১
“একেই বলে যাচ্ছেতাই ব্যাপার...”
মাঝে মধ্যেই বেড়িয়ে পরে শুভম তার বহু পুরনো সঙ্গীটিকে নিয়ে । আজও তার ব্যতিক্রম
হল না । কিছুদূর যেতেই সামনের যে বড় মাঠটি ঠিক তার ডান দিকেই কয়েকটি দোকান ।
দোকানগুলির চালা বেশ কয়েকটি শুকনো খেজুর পাতা জুড়ে বানানো । একটু ইতস্তত করে
বাইকটা দোকানটার পাশে দাঁড় করিয়ে সেখানে বসল । বেশ কয়েকটা লোক আমার দিকে
চেয়ে আছে । চোখের মধ্যে নানা জিজ্ঞাসা ।
- “ আমি আসছি মানে আপনাদের ওই শহর থেকে ”, আঙুল তুলে অজানা দিক
- “ ও , তা বেশ তো , একা এসেছেন ?” একটু হাট্টাখাট্টা লোক বোকা বোকা
দেখিয়ে হেসে সহজ গলায় শুভম বলে ।
প্রশ্নটি করতেই শুভম ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ জানায় ।
শীতটাও জাঁকিয়ে পড়েছে । জ্যাকেটের হুডটা মাথায় বেশ করে জড়িয়ে মাটির ভাঁড়ে চুমুক
দিতে দিতে গল্প শুরু হল । মাঠ আর দোকানের পাশ দিয়ে চলে গেছে কালো পিচ ঢালা রাস্তা
। বিকেলের শেষ বাসটিও হর্ন বাজিয়ে হুস করে বেরিয়ে গেল । উপচে পরা ভীড় । ছাদেও
গুটিকয় লোক চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আছে । মাঠটি কুয়াশার চাদরে ঘুমের দেশে পাড়ি দেওয়ার
জন্য প্রস্তুত । ফট করে জ্বলে উঠল কালচে হ্যারিকেন ।
- “ কি ব্যাপার ! আপনাদের এখানে ইলেক্ট্রিসিটি নেই , মানে কারেন্ট পৌঁছায়
নি !” অবাক হয়ে প্রশ্নটা ছুঁড়ল দোকানদারকে ।
প্রশ্নটা মনে হল ফালতু । অবজ্ঞা নিয়ে জবাব এল , “ ওসব কি আমাদের কপালে আছে যে
হবে !”
- “ না মানে, এখন তো অধিকাংশ জায়গায়...” শুভমের কথা শেষ হওয়ার আগেই
একটু বুড়োটে গোছের লোক চাদরের ফাঁক দিয়ে বলল , “ ও বেশ ভালই আছি
এতে, গরীব লোক আমরা , আমাদের রাতে এখন চোখ সয়ে গেছে ।”
শুভম বুঝল এ বিষয়ে অযথা তর্ক বাড়িয়ে লাভ নেই । ঘড়ির দিকে তাকাতেই লক্ষ্য করল
কাটা বলছে ছ’টা বাজে । মনে মনে বলল এবার উঠতে হবে , না হলে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে
যাবে । অজানা রাস্তা, তার উপর বাইক । পাঞ্চার হলে বিচ্ছিরি রকম সমস্যায় পরে যাব ।
উঠে দাঁড়াতেই পাশের এক চ্যাঙরা ছেলে বলল , “ দাদা চললেন নাকি ? থেকে যান আমাদের
গরিবখানায় ।” ছেলেটির কথায় ভাল লাগল । বেশ সুন্দর ভদ্র ।
- “ ভাই , পরে আরেক দিন না হয় থেকে যাব ,” কথাটি বলেই সবাইকে হাত নেড়ে
বিদায় জানিয়ে শুভম বাইক স্টার্ট করল ।
ছেলেটি দৌড়ে এসে একটু জোড়ে বলল , “ দাদা , রাস্তায় অসুবিধা হলে সোজা গাঁয়ের দিকে
চলে আসবেন । আর হ্যাঁ, আমার নাম হারা ।”
একেই ভরা শীতকাল । পৌষ মাস শেষ হয়ে মাঘের সন্ধ্যা । গাড়ীর হেড লাইটে বাঁশ গাছের
হাল্কা ছায়া ফুটে উঠছে । রাস্তাটাকে মনে হচ্ছে ঘিরে ধরেছে অন্ধকার । সাথে পাল্লা দিয়ে
পুরনো সব গাছের ডাল , লতা-পাতা লাইট পড়তেই ছায়া হয়ে নাচানাচি শুরু করেছে । যদিও
এমন অভিজ্ঞতা আগেও আছে , তবু আজ কেন জানি না কেমন যেন করে উঠলো শরীরটা
শুভমের । মনটা একটু অন্যদিকে করে গুন গুন করে গান জুরে দিল । অনেকটা পিছনে পরে
থাকল সেই মাঠ ,দোকান । আরও খানিকটা এগোতেই ছোট্ট একটা পুল । বাইকটা একটু
এগিয়ে পুলের উপর উঠতে যাবে ঠিক তখনি সজরে ব্রেক কষতে হল । হঠাৎ মনে হল কি
