১
সাহিত্যিক উপাখ্যান :-
নাকে জম্পেস করে সরষের তেল দিয়ে খাতাটাকে বাগিয়ে ধরেই লেখার ঘোড়া
ছোটালেন মলয় বাবু । বউ দু-তিনবার , “ ওগো ভাত যে পান্ত হয়ে যাবে ” বলতেই
বেজায় ধমক খেয়ে যে পথে এসেছিলেন সেই পথেই পা বাড়ালো । ধমক খেয়েও লজ্জা নেই । স্বামী আমার লেখক মানুষ , এমনি তোর হবে না তো খাটালের পঞ্চা হবে !
সত্যি চাল বাড়ন্ত কিন্তু বলবার উপায় নেই , যে বাজার থেকে নিয়ে এস । মলয় বাবু খুশী থাকলে বউকে হাঁক পারেন , “ এই যে শুনছো ! আঃ , রাখ তো তোমার রান্না । দেখো , আমার মদনার বদনা চুরি হয়েছে , কে খুঁজে বার করবে জানো !”বউ ঘোমটার আড়াল থেকে ফিক করে হেঁসে বলে “ শেষে বদনার জন্য গোয়েন্দা , মরণ দশা ।”
আর যায় কোথায় । মলয় বাবু লুঙীতে গিট দিতে দিতে বললেন , “ দ্যাখ , এ তোমার শাক ভাত তৈরী করতে হয় , রীতিমত সাধনা ।”
- “ কে পড়বে তোমার এ গপ্প ,” মাথায় চোখ তুলে বলে বসে বউ ।
- “ পড়বে পড়বে গিন্নি , সাহিত্য জগতের আমি এক লুকানো নক্ষত্র , এক
নাম করা পাবলিশার্স বলেছেন বই বার করবেন ।”
এক দু’মাস অতিক্রম । ‘ বদনা চোরের কী হল ’ তা জানার জন্য বিপুল বিজ্ঞাপনের
আয়োজন । সবই সুহৃদ পাবলিশার্স , তারই কৃপা । আগামী বই মেলার মধ্যেই আত্মপ্রকাশ হবে সাহিত্য জগত এক বিরল সাহিত্যিকের , যিনি গোয়েন্দা গল্পের চূড়ামণি ।
পাড়ায় বিকালের আড্ডায় বউকে জারাই জিজ্ঞাসা করেন , “ কী ব্যাপার , আজকাল মলয় বাবুর টিকিটিও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না আজকাল ।”
বুক আরও চওড়া করে বউ বলে, “ দাদা, বুঝতেই পারছেন, লেখক মানুষ !”
“ মলয়’দা সব রেডি , কবে তাহলে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন
করবেন বলুন, আর হ্যাঁ , এক বার আসুন কথা আছে” , ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসে ।
রাতে বউয়ের দিকে পিছন ফিরে কি যে আজকাল হিসাব করে ভগবানি জানেন !
জিজ্ঞাসা করলেই উত্তর পাওয়া যায় না ।
মাহেন্দ্রক্ষণ হাজির । বেশ ক’টি মিডিয়াও উপস্থিত । সভাগৃহ বেশ পরিপাটী করেই সাজানো । সামনের টেবিলে বইগুলো সাপের মত সর্পিল ভাবে থরে থরে রাখা । পিছনেই ব্যানারে উঁকি দিচ্ছে জলজ্বলে ইংরাজিতে মলয় বাবুর নাম ।
- “ আরে আপনি এসে পড়েছেন , এখানে কেন ! বউ’দিকে নিয়ে সামনে বসুন, আজ
আপনারই তো দিন !” হাঁসতে হাঁসতে বললেন পাবলিশার ।
শুরু হল নানা অলঙ্কারে বক্তৃতা । বউ মনে মনে ভাবে, ‘ এত বছর বিয়ে হল এত গুণ যে তার স্বামীর আছে জানাই ছিল না !’
ভর্তি সভাগৃহে করতালির বন্যা । বাইরে থেকে মাঝে মধ্যে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে প্যাকেট বন্ধী বিরিয়ানির দল । গন্ধটা বেশ ভালোই উঠেছে ।
মলয় বাবু রাস্তায় দাঁড়িয়ে বউকে বলল , “ কি গো কেমন !”
