Friday 11 March 2016

গিফট-প্যাক

                                                                                                         
যাক বাবা বাঁচা গেল ! কয়েকদিন মায়ের বকুনির হাত থেকে আপাতত মুক্তি । এ কি কম আরাম ! বাপীও ছুটি নিয়ে আসছে । উফ , ভাবা যায় না শীতের ছুটিতে কি হুল্লোরই না হবে । উনিট টেস্ট শেষ । মিঠে রোদে সকালবেলা লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে শুয়ে এসব ভাবতে যে কি আনন্দ , তা মায়ের বোঝার ক্ষমতার বাইরে ।
-      “ তিতিন অনেক বেলা হল , ওঠ এবার ”, বলেই স্বয়ং মাতাশ্রী লেপ ধরে দিল এক টান । মায়ের কাছে খুব একটা বায়ানাক্কা চলে না তিতিনের । চোখ কচলাতে কচলাতে বিছানার উপর বসে তিতিন ফিনফিনে গলায় জিজ্ঞাসা করলো , “ মা বাপী কবে আসবে বলতো ?”
-      “ কাল সকালের ট্রেনে আসবে । আর হ্যাঁ , ঝিনুক মাসিকে বলা আছে তোমাকে ব্রেকফাস্ট করে দেবে । আজ একদম লেট !” কথাগুলো বলেই কোনমতে চটি পড়েই মা বাইরের দরজার দিকে পা বাড়াল ।
এসব তিতিনের নতুন না । ঞ্জান হওয়ার পর থেকেই প্রায় প্রতিদিনই দেখে আসছে । আগের মত অবশ্য আর মাকে কাজে যেতে বাধা দেয় না । হয়ত বুঝতে শিখেছে , মায়ের কাজে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা । সুমিত বাবু ইন্ডিয়ান আর্মিতে কাজ করেন । বদলির কাজ । তবে ছুটিতে আসলে বেশ কিছুদিন পেল্লাই এই বাড়িটা যেন জীবন ফিরে পায় ।
এই চূড়ান্ত ব্যস্ত জীবনের মাঝে তিতিন সুলেখা আর সুমিতের একমাত্র প্রদীপ । তাই আদরের পরিমানটা একটু বেশী । না চাইতেই জিনিষ হাজির ।
-      “ দিদি , সকালের খাবার তৈরী , খেয়ে যা হয় কর ”, ঝিনুক মাসির কথায় তিতিন স্বপ্নের জগত থেকে নেমে আসে ।
ব্রেকফাস্টের বহর শুনে খাবার ইচ্ছা তো দূর, বিছানা থেকে নামার স্পৃহাটাও ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল ।
-      “ তুই যা , আজ খাব না , শোভনদের বাড়ি যেতে হবে ”, কথাটা বলেই তিতিন লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে চটপট বাথরুমে ঢুকে পরে । তিতিন ক্লাস সেভেনে পড়ে,বুদ্ধিও খারাপ না । ঝিনুক মাসির পরবর্তী সংলাপ তার মোটামুটি মুখুস্থ । মা বেরিয়ে যাওয়ার পর দীর্ঘদিন এই মাসীই অতি ভালোবাসার অত্যাচার চমৎকার ভাবে ম্যানেজ করে আসছে ।

রায় বাড়ি যদিও অনেক বেশী লিবারেল , তবুও অলিখিত একটা ডিসিপ্লিনের বেড়ায় মোড়া । শত বায়না স্বত্তেও সুলেখা হাত খরচের বহরটা বর্তমান দিনের পরিপ্রেক্ষিতে কমই রেখেছে । বাবার কাছে আবদারটা একটু বেশী । গেল বার বাবাকে ঠিক হাত করে মোবাইল কিনেছিল । সুমিতের মিষ্টি হাসি সুলেখার চোখ রাঙানোকে ব্যাক ফুটে ফেলতে বাধ্যই করেছিল । তবুও তিতিন মায়ের সব কথা ফেলে দেওয়ার দুঃসাহস রাখে না । মায়ের নির্দেশ অনুসারে প্রতি মাসে নিয়ম করে হাফ হাত লম্বা পিগি ব্যাঙ্কে হাত খরচের থেকে কিছু টাকা জমাতেই হয় ।             