যেন চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে । টাল সামলাতে না পেরে ছিটকে পড়ল পাশের মাঠে । ঘন
কুয়াশার মধ্যে ভিজে ভিজে জোলো জমি । মাথাটা হেলমেটের মধ্যে ঝিম ঝিম করতে লাগল ।
চোখটা মনে হল কে যেন জোর করে বন্ধ করে দিচ্ছে ।
২
কাটারিপুরে রাতটা একটু আগেই হয়ে যায়, তার উপর শীতকাল । দোকানের ঝাঁপ নামিয়ে যে
যার ঘরে ঢুকে পরে । টিমটিম করতে থাকা লন্ঠনও দমকা হাওয়ায় কখন যে নিভে যায় ,
সেদিকে কারোরই খেয়াল থাকে না । মোটামুটি সকলে ব্যস্ত হয়ে পরে নানা কাজে । সুনসান
রাস্তায় হাড় হিম করা হাওয়া বইতে থাকে । এ অঞ্চলে রাত হলেই ভেসে আসে নানা রাত
পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ । মাঝে মধ্যে অজানা প্রানীর অদ্ভুত সব আওয়াজ ভারী
করে তলে কাটারিপুরকে ।
রাতটা মনে হয় বেশ গভীরই হয়েছে । মাথাটায় হাত বোলাতে থাকে শুভম । গলাটা শুকিয়ে
কাঠ । শীতের রাতেও মনে হচ্ছে সারা শরীর জুড়ে কে যেন আগুন ছড়িয়ে দিয়েছে ।
- “ কেও আছো ?” কোনক্রমে গলা তুলে বলার চেষ্টা করে । শরীরটাকে একটু
তুলে ধরতেই বুঝল, কারা যেন পা দুটোকে বেঁধে রেখেছে । শিউরে উঠলো শুভম ।
- “ কে আমার পা দুটো ধরে রেখেছে, ছাড়ো ...” কথাটা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই
মনে হল নিরেট অন্ধকারের মধ্যে থেকে একটা হাল্কা নীলচে ধোঁয়ার
কুণ্ডলী ধীরে ধীরে তার চোখের সামনে জমাট বাঁধছে ।
চেষ্টা করলো ভাল করে দেখার । অন্ধকার যেন চোখের উপর থাবা গেড়ে বসেছে ।
ভাল করে চোখ কচলিয়ে দেখার চেষ্টা করতেই অনুভব করলো একটা নয় বেশ কিছু
ধোঁয়া তার সামনে হাল্কা ভাবে সরে সরে যাচ্ছে । গলাটা আরো শুকিয়ে উঠছে শুভমের
। ঠিক তখনই একটা তীক্ষ্ণ আওয়াজ কানটাকে ঝালাপালা করে দিল । জ্যান্ত কোন
প্রানীর ছাল ছাড়ালে যেমন ভাবে যন্ত্রণায় চীৎকার করে ওঠে ঠিক তেমনই ।
ধীরে ধীরে শুভম খাট থেকে নেমে অন্ধকার ঘরটা হাতরিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা
করলো ।
কিছুক্ষণ হাতড়ানোর পর একটা দরজাগোছের নাগালে এলো । সন্তর্পণে ঠেলে
বাইরে বেরতেই দেখল কারা যেন বাইরে হনহনিয়ে যাচ্ছে । একটু দূরেই একটা জমাট
কালো মত জায়গায় কিছু লোক জোরে জোরে কথা বলছে । ভাল করে বোঝার চেষ্টা
করতেই , অনুভব করলো ঘাড়ের পাশে কে যেন গরম নিঃশ্বাস ছাড়লো ।
- “ আরে দাদা চললেন কোথায় !” ছায়ার মত কি যেন দুলে দুলে কথাটা বলছে ।
শুভম কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো ছায়াটা আস্তে আস্তে চেহারা
নিচ্ছে ।
- “ আরে হারা যে ! কখন এলে ?” , ঘোড় বিস্ময়ে একটু জো্রেই কথাটা বলে
ফেলে শুভম ।
- “ আস্তে বলুন , ওরা শুনতে পেলে আর রক্ষা থাকবে না ”, উত্তরটা হাওয়ার
মধ্যে ভেসে এলো ।
চারিদিকে একটা আঁশটে বোটকা গন্ধ ম ম করছে । মাথার উপর দিয়ে প্যাঁচা জাতীয়
পাখি ফর ফর করে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে উড়ে গেল । রাতের বেলা মানুষ ছাড়া সবারই
চোখ জ্বলে । কিন্তু এত আলো কি হয় চোখে ! মনে হচ্ছিলো দুটো বড় বড় লাইট
লাগানো । একটু সামলিয়ে শুভম হারাকে আঙুল তুলে দেখাল ওই কালো মত জায়গাটার
দিকে ।
- “ আচ্ছা এই রাতে ওই অন্ধকারে এত কথা কে বলছে ! কোন বিপদ হয় নি তো
?”
