আহা কী আনন্দ আজ আকাশে বাতাসে ”...
হলুদবনে সবাই প্রস্তুত । কচিকাঁচারা মাঝে মধ্যে হুটোপাটি আর আনন্দে গান
গেয়ে উঠছে । বড়োরাও বাদ যায় কেন ! তারাও হাতের কাজ থামিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গ দেওয়ার
জন্য মাথা , হাত –পা নাড়াচ্ছে ।
এই বনটা তাদের অনেকদিনের চেনা । এখানেই জন্ম , বেড়ে ওঠা । কত কী না দেখেছে
এই বনে তারা । ভালো মন্দ মিশিয়ে তাদের জীবন । সকাল হতেই বট দাদু রসিক মেজাজে শীত
দাদাকে ষ্টেশনে ছেড়ে এসেছে । যাওয়ার আগে শীত দাদার সাথে সকলের মনটাও একটু খারাপ ।
কিন্তু আবার আসছে বছর আসবে বলে কথা দিয়েছে । আম দাদা একটু আগেই মোবাইল
পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে যেই না বলল , “ ওরে , বসন্ত মামা আসছে কয়েকদিনের মধ্যেই ।” অমনি
আনন্দে হল্লা শুরু । এই বনে বসন্ত , বুড়ো থেকে বাচ্চা সকলের কাছেই মামা । কাঁঠাল
জ্যাঠি তো শুনেই বলে উঠলো , “ অনেক দিন ভালো করে স্নানই করিস নি , সারাদিন কেবল
শীতের সাথে গপ্প ।”
জ্যাঠির কথা কী ফেলা যায় ! সুতরাং , নেয়ে খেয়ে ভালো করে রেডি থাকতে হবে । সবাই
তখন বৃষ্টি কাকুকে জোর গলায় আকশের দিকে তাকিয়ে বলল , “ ও কাকু একটু জল দাও না , আজ
সবাই মিলে স্নান করব ।”
কাকু একটু দুখু দুখু মনে বললে , “ সেই তো আমাকে এতদিন প্রায় ভুলেই ছিলে ।
যাক, তোমাদের আমি ভালোবাসি, আমি এক্ষুনি আসছি ।”
শুরু হয়ে গেল ঝমঝমিয়ে বাদল । আর আম , বট , কাঁঠাল, পলাশ , লতা পাতা থেকে
শুরু করে ঘাসেরা সব্বাই মিলে আচ্ছা করে সাবান মেখে স্নান করে নিল । জাম আর নিম
ঠাকুমারাও অনেকদিন পর মাথায় বেশটি করে শ্যাম্পু মেখে মিঠে রোদে চুল এলিয়ে বসল ।
কেয়া দিদিকে আজ দারুণ মানাচ্ছে । কেয়া দিদি মিস্টিহাসি হেঁসে অন্যান্য ভাই
বোনদের দিকে তাকিয়ে বলল , “ ওমা , কি সুন্দর সব পাতা উঠছে ।”
সারা বনে , শাল পিয়াল সব গাছেরা গুঁড়ো গুঁড়ো ফুলের রেণু ছড়িয়ে দিয়েছে ।
সাজতে গেলে বডি স্প্রেও তো দরকার । সুন্দর গন্ধে ম ম করে বাতাস হলুদবনে । মা
গাছেরা আজ বাবা , কাকা , জ্যাঠু , ঠাম্মা সবার জন্য দুর্দান্ত সব রান্নাও সেরে
ফেলেছে । মা মাটির কাছ থেকে জল আর সুজ্জ্যি মামাও হেল্প করেছে রান্না করতে । ছোট
হলে কী হবে , কচি পাতারাও মায়ের সাথে হাত মিলিয়ে খাবার বানিয়েছে ।
২
ক’দিন ধরে সময় হয় না হরেন বাবুর । আজ রবিবার । ঋষির আজ স্কুলের ছুটি ,
বায়না তো মেটাতেই হয় । বছরের একটা দিন , রঙিন হতে কার না ভাল লাগে । বন্ধু বান্ধব
হই হই করে লাল, সবুজ আবিরে হোলি খেলার মজাই আলাদা । তবে , একটাই সমস্যা , এই সময় স্কুলে
পরীক্ষাও চলে । বুঝে শুনে না খেললে শরীর খারাপ করতে পারে । নানা ভাবনা ভেবে হরেন