নাহ , আজ কপালটাই খারাপ । পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই ব্যাটা শোভন পালিয়েছে মাসির বাড়ি । অগত্যা আবার রাস্তায় বেড়িয়ে পরে তিতিন ।
-      “ ও দিদিভাই , পাঁপড় নেবে , ঘড়ে বানানো ,” কথাটা শুনেই তিতিন দেখে এক বুড়ি ফুটপাতে বসে তার দিকে তাকিয়ে ফোকলা মুখে হাসছে ।
অসম্ভব , তিতিনের মাথা ঠিক আছে ! কোথাকার কে জানে , আগে দেখেও নি । মা পই পই করে বলেছে, এসবের থেকে সাবধান, দিনকাল ভালো না । পা চালাল তিতিন, সোজা ঘড়ে ঢুকতে হবে । আর আজকাল এইসব ফেরেব্বাজ লোকদেরও অভাব নেই ।
-      “ কি রে তোকে পাগলা কুকুরে তাড়া করলো নাকি !” ধাক্কা খেতেই তিতিন দেখে তাদের স্কুলের এক মোটা মত সিনিয়র দিদি ভ্রূ কুঁচকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে ।
-      “ না গো দিদি , ওই ওদিকের একটা বুড়ি আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলছে পাঁপড় কিনতে ”, আমতা আমতা করে তিতিন বলে ওঠে ।
-      “ খবরদার, ওসবে একদম পা বাড়াস না । দেখেছিস তো স্কুলের প্রিন্সিপাল ম্যাম বার বার এসব ভুলভাল লোকদের থেকে দূরে থাকতে বলেছেন ”।
কোনমতে মাথা ঝাঁকিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়াল তিতিন । ভাগ্য ভালো কোন চেনা লোক দেখে ফেলে নি ! মায়ের কানে গেলে ঘড়ে আজ দক্ষযজ্ঞ বেধে যেত ।
 সুলেখার কয়েকদিন ধরে সুন্দর ভ্রূ মাঝে মধ্যেই ধনুকের মত বেঁকে থাকছে । অদ্ভুত কারণ ! যদিও বেশ মজাতেই দিনগুলো কাটছে । সুমিতবাবু আসার পর বাড়িটাতে হই হই রৈ রৈ লেগেই আছে । সুলেখাও কয়েকদিনের জন্য ছুটি ম্যানেজ করে নিয়েছে । তিতিনের সামনেই শীতের ছুটি । আহা , সুমিতও দূরে থাকে । সুতরাং , বাইরে কয়েকদিনের জন্য ঘুড়ে আসলে মাইন্ড ফ্রেস হয়ে যাবে ।
-      “ বুঝলি তিতিন , এবার যেখানে যাব না, উফ, কি মজা দেখবি ”, সুমিত বাবু জিভে টক টক করে আওয়াজ তুলে কথাগুলো বললেন ।
-      “ কোথায় বাপী, বল না গো ”, গলা জড়িয়ে আদুরে সুরে তিতিন বাবার গালে গাল ঠেকিয়ে বলে ।
-      “ বাপরে ! বাপ-বেটির কি আদর দেখো ! তোর বাবা যেখানে নিয়ে যাবে সেখানে কুলফি হতে হবে জমে গিয়ে ! আর জায়গা পেলো না !” হাল্কা লোক দেখানো রাগের গলায় সুলেখা জবাব দেয় ।
-      “ না রে বেটি ! অনেকে জানেন না ঠাণ্ডার সময় ঠাণ্ডার জায়গায় বেড়াতে গেলে আসল মজা হয় ”, মেয়ের গালে আলতো চুমু খেয়ে সুমিত বলে ।
গল্প করতে করতে অনেক রাত হয়ে যায় । আসতে আসতে বাড়িটা ঘুমের দেশে পাড়ি দেয় । তিতিনের চোখ দুটো বন্ধ । কিন্তু ঘুম আর আসে না । অনেক কিছু বলার আছে বাপীকে । অনেকবার চেষ্টা করেও পারেনি বলতে । বুঝতে পারছে না ঠিক করেছে কিনা । মাও আজকাল অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকে । তিতিনের দিকে চোখ রেখে যেন গভীর ভাবে মুখটা পরবার চেস্টা করে । জীবনের এ এক আজব খেলা । সবাই সবাইকে বোঝার চেস্টাই করে মাত্র । অনেক সময় বুঝতে বুঝতে সময়টা টুক করে পেরিয়ে যায় । না বোঝা থেকে যায় নানা দিক ।
-      “ হ্যাপি বার্থ ডে টু ডিয়ার মিষ্টি, তাকিয়ে দেখ কি এনেছি তোর জন্য ”, সকালে মেয়ের মাথার কাছে মুখ নামিয়ে সুমিতবাবু হাল্কা স্বরে বলে উঠল ।
-      “ বাপি ! তুমি না , কি বড় গো ট্যেডিটা ! ” চোখ বড় বড় করে আদুরে মেয়ে বাবার হাতটা জড়িয়ে ধরে বলে ।