- “ না না কিছু হয় নি । ” হারা আস্তে আস্তে কথাটা বলেই আবার বলল , “
আপনি আসুন আমার সাথে , আপনি বাইরের লোক ।
- “ কেন কি হয়েছে , আমি তো কিছু ক্ষতি করি নি ”, একটু ঘাবড়ে গিয়ে শুভম
বলে ।
- “ আঃ , ইসসস ধীরে , ওরা দেখতে পেলে আপনাকে জ্যান্ত রাখবে না । অনেক
দিন পর তাজা শরীর কার না ভাল লাগে বলুন ”, একটু মৃদু ধমকে হারা বলে ।
- “ কি বলছ কি হারা ! আর তুমি অমন অন্ধকারের মধ্যে কথা কেন বলছ ?”
মাঝে মধ্যে ওই জমাট অন্ধকার গুলো নড়ে উঠছে । হঠাৎ জোরে কে যেন কেঁদে উঠলো
। মনে হল সপাং করে চাবুক মারচ্ছে । বাতাসে চাবুকের শব্দ অন্ধকারকে চিরে দিয়ে
গেল ।
৩
কত গুলো মাথা ঘিরে ধরেছে শুভম’কে । লোকগুলোর জামা-কাপড় গুলো এলোমেলো ,
নোংরা । গা দিয়ে ঘিন ঘিনে বাসি গন্ধ । শীতকালে বেশীদিন স্নান না করলে যেমন জমে
থাকে গন্ধ গুলো ঠিক তেমনি । মাথাটা একটু তুলে লোকগুলির মুখের দিকে তাকাল ।
ধীরে ধীরে একটা আলোর ছটা তাদের মুখের চারপাশে ছড়িয়ে পড়তেই চমকে উঠলো শুভম
। হারার কথাতে আর কথা না বাড়িয়ে সেই নীলচে ছায়ার পিছন পিছন একটা ছোট্ট ঘড়ে
ঢুকেছিল । অদ্ভুত একটা অবসন্ন ভাব এখন তাকে খেয়ে ফেলছে । ঘাড়ের কাছে
চিনচিনে একটা ব্যথা । তাহলে কি ওই পরে যাওয়ার জন্য ব্যাথাটা মাঝে মধ্যে চাড়
দিচ্ছে ! ঘাড়ের কাছে হাত দিতেই কে বেশ বলে উঠলো , “ আরে মশাই আপনার কিচ্ছু হয়
নি, সব ঠিক আছে ।”
“ আরে দাদা , আপনি যেই পরে গেলেন আমি খবর পেতেই এখানে আপনাকে তুলে
আনলাম ,” হারা একটা খোনা খোনা গলায় উৎকট ভাবে হেসে বলল ।
শুভমের হাতটা তখন ঘাড়ের কাছে । আঙুল দিয়ে হাত বোলাতেই অনুভব করল , একটা
জায়গা একটু ফুলে আছে ।
“ আমাকে একটা টর্চের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন ?” অনুনয়ের সুরে জিজ্ঞাসা করল
শুভম ।
“ধুর , এখানে আলোর কাজ কারবার নেই । আর আপনি তো আমাদের এখানের বিশেষ
লোক যে । বেশীক্ষণ আর আপনার কষ্ট পেতে হবে না ।”
আরে , এ যে চেনা চেনা গলার আওয়াজ ! এ তো আজ বিকালেই শুনেছে । কিন্তু এত কাছে
থাকতেও আওয়াজটা এত দূর থেকে আসছে কেন !