বাবু হাঁক পারেন , “ ঋষি , বাজার যাবি নাকি ? পরে কিন্তু আমার সময় হবে না।”
এমন সুবর্ণ সুযোগ ছাড়ার কোন মানেই নেই । বেশ কিছুদিন ধরে ঘ্যান ঘ্যান করার
পর দাদুর মতি ফিরেছে । ঋষি চটপট জিন্স আর টি-শার্ট গলিয়েই হাজির । হরেনবাবু নাতির মাথায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন , “
ঋষি রঙ কিন্তু কিনে দেব না আর নো বাদুঁড়ে রঙ অ্যান্ড নো পিচকারী । ”
আকাশ থেকে পরে ঋষি ‘ বলে কী দাদু ! পিচকারী ছাড়া রঙ খেলা !’ মনে মনে
কথাগুলি বললেও মুখে কিছু প্রকাশ করল না ।
বাজারে হরেক রকম রঙ ডাঁই করে সাজানো । যতই হাতে নিলে মোলাম লাগুক আর মিস্টি
গন্ধ ছড়াক , এই খোলা রঙের ঠ্যালায় গত বছর গাল ফুলে যাচ্ছেতাই ।
- “ কী কী আবির
নিবি বল ,” দাদু বলে ওঠেন ।
আঙুল দিয়ে ঋষি দু-তিনটি প্যাকেট-বন্ধী রঙ দেখায় । দোকানদার হেঁসে দাদুকে
বললেন , “ বাঃ , আপনার নাতি তো বেশ বুদ্ধিমান , আসল ও ন্যাচেরাল রঙ কিনতে চাইছে ,
চামড়ার কোন ক্ষতি হয় না ।”
আকস্মিক এই প্রশংসায় ঋষির দাবীর বাড়তি ইন্ধন যে জগালো তাতে সন্দেহ নেই ।
- “ দাদু একটা
কি হবে না !” পিচকারীর দিকে আঙুল দেখিয়ে করুণ আবেদন রাখল ঋষি ।
কী আর করা বাপ মরা নাতিটাই তার একমাত্র সঙ্গী । অনিচ্ছা সত্ত্বেও দিলেন
কিনে । আর ঋষিও তার এই দাদুকে ছাড়া চোখে অন্ধকার দ্যাখে ।
জিনিষপত্র কিনে ফিরতেই বেশ বেলা
হয়ে গেল । প্যাকেটবন্ধী সুগন্ধি আবির দেখিয়ে আনন্দে উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল , “ মা ,
এবার কিন্তু জমিয়ে খেলব , একদম ফুল থেকে বানানো সব রঙ ।”
কথাটা শুনেই মা তাড়া দিলেন স্নানের জন্য । ইতিমদ্ধ্যে দাদুও স্নান শেষ করে
এসেছেন । নাতি আসতেই বাড়ীর তিনজনে মিলে খেতে বসে পড়ল । গরমভাতের সাথে মাংস খেতে
খেতে জেনে নিচ্ছিল কীভাবে প্রাকৃতিক উপায়ে রঙ প্রস্তুত হয় । ঠিক সেই সময় ডাইনিং রুমের
জানলার পাল্লায় ঠুক্ ঠুক্ করে বার তিনেক কে যেন আওয়াজ করে যেতেই ঋষি সজাগ হয়ে
গেল । ঘাড় ঘু্রিয়ে দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখল , সর্বনাশ , বড্ড দেরী করে
ফেলেছে ! আজ তিনটে থেকে হলুদবনে মিটিং যে ! এখন তিনটে বাজতে বেশী দেরীও নেই ।
এতক্ষণ বলা হয়নি ঋষির কিন্তু একটা আশ্চর্য গুণ আছে । ও সেই বাচ্চা বয়স থেকে
একটু মনস্থির করতে পারলেই ফুল, ফল, গাছ, বাতাস, জল সবার কথা শুনতে ও বুঝতে পারে ।
ঠিক যেমন আমরা মানুষরা একে অপরের কথা বুঝতে পারি ।
দাদু , মা বা স্কুলের বন্ধুদের কাছে বকা-টিটকারি কত কি শুনতে হয় । মা তো
একবার হরেন বাবুকে বলেই ফেললেন , “ বাবা, বুঝতে পারছি না ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে
হবে কিনা , এমনতর কথা...”।
হরেনবাবু সান্তনার সুরে কখনো কখনো বলেন , “ বৌমা, আমরা ওকে বকাবকি করি ঠিকই
