্জায় চোখ বুজে বলে যায় ।
-
“ বাহ এ তো দারুণ ব্যাপার মামা !” কথাটা বলেই পদা অন্ধকার ঘরের মধ্যেই
আঁতিপাঁতি করে কি সব হিসেব নিকেশ করে বলে ওঠে আবার , “ শোন মামা ,ভূতদের সবরকম সেবার
জন্যই প্রতিষ্ঠান খুলেছি । চিন্তা নেই আমিই তোমার বিয়ে দেব , লজ্জা পেও না ।”
শেষে বিস্তর আলোচনার পর ঠিক হয় আগামী শ্রাবণের শেষ রাতে
শ্রীমতি শাঁকচুন্নি দেবীর সাথে শ্রীমান ব্রহ্মদৈত্যের বিয়ে হবে ।
৩
গদাই পালোয়ানের বউ শান্তি সেবার রুপোর ঘটি পুকুর ঘাটে
ভুলে ফেলে এসেছিল । গদাই তুলোধুনা করার আগেই পদা ঘটিটি সযত্নে শান্তির হাতে তুলে দিয়ে
একগাল মিষ্টি হেসে পরিচয় সেরে ফেলে । শান্তি গালে হাত দিয়ে মনে মনে ভাবে , সত্যি
তো অন্য কেউ হলে এতক্ষনে গাব করে দিত !
সেই পুরনো কৃতজ্ঞতার ল্যাজ ধরে পদা আর শান্তি নিজেদের
মধ্যে বন্ধু পাতিয়ে ফেলে । শান্তিও নানা সুখ দুঃখের কথা শোনায় । কি ভাবে তার মাত্র
বিয়াল্লিশ বছরে ছোট্ট জীবনে ষাট বছরের গদাইয়ের বিয়ে হয় ! কথা বলতে ফোঁস ফোঁস করে
নিঃশ্বাস ফেলে ।
পদাও থাকতে না পেরে মুখ ফস্কে বলে ফেলেছিল শ্রীমান
ব্রহ্মদৈত্যের-শাঁকচুন্নির বিয়ের কথা । আর
সেই থেকে প্রায় ছিনে জোঁকের মত শান্তি পদার সাথে সুযোগ পেলেই দেখা করে । পদার সাথে
কথা বলে ঠিক করে নেয় মা-বাপ মরা শাঁকচুন্নির কন্যা দান সেই করবে । তবে ব্যাপারটা
করতে হবে লুকিয়ে ।
মাঝখানের কটা দিন তারা ঠিক করেছে কি কি খাবার হবে , কতজন
ভূত খাবে ! সব ভূত তো সব কিছু খায় না ! কেউ খায় মাছ-মাংস-কাঁটা-আঁশ ভাজা দিয়ে পাঁচ
পদ , আবার কেউ সম্পূর্ণ বৈষ্ণবীয় খাবার !
মামা আজ জব্বর সেজেছে । টেকো খুলির উপর সাদা টোপর ,
হাড়ের উপরেও বারো হাতের ধূতি জড়ানো । শাঁকচুন্নি মামীকে লাল চেলি দিয়ে মুড়ে ফেলেছে
শান্তি । চেলীর আড়ালে নাক কাটা শাঁকচুন্নি কালো পানা মুখে লাজুক হাসি... দেখলেই
চোখ জুরিয়ে যায় ।
বটগাছের তলায় বিয়েটা সবে মাত্র শুরু হয়েছে । একে একে
মালা বদল , শুভ দৃষ্টি , সিঁদুর দান সব সম্পন্ন হয় । গেছো , মামদো , মেছো ,
স্কবন্ধ ভূত সকলে হুল্লোড় করে আমদ মনে পাত পেরে খেতে বসে ।
মামি কোমর বেঁধে লুচি , ছোলার ডাল , থোরের কালিয়া ,
ভেটকি মাছের বিরিয়ানি আর শেষ পাতে কালো ছাগলের দুধের পায়েস খাওয়ায় । মাছের রেসিপি
আর মাছ সাপ্লাই মেছো ভূত গিন্নী করেছে ।
পেট পুরে খাওয়া । মনের সাধ মিটিয়ে বিয়ে ভীষণ ভাল ভাবে
সম্পন্ন হয় । ব্রহ্মদৈত্য মামা কথা দিয়েছিল শান্তি আর পদাকে সব ঠিকঠাক হলে বিশেষ
মন্ত্র শিখিয়ে দেবে । পদার মনটা পরে ফেলে মামা । আস্তে করে পদা আর শান্তিকে কাছে
ডেকে কানের মধ্যে ফিসফিস করে মন্ত্র বলে –
“ ভূতের বিয়েতে খেটেছ
প্রানপণ –
বেঁচে থাকতে করো পরিশ্রম ।
মামা-ভূত মামী ভূত দিল
মন্ত্র –
খাটলেই খুশীর ধন পাবে
অফুরন্ত !!”
পরদিন সকালে পদা বাবার সাথে দোর বন্ধ করে কাজে বেরোয় ।
শান্তি পুনরায় সংসারের কাজে মন দেয় । এটুকু তারা বুঝেছে আকাশকুসুম না ভেবে পরিশ্রম
করলেই ফল পাওয়া যায় । যার উদাহরণ , “পদার বিবাহ অনুসন্ধান কেন্দ্র” । কয়েক মাসের মধ্যে যা পাঁচ গাঁয়ের সেরা পাত্র-পাত্রীদের চার হাত এক
করার জন্য নাম্বার ওয়ান পজিশন পায় ।
পদা এখন বুড়ো বাপের বদলে নিজেই ঘরের হাল ধরেছে । ভীষ্মলোচন
হরি নাম জপে আর ফাঁক পেলেই পদার অনুসন্ধান কেন্দ্রে জমে থাকা ছবি থেকে পাত্রী
খোঁজে । না নিজের জন্য নয় , পদার জন্য ।।
No comments:
Post a Comment