- “ ঠিকই ধরেছেন মশাই । আমি সেই দোকানদার ,” কথাটা বলতেই চারিদিকে
সব যেন কোন পাতালপুরী থেকে কেঁপে কেঁপে হাঁসতে শুরু করে দিল ।
সেই সময়েই দূর থেকে একটা খট খট শব্দ ভেসে আসতে লাগলো । মনে হল কেউ যেন গরুর
গাড়ি করে আসছে । আর আশ্চর্য শব্দটা আসতেই সব যেন নিঝুম মেরে ভোজবাজির মত
অন্ধকারে মিশে গেল । শুভম ওদের নাম ধরে কয়েকবার ডাকল কিন্তু কোন সাড়া পেল না ।
ঘড়টা থেকে বাইরের দিকে উঁকি মারতেই দেখল , একটি লোক গরুর গাড়ী করে ধীরে ধীরে
তার ঘড়ের দিকে আসছে । গাড়ীটার পাশে যেন একটা হাল্কা আলোর রেখা । গরু দুটি যেন
আর চলতে পারছে না । মাঝে মধ্যেই থেমে যাচ্ছে । লোকটি সপাং করে মারতেই নড়ে উঠছে
গাড়ীটি । অদ্ভুত ভাবে দপ করে জ্বলে উঠছে চারটে বড় বড় চোখ । নাক দিয়ে বেরোচ্ছে
আগুনের হল্কা । নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে অসুবিধা হচ্ছিল । গলাটা কে যেন তার
জাপটে ধরেছে ।
- “ ছাড় আমাকে ,” কোন মতে দম নিয়ে শ্বাস টেনে বলে উঠলো শুভম । যে
- “ অমন ভাবে দেখতে নেই আমাদের শুভমবাবু । যা দেখছেন সব সত্যি ”, আলো
আঙুলগুলো পেঁচিয়ে আছে গলার চারপাশে সেগুলো যেন আরো মাংসের মধ্যে
গেঁথে বসেছে । পা’টা ছটফট করতে লাগলো । তাও প্রানপণে ছাড়াবার চেষ্টা
করে যাচ্ছে । কতক্ষণ জানা নেই একসময়ে আঙুলগুলো খুলে যেতেই ধপ করে
পরে গেল মাটিতে । দূরে একটা ফেউ বাচ্চার মত কেঁদে উঠলো থেমে থেমে ।
আঁধারির মধ্যে লোকটা বলে উঠলো ।
আকাশের কোণায় বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে । শীতের রাতে আচমকা শুরু হল বৃষ্টি । দূরে কড়াত
শব্দ করে বিকট ভাবে বাজ পড়ল । অন্ধকারটা যেন ওই আলোতেই একটু মুছে গেল । শুভম
দেখল তার সামনে খালি পায়ে কয়েক হাত লম্বা একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে । পা খালি, পরণে
একটা ময়লা খাটো ধুতি । জড়া জীর্ণ মুখটায় কবেকার না কাটা চুল দাড়ির জঙ্গল ।
হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হওয়ার জন্য একটা কুকুর কুঁই কুঁই করে ওদের কাছে আসতেই লোকটা
খপ করে হাত বাড়িয়ে কুকুরটাকে তুলে নিল । বাইরে ঝম ঝম করে জল পরে চলেছে । কড়-
কড়-কড়াৎ - এক ঝাঁক বিদ্যুৎ খেলে গেল চোখের সামনেই । আর তাতে শুভমের সারা
শরীর যেন একটু কেঁপে গিয়েই স্থির । ফ্যাল ফ্যাল করে দেখল , লোকটি কুকুরটার মাথাটা
কামড়ে ধরে আছে । একটু টানতেই ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এলো টক্ টকে লাল রক্ত । সারাটা
মুখ রক্তে ভাসছে । লোকটি তৃপ্ত হয়ে সাপের মত চেড়া জিভ দিয়ে চেটে নিচ্ছে আরেকটা
হাত । তারপর টান মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিল মাথা ছাড়া ধড়টা ।
দূরেই কুকুরটার শরীর বার দুই কেঁপে উঠে স্থির হতে না হতেই কতগুলো লোক ঝাঁপিয়ে