কিন্তু কিছু কিছু মানুষের এই দুর্লভ গুণ থাকে ।”
- “ তা বলে এমন
! ” থমথমে মুখে শ্রীতমা , মানে ঋষির মা বলেন ।
হরেনবাবুও বোঝেন ; এখন ছোট তাই হাঁসি মুখে বা কম টিটকারি মেনে নেওয়া যায়
কিন্তু বড় হলে এই দেখে নির্ঘাত পাগলই ঠাওরাবে ।
- “ আচ্ছা
পরীক্ষার ঝামেলা মিটুক তারপর না হয় কোন ডাক্তার কাছে নিয়ে যাওয়া যাবে’খন ,”
স্নেহের পুত্রবধূকে আশ্বস্তের সুরে বললেন ।
৩
ঋষি খেপে লাল ! মা কিছুতেই ভরদুপুরে ঘড় থেকেই ছাড়লেন না । মায়ের কাছেই
বেশটি করে জব্দ থাকতে হয় । এদিকে মাথার কাছে খোলা জানলা দিয়ে শন্ শন্ করে শব্দ
তুলে বাতাস গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বলে উঠলো , “ ঋষিবাবু , মায়ের কথা তো শুনতেই হয় ।
তুমি বরং বিকেলে এস হলুদবনে ।”
হলুদবন বলতে যে বিশাল কোন জঙ্গল তা কিন্তু নয় । ঋষিরা যেখানে থাকে সেই
অঞ্চলটা একটা সময় গভীর জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল । তারপর কল কারখানার কৃপায় অনেক জঙ্গল
কেটে তৈরী হল বসতি । তবে এখনও কিছু কিছু বন-জঙ্গল টিকে আছে ।
ঋষিদের বাড়ী থেকে হেঁটে গেলে তিন চার মিনিটের রাস্তা । আর শহরটাও খুবই
সাজান । কালো পিচ ঢালা ঢেউ খেলানো রাস্তা । রাস্তার দু-ধারে কৃষ্ণচূড়া , রাধাচূড়া
আরও কত কি রঙিন সব গাছেরা ফুলের বাহার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে । বসন্তের সময়ে লাল লাল
পলাশ , শিমূল যেন চারিদিকে রঙের আগুন ছড়িয়ে দেয় ।
ঘুম আসবে আসবে না করেও কখন যে ঋষির দু’পাতা এক হয়ে গেছে তা নিজেও জানে না ।
দুপুর প্রায় গড়িয়ে বিকাল । মায়ের ডাকেতে যখন ঘুম ভাঙল তখন সুজ্যি মামা যেন
বলছে ‘ এখন বিকাল পাঁচটা ’। নিজেকে মনে মনে ‘ ছিঃ ছিঃ ’ করে কোনমতে একটা ড্রেস পরেই
ছুট লাগায় ঋষি ।
- “ আরে হরলিক্স
খেয়ে যা ”
- “ এসে খাচ্ছি
মা ” দৌড়াতে দৌড়াতে জবাব দিল ।
হলুদবনে ঢুকতেই দ্যাখে থমথমে পরিবেশ । আমদাদা , কাঁঠাল জ্যাঠিও একদম চুপ
করে আছে । কতবার কান ধরে ঋষি ‘ সরি ’ বলল , কিন্তু কি ব্যাপার , মনে হচ্ছে কিছু
একটা গুরুতর হয়ে গেছে !
- “ আরে হলটা কি
বলবে তো !” ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে এবার বলে উঠলো ঋষি রেগে ।
খানিকক্ষণ নিস্তব্ধতা কাটিয়ে শেষে
বট দাদু বড় বড় দাড়ির ফাঁক দিয়ে বলল , “ কাঁহাতক আর অত্যাচার সহ্য করা যায় বলতে
পারো ঋষি বাবু ?”
- “ কি হয়েছে বট
দাদু ?” বটের ঝুড়িগুলোকে জড়িয়ে ধরে কাতর গলায় জিজ্ঞাসা করে ।
দাদু আর কিছু বলছে না দেখে শিমূল মামা মুখ
খুলল । গলা ঝেড়ে বললে, “ তোমাদের এই মানুষদের আমরা কত কি দেই তা তোমরা জানোই ,
স্কুলের বইতেও এত পড়েছ , কিন্তু তাও তোমরা কিছুই মানো না !”