লাজুক লাজুক হেঁসে বউ বলে , “ এত বড় লেখক তুমি জানতাম না গো ! আজ কিন্তু আমাকে বড় রেস্টুরেন্টে খাওয়াতেই হবে ।”
বউয়ের গলায় আবদার শুনেই বিষম খেল মলয় বাবু । সামাল দিয়ে বললে , “ লেখক মানেই ভবঘুরে । সামনেই দেখো না কেমন তিরিশ টাকায় মাছ – ভাত ।”কী করে মলয় বাবু বউকে বলে বলুন তো যে পাবলিশার মিষ্টি কথায় পকেট কেটে দিয়েছে ! থুড়ি, মলয় বাবু যেচেই নাম কেনার তাগিদে বাঁশকে জঙ্গল ছাড়তে বলেছিল ।
বাঁশও মহাননদে মলয় বাবুর মত অ- সাহিত্যকুলকে বেশী পছন্দও করে ।।
২
দাদা গো নাক ব্যাথা উপাখ্যান:-
মদন নাক নিয়ে বেজায় বিড়ম্বনায় ! কয়েকদিন হল মাটির দিকে তাকাতেই পারে না ।
কি যে করবে ভেবেই আকুল । সবাইকে কাজ দিয়েও শান্তি নেই । সামনেই কত বড় বড় সব মহান ব্রত । এ নাকের চিকিৎসা হয় না ! ফেসবুকের মহান মহান ঈশ্বররূপী মানব কুল বলেছেন , ‘ বুঝলে মদন নাক হল পরম সম্পদ , যত নাকে ব্যথা হবে ততই বুঝবে তোমার উন্নতি !” আর সেই থেকে এই কথাটাটাকে হরিনাম জপের মত মনে মনে সবসময় মেনে চলে ।
“ দাদা গল্পটা কী পেয়েছেন , অনেক দিন হল প্রাপ্তি সংবাদ পেলাম না ” লেখাটা ফেসবুকের ইনবক্সে টিং করে আসতেই নাক কুঁচকে উঠলো উঠলো ।
মনে গাল পেড়ে অস্পৃশ্য মড়া ছোঁয়ার মত করে ঝটপট লিখল, “ যথা সময়ে জানানো হবে ।”
মনে মনে বলল, ‘এরা কীভাবে ! সম্পাদকের কী শুধুই একটাই কাজ, যত্তসব !’
- “ ঘড়ের খেয়ে বনের মোষ না তাড়িয়ে বাজারটা করে নিয়ে এস ,” বাবা পাশের ঘড়
থেকে ডেকে উঠলেন ।
সেলিব্রেটি সেলিব্রেটি ভাব উধাও মদনের । ঝাঁটা পিটা করবে কাজটা না করলে ।
মদনের নানা চিন্তা । বাড়ীর লোকেরাও বোঝে না ! তবে এটা ঠিক পেটে ভাত গুঁজে
বাপের ধনে পোদ্দারি করতে দিব্যি লাগে অনেক সময় ।
রাত দশটা । পাশের মোবাইলটা ঝন্ঝন্ করে কেঁপে উঠল । আর চোখে তাকিয়ে দেখল । সামনেই বাবা বসে । খাওয়ার টাইম । ওদিকে ফোনও মৃগী রুগীর মত বার বার কেঁপে উঠছে ।
- “ আহা ফোনটা ধর !” মা বলে বসলেন ।
- “ ও যত ভুল ভাল লেখা পাঠায় আর ছাপছেন কিনা তার জন্য চোদ্দবার ফোন ”
আবার মদনের সম্পাদকীয় নাক ব্যথা শুরু হয়ে যায় ।
রাত বারোটা । আদর্শ সময় ফেসবুক জগতের । পত্রিকা নামক মন্দিরের প্রধান
ওঝার সাথে বার্তালাপ করার মহান টাইম । মদন ফেসবুকের দরজায় নাড়া দিতেই
সারিবদ্ধ লেখক- লেখিকাকুল থেকে প্রতিবাদশীল কবিরাও জেগে উঠলেন ।
মদন হাফচোখ বন্ধ করে বিশেষ বিশেষ ভক্তের আহ্বানে সদয় হল ।
- “ দাদা ব্যস্ত ”
- “ হুম ”
- “ পত্রিকা কবে বেরোচ্ছে ”
- “ জানানো হবে, পেইজ ফলো রেখো , এখন খুবই ব্যস্ত আছি ” কথাটা লিখেই টুক করে দেখে নিল অরিজিন্যাল প্রফাইলে গিরলফ্রেন্ড অন লাইন কিনা ! তারপর নিজের পত্রিকার পেজে ক’জন লাইক দিল । ‘ যা মাত্র ১৭০ টা ’ ।