পড়ল দেহটার উপর । নিমিষের মধ্যেই শেষ ।
- “ আঃ , কতবার বলেছি এভাবে খাবি না । এইতো কাল রাতেই তোদের দিলাম ,
- “ এমন করলে দূর করে দেব , যা এখান থেকে ,” বলেই লোকটি কষের রক্তটা
তাতেও শান্তি নেই !” শুভমের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি অসম্ভব
বিরক্তির সুরে কথাটা বলে উঠল । হাতটা লম্বা করে দিল অদ্ভুত ভাবে ।
সপাং সপাং করে চাবুকের শব্দ আর ব্যাথায় গোঙানির আওয়াজ বৃষ্টির
আওয়াজকে ছাপিয়ে গেল ।
মুছতে মুছতে শুভমের দিকে তাকিয়ে আবার বলল , “ আরে ঘড়ের ভিতরে চলুন
মশাই ।”
বৃষ্টিটা থেমে গেছে একটু আগেই । আবার সেই স্যাঁত স্যেঁতে ভিজে ঘড় । ঘটনাটা ঘটতে
বেশি সময় নেই নি । কিন্তু যা হল তা ভুলবার নয় । যতটা সম্ভব শক্তি নিয়ে শুভম বলে
উঠল , “ এটা কোথায় ? আর এগুলো কি !!” শেষের দিকে স্বরটা ভয়ঙ্কর ভাবে কেঁপে উঠল
।
- “ কেন ! কি আর হবে ? আমাদের বুঝি খিদে তেষ্টা কোন কালেই থাকতে
পারে না !” লোকটি বিস্ময় জড়ানো গলায় পালটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল । কথা বলার
বা বোঝার মত শক্তি আর নেই শুভমের । তাও কিছু বলতে যাচ্ছিল । ঠোঁট দুটি
নড়ে উঠল কিন্তু শব্দ বেরলো না । খ্যা খ্যা করে অট্টহাসি দিয়ে লোকটি বলে
উঠল,“ শুনুন মশাই , আপনি যেখানে আছেন সেটা হল কাটারিপুর । লোকে
এখনও ভুত জংশন বলেই জানে । বহু বছর আগেই গ্রামটি অনাহারে রোগে শেষ
হয়ে যায় । মড়া লোকগুলোর সদ্ব্যবহারও হয় নি আজ অবধি । তাই আজও
আমরা থেকে গেছি ।”
- “ আমাকে যে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছেন ,” নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে শুভম বলে
- “ সে আপনি থেকে গেছেন আপনার কপাল জোরে । আর একটু হলেই গিয়েছিলেন
- “ মানে !” আঁতকে উঠে বলে শুভম ।
ওঠে ।
।”
- “ ঘড় থেকে বেরবেন না , শেষবার বলছি, তাজা রক্ত শীতের রাতে বেশ ।” হা হা
করে রক্তজল করা হাঁসি সেই রাতে চারিদিকে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো ।
শুভমের কানের কাছে নোনতা হাওয়ার সাথে ফিস ফিস শব্দ ভেসে আসে , “
সাবধান , এ হল কাটারিপুর , তাজা টক টকে লাল রক্ত , বেরবেন না ...।”
- “ আপনি কো-থা-য়-”, সমস্ত শক্তি দিয়ে ডেকে ওঠে । বাইরে তখন শন শন
করে বইছে ঠাণ্ডা ভিজে হাওয়া । এতক্ষণে বেশ কিছুটা ধাতস্থ হয়ে উঠেছে ।
সামনেই পরে আছে সেই মৃত কুকুরটার ছাল চামরা । পা বাড়াতে গিয়েও পিছিয়ে
এলো । ঘাড়ের সেই পুরনো ব্যথাটা মাঝে মধ্যেই জানান দিচ্ছে । গাটাও গুলিয়ে
উঠছে ।
চারিদিক নিস্তব্ধ । শুধু একটা বিশাল ডানাওয়ালা বাদুর তীক্ষ্ণ চিঁ চিঁ শব্দে
গ্রামটার মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে গেল ।
৪
অনেকদিন ধরে বেরনো হয় না । আজ প্রাঞ্জল নাছোড়বান্দা ।
- “ দাদা অনেক হয়েছে চলুন কাছে পিঠে ঘুড়ে আসি, রাত ন’টায় ব্যাক ।”