ঋষি এবারে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলো , “ জানি গো শিমূল দাদা , তোমরা না
থাকলে আমরা বাঁচতামই না ।”
অশ্বত্থ দাদু বটদাদুর বহুদিনের বন্ধু । এবারে অশ্বত্থ দাদু চোখের জল মুছতে
মুছতে বললে , “ যাও দেখে এস নীলকণ্ঠ লতার কী হাল আর তোমার পলাশ মামার হাত পা ভেঙে
পরে আছে ।”
সেকি ! কখন হল এই অ্যাকসিডেন্ট ! দিব্ব্যি তো ছিল কয়েক দিন আগেই । কী
সুন্দর করে সাজিয়ে তুলেছিল লাল লাল ফুল দিয়ে মামার ডাল পালা ! চিন্তা করতে করতে
ভ্রূ কুঁচকে মহুয়া মামীকে বলল , “ মামী কোথায় আছে পলাশ মামা !”
মহুয়া মামী মাথা দুলিয়ে দেখিয়ে দেয় একটা দিক । ওখানেই আপাতত চিকিৎসা চলছে
মামার আর নীলকণ্ঠ লতার ।
বনের মধ্য দিয়ে পায়ে চলার রাস্তার একটু ভিতরে ঢুকতেই ওদের দেখে চোখে জল ধরে
রাখতে পারলো না ঋষিও ।
কাছে গিয়ে পলাশ মামার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে ঋষি লক্ষ্য করে একটা ফুলতো
নেইই বরং কারা যেন মুচড়ে দুমড়ে নিয়ে গেছে সব ফুল, কুঁড়ি । শুধু তাই নয় ,
অত্যাচারের মাত্রা এতটাই বেশী যে , মামার ডাল পালা ভেঙে চুরে একাকার ।
আর নীলকণ্ঠ বন্ধু শেষ নিঃশ্বাস গুনছে । সে এমনিতেই শান্ত , দুর্বল । বন্ধুর বড় বড় নীল
পাপড়ি ফুল তো দূর অস্ত , অর্ধেকটা গাছ মাটি থেকে প্রায় তুলেই নিয়ে গেছে । চারিদিকে
বেয়ে পড়ছে সাদা রক্ত ।
এসব দেখে ঋষি দাঁতে দাঁত চিপে বলল , “ কাঁঠাল মামী কারা করেছে এমন , আমি
তাদের ছাড়ব না ।”
মামী পাতার আঁচলে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠল গুমরে , “ নচ্ছার কতগুলো ছেলে পুলে
এমন করে আমাদের সংসার , আনন্দ সব মাটি করে দিল ঋষি ।”
অনেকক্ষণ আমদাদা চুপ থাকার পর বলল , “ আরে আমরা কী নিষেধ করেছি কখন , নিও
না ফুল,ফল ! নীচে তো ফুল-ফল ছড়িয়ে রাখি প্রতিদিনই ।”
সত্যি তো গাছেরা আমাদের জন্য কত কি রেখে দেয় আর আমরা ! তাতেও খুশী না !
সবার কথা মন দিয়ে শুনে ঋষি বুঝল , দোল খেলার জন্য পলাশ মামা ,নীল বন্ধুদের এই হাল
। ওদেরই ফুল শুকিয়ে এক ধরণের রঙ হয় । সেটা দিয়ে আমরা মানুষেরা হোলি খেলি । কিন্তু
এ অন্যায়- চরম অন্যায় ! ঝোরে থাকা ফুল কুড়িয়েই তো কাজ হত । তার জন্য এই হত্যা লীলা
!
সে
বছর ঋষি আর হোলি খেলে নি । বসন্ত মামা আসলে মানুষের সাথে সাথে প্রকৃতিও সব্বাই
খশীতে মেতে ওঠে । কিন্তু প্রকৃতিকে ধ্বংস করে নিষ্ঠুর ভাবে একতরফা আনন্দের নাম
স্বার্থপরতা ।
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, প্রকৃতি-গাছ সকলকে সুস্থ রেখেই মাতবে আনন্দে পরের
বছর ঋষি । এই ঘটনাটা ঋষিকে যেন অনেকটাই বড় করে দিয়েছে । তার বেশ কিছু বন্ধুও আজকাল
প্রকৃতির ভাষা বুঝতে শিখেছে ।
তাই সব বন্ধুরা মিলে মানুষকে বোঝাতে শুরু করে । বসন্ত মামা শুধু নয় , সব
ঋতু মামাদেরই সুন্দর করে অভ্যর্থনা করা যায় , যদি আমাদের মন সজাগ ও সুন্দর হতে
পারে ।।
No comments:
Post a Comment