এ ভাবেই যায় মদন সম্পাদকের দপ্তর । যত না আওয়াজ বাজে তার থেকে বেশী । ভাগ্যিস ফেসবুক, অয়াটস্যাপ ছিল । আর তাতে কবিসুলভ প্রোফাইল পিকচার দিয়েছে । না হলে লেখা তো দূর অস্ত পাড়ার নেড়ি কুত্তার দলও পাত্তা দিত না ।
দিন কয়েক পরে মদন স্নানে ঢুকেছে । টেবিলের এক কোণে ফোণের পিছনে একহাত লম্বা তার গোঁজা । সারা রাত পরিশ্রমের পর একটু দম নিচ্ছেন ফোন মহাশয় । ঠিক তখনই সেটি সুরেলা কণ্ঠে গেয়ে উঠলো ‘ লুঙ্গী ড্যান্স লুঙ্গী ড্যান্স ’।
মা কী করবেন ভেবে না পেয়ে কানে তুলে নিল ফোন , “ হ্যালো , দাদা আমি বলছি
চিনতে পারলেন ।”
- “ কে বলছ , আমি ওর মা বলছি ”
যথাসম্ভব মার্জিত গলায় অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসল , “ মাসিমা, দাদা তো খুবই
ব্যস্ত মানুষ , একটু বলবেন সাহিত্যক রঞ্জন ফোন করেছিল ।”
এ হেন কাকিমাও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন ! মদন স্নান করে বেড়িয়ে আসতে আসতে বিস্ফারিত চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললে , “ কার ফোন !”
- “ হ্যাঁ রে মদন তুই আবার কবের থেকে ব্যস্ত বিখ্যাত হলি ! গত বছরও তো গ্র্যাজুয়েটে ফেল করলি , বাংলা অনার্স তো কাটা গেল ”বলেই মুখ ঝামটা দিয়ে বেড়িয়ে গেলেন মা ।সেই রাতে মদন স্ট্যাটাস দিল ‘ বিশেষ কারণ বশত “নাক উঁচু” পত্রিকা বেরোচ্ছে না ।।’
৩
নেপোয় মারে দই উপাখ্যান:-
জয় জয় বাবা সোশ্যাল সাইট । তুমি আছো বলেই এর মাথা ওর ঘাড়ে চাপাতে বেশী টাইম লাগে না । সুকুমার রায় থাকলে তোমাকে যে কী আদর করতেন, তা তুমি স্বয়ং জানো না ।
আমার বন্ধু কার্তিক আমাকে ম্যাসেজ পাঠিয়েছে । সকালে অন হতেই দেখলাম এক দীর্ঘ কবিতা । উপরের কোণায় লেখা কবি কার্তিক ধীবর । বেশ লেখাটি । তবে ওটিকে
কবিতা না বললেই ভাল । গদ্য কবিতা । মাকে পরে শোনালাম । বন্ধু মহলে পাঠালাম । অবশ্যই কবি কার্তিক ধীবরের নাম সহ ।
গদ্য কবিতাও ফেবুর দৌলতে পৃথিবীর আনাচে কানাচে ধাক্কা মেরে পরিভ্রমনের পথে বেড়িয়ে গেল ।
আমার বন্ধু কার্তিক নামকরা কোন মদন বা মলয়বাবু নয় । নিতান্তই আটপৌরে
বাড়ীর ছেলে । আর বাঙালী মানেই জাত কবি সাহিত্যিকের দল । মুখে মুখে ছড়া
ঘোরাঘুরি করেন । শুনেছিলাম সনেটও এমনি সহজ ফ্রান্সের মানুষের মুখে । যাইহোক , আমার বন্ধুটিও বাদ যায় কেন ! ওরও অধিকার আছে ।২৫ ডিসেম্বরের পিকনিকে বেশ মজা করলাম ওকে নিয়ে ।
- “ কী রে প্রেম করছিস নাকি ”
উদাস গলায় বলল , “ ধূর কি যে বলিস ! দেখে দে একটা ভাই ।”
টুং করে দেখলাম একটা ম্যসেজ ঢুকল ২৫ ডিসেম্ব্বরের শুভেচ্ছা জানিয়ে । পড়তে শুরু করলাম । আমার বন্ধুটিও পাশেই বসে আছে । ও শুনছিল । কিছুদূর পড়ার পর থেমে গেলাম । পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম । শেষে ওকে ম্যাসেজটি দেখালাম । সব ঠিক আছে , শুধু , কবি কার্তিক ধীবরের জায়গায় লেখা, হরিহর গয়লা ।।
No comments:
Post a Comment