-      “ এই যে বার্থ ডে বেবি, ওঠ এবার, কত বেলা হয়েছে ”, কোন ফাঁকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কথাটা টুক করে বলে সরে পড়ল সুলেখা ,তা বাবা-মেয়ে কেও খেয়ালই করে নি ।
মায়ের গলার স্বরে তিতিনের মুখটা কালো হয়ে যায় । কি যে হয়েছে আজকাল । আদরের বাপীর কাছে অভিমানি সুরে বলে, “ দেখলে তো ! মা’টা কেমন যেন !”
-      “ ছিঃ ! ওমন কথা বলতে নেই । জানিস কালকে রাতে তোর মা বলছিল কি যেন একটা সারপ্রাইজ রেখেছে তোর জন্য। নে নে উঠে পর ।”
বাবা ঘড় থেকে বেরিয়ে যেতেই তিতিন আলমারির মাথাটা লক্ষ্য করলো । না, ঠিক জায়গায় আছে তার স্বাদের পিগি-ব্যাঙ্কটা । যাকবাবা কেও ধরে নি ।
মুখ ধুয়ে, ওয়ার্ডরোবটা খুলতেই অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে একটা গিফট প্যাকেট । তার উপর ছোট্ট একটা চিরকুট । তিতিন ঝুঁকে দেখল লেখা আছে , ‘ ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে  প্যাকেটের জিনিষটি পরবে ’।
অবাক হয়ে গেল তিতিন । মা এত রসিক জানা ছিল না তার ! প্যাকেট খুলে দেখে সুন্দর একটা লাল আর নীল কম্বিশনের দারুন একটা ফ্রক । খুশীতে তিতিনের মুখ চক চক করে উঠলো ।
আস্তে করে দরজা খুলে ড্রয়িং রুমে আসতেই দেখে  বাপী আর মা তো আছেই । কিন্তু একি ! সাংঘাতিক বিস্ময়ে তিতিনের চোখ ছানাবড়া । এ কি করে সম্ভব ! চোখে ভুল দেখছে না তো !
-      “ তিতিন আয় এদিকে । দেখ তো চিনতে পারিস কিনা ? ” মায়ের মিষ্টি গলায় সম্বিৎ ফিরে পায় । বাপী চেয়ারের এক কোণায় বসে মুচকে মুচকে হাসছে ।
-      “ মা ! তুমি কি করে চিনলে এনাকে ? ” গলায় একটু সাহস এনে বলল ।
-      “ বা রে ! চিনবো না কেন ? এনার তৈরি পাঁপড় তো প্রায় রোজই খাস ।”
-      “ তুমি আমাকে কোনদিনও বল নি তো ! ” অভিমানী স্বরে বলে ওঠে তিতিন ।
সুমিত বাবু বলে ওঠেন, “ এই যে ঠাকুমাকে দেখছিস , ইনি কিন্তু খুবই সাহসী । আগে যেখানে থাকতেন সেখানে ওর ঘড়টা ভেঙে দিয়েছিল দুষ্টু লোক, কিন্তু তা স্বত্তেও মনের জোরে এখনও লড়াই করছেন ।”
-      “ থাক আজ ওর জন্মদিন ওকে আজ কিছু বল না । ও আমার লক্ষ্মী নাতনী ”, বৃদ্ধা  উঠে এসে আলতো করে জড়িয়ে ধরেন ।
মায়ের চোখে জল । তবে এ জল আনন্দের । হাল্কা ভাবে ঠোঁটটা কাঁপছে । তাদের মেয়ে অমানুস হয় নি এটাই সব থেকে বড় । সুলেখা সবাইকে খেতে দিয়ে হাসতে হাসতে বলল, “ তিতিন এ ভাবে মানুষের সেবা কর , তবে খেয়াল রেখো তুমি এখনও ছোট তাই যা করবে বাড়ীর বড়দের বলে কর কেমন ”।
-      “ কি রে , ঘাড় গুঁজে আছিস কেন ? আরে পিগি ব্যাঙ্কটা তো তোর , তাই না ! ওখান থেকে তোর এই ঠাম্মাকে নিজের জন্য কিছু খরচ না করে কম্বল কিনে দিয়েছিস, এত দারুন ব্যাপার ! ”
-      “ বাঃ , কি চমৎকার মানাচ্ছে তো এই নতুন জামাটায় দিদিভাইকে ”, বুড়ি হাসতে হাসতে বলে ।
-       “ তিতিন এটা তোর জীবনের সেরা উপহার , এটা তোর এই ঠাম্মা দিয়েছেন , খেয়ে উঠে প্রনাম করতে ভুলিস না কিন্তু ! ” সুলেখার কথায় সবাই হেসে ফেলল । আর তিতিনের ফর্সা মুখটা আনন্দে লজ্জায় লাল হয়ে গেল ।।

No comments:

Post a Comment

আত্মারা যখন অন্য গ্রহে

১ রা তটা এখন বেশ গভীর । টুক করে শব্দ হতেই কান সজাগ হয়ে উঠলো অ্যাটলাসের । মাথার মধ্যে টিঁ টিঁ কী বেশ ক্যাল্কুলেশন করেই এগিয়ে গেল দরজার ...