অগত্যা আধমরা শীতের বিকেলে প্রাঞ্জলের চার –চাকায় উঠে বসলাম ।
আমাদের গাড়ী এগোতে লাগলো । বিকেলের আলো প্রায় মরে এসেছে ।
- “ এই, থামা থামা , চা খাব । ওই দ্যাখ দোকান ।” প্রায় চেঁচিয়ে বললাম ।
বাধ্য ছেলের মত আমরা দোকানে গিয়ে চা খেলাম ।
- “ বুঝলি কেমন যেন লোকগুলো , মরা মানুষের মত চোখগুলো ! ”, প্রাঞ্জলের
মুখের কাছে কানটা নিয়ে গিয়ে ফিস ফিস করে বললাম ।
ওর অবস্থাও দেখার মত ।
- “ দাদা চলুন, আপনি আর জায়গা পেলেন না ।” অদ্ভুত গলায় উত্তর দিয়েই
হাঁটা জুড়ে দিতেই আমিও পিছু নিলাম ।
পিছনে তাকিয়ে দেখি দোকানদার গায়ের জ্যাকেটা জড়াতে জড়াতে বলছে , “
দাদা, রাস্তায় দরকার হলে ফিরে আসবেন এ গ্রামের দিকে, আমার নাম...”।
আচমকা এক অট্টহাসিতে ভরে গেল চারিদিক । ঝুপ করে কখন যে ঘন
অন্ধকার নেমে এসেছে খেয়াল নেই । প্রাঞ্জল একটু ভীতু হয়ে যায় কাজের
সময়ে যায় । গাড়ীর স্টেয়ারিং ধরতেই দেখি একটা বিকট মুখ জানলার কাছে ।
কাঁচটা যেন নখের আঁচড়ে ক্ষত বিক্ষত করে ফেলতে চাইছে ।
_ “ কে তুমি ! কি চাও ”, ভয়ার্ত গলায় বললাম ।
“ মুক্তি দাও , মুক্তি...”, অদ্ভুত গলায় লোকটি চেঁচিয়ে ওঠে । আকাশ ফাটানো
গলায় তারপর যা হল, তা বর্ণনা করা মুশকিল । রাতের অন্ধকারে এক ছটাক
আলো খেলে গেল । এক আদিম উল্লাসে সেই বন্য গোছের লোকটির গায়ে
একটা আলোর রেখা ফুটে উঠতেই আশ্চর্য হয়ে গেলাম , এ যে সেই
দোকানদার । চোখের এক পলকে লোকটি দু’হাত দিয়ে নিজের মাথাটাকে
সজোরে দিল এক টান ।
প্রাঞ্জল আঁতকে উঠে গোঁ গোঁ আওয়াজ করেই চোখ বন্ধ করে দিল । আমি হাঁ
করে তাকিয়ে থাকলাম । ধপ করে পরে গেল ধড়টা । ড্যাসবোর্ডের কাঁচের
সামনে মাথাটা নিথর হয়ে পরে থাকলো । কাঁচটা লাল রক্তে ভরে গেছে ।
কোনক্রমে কাঁপতে কাঁপতে গাড়ীর লাইট জ্বালিয়ে স্টার্ট দিতেই নিথর মাথাটা
চুপচুপে রক্তের মাঝে ভয়ংকর ভাবে চোখটা খুলে তাকিয়ে আছে আমার দিকে ।
- “ কে তু-মি ?” এর বেশী জিজ্ঞাসা বলার ক্ষমতা ছিল না ।
- “ শু-ভ-ম , সেদিন রাতে অনেক আগেই ... আমার ঘাড় দেখুন ”এক জড়ানো
গলায় বলে উঠল ।
- “ গাড়ী থেকে বেরবেন না , আমাকে মুক্তি দিন...”।
হঠাৎ দেখি চারপাশ গভীর ভাবে চুপচাপ । ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে । কোথাও আর কোন ভয়
নেই । আকাশে কোন ফাঁকে চাঁদ বেড়িয়েছে ।
এই অদ্ভুত বিষয়টা নিয়ে পেপারে কম লেখা-লেখি হয় নি । সংস্কার –কুসংস্কার
নানা কথাও উঠেছিল । আমি মুক্তি কি ভাবে দেব তাও জানতাম না , তবে গভীর
ভাবে চেয়েছিলাম সব যেন ভাল থাকে । অবশ্য এর পর আর ওদিকে যাওয়াও হয়
নি । হয়ত সেই রাত আর কাওকে দেখতে হয় নি । আর একটা কথা বেশ কিছু মাস
পরে খবর নিয়ে জেনেছিলাম বহু বছর আগে কাটারিপুর ছিল, এখন সেই গ্রাম আর
নেই ।।
No comments:
Post